জাপানের ঐতিহাসিক শহর কিয়োটো একসময় ছিল শান্তি, ঐতিহ্য আর নান্দনিকতার প্রতীক। এখন সেটি পর্যটকের উপচে পড়া ভিড়ে নিজের আসল রূপ হারিয়ে ফেলছে। বিদেশি দর্শনার্থীর চাহিদা, সস্তা ইয়েন, সোশ্যাল মিডিয়ার ভাইরাল ট্রেন্ড—সব মিলিয়ে কিয়োটো হয়ে উঠেছে এক ‘দর্শনীয় ফাঁদ’।
গিয়োনের রূপান্তর
গিয়োন ছিল জাপানের ঐতিহ্যবাহী গেইশা পাড়ার প্রতীক। এখন সেখানে ভিড় করছে বিদেশি পর্যটক, সস্তা কিমোনো পরে ছবি তুলছে। স্থানীয় গাইড ম্যাগি জেমস বলেন, ‘‘এরা কেউ জাপানি না। কেউ কেউ তো শোগুন সাজে আসছে!’’ গিয়োনের সরু রাস্তাগুলোয় এমনভাবে ভিড় করছে যে অনেক সময় বাসিন্দাদের নিজের বাড়িতেই ঢুকে পড়ছে পর্যটক।
পর্যটকের দাপট
গেইশাদের পিছু নেয়া পর্যটকরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে গেছে যে সিটি কর্তৃপক্ষ মোবাইল নোটিফিকেশন পাঠাতে বাধ্য হয়েছে—‘‘গেইশাদের বিরক্ত করবেন না।’’ ম্যাগি জেমস বলেন, ‘‘আমার ট্যুরিস্ট বন্ধুরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে—এটা কি জাপান? এ কেমন ব্যাপার?’’
ওভারট্যুরিজমের বৈশ্বিক প্রবণতা
২০১০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পর্যটক সংখ্যা ৬০ শতাংশ বেড়েছে। কোভিডের সময় সাময়িক বিরতি এলেও, লকডাউনের পর বেড়ানোর প্রতি মানুষের আগ্রহ আরও বেড়ে গেছে। এখন বছরে প্রায় ১.৪ বিলিয়ন মানুষ আন্তর্জাতিকভাবে ভ্রমণ করে। এই দলে চীন ও ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির বড় অংশও রয়েছে।
বিশ্বজুড়ে সমস্যার চিত্র
- ভেনিসে দৈনিক পর্যটকের সংখ্যা স্থানীয়দের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে, বড় ক্রুজ জাহাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
- লুভর মিউজিয়াম বন্ধ রাখতে হয়েছে কর্মীদের বিক্ষোভে।
- আমস্টারডাম নতুন হোটেল নির্মাণ বন্ধ করেছে।
- বার্সেলোনায় পর্যটকবিরোধী বিক্ষোভে লেখা হচ্ছে ‘ট্যুরিস্টস গো হোম’।
জাপানের দিকে নজর
২০১১ সালে জাপানে আন্তর্জাতিক পর্যটক সংখ্যা ছিল মাত্র ৬ মিলিয়ন। ২০২৪ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৩৭ মিলিয়নে। ইয়েনের মান কমে যাওয়া, সোশ্যাল মিডিয়ার ঝলমলে ছবি আর সহজ প্রযুক্তি—সব মিলে জাপান এখন অন্যতম ‘হট স্পট’। এক ভাইরাল মিমে লেখা থাকে, ‘মিডলাইফ ক্রাইসিস? চল জাপান যাই!’
কিয়োটোর আকর্ষণ ও বোঝা
টোকিওর আকাশছোঁয়া ভবন, ওসাকার নাইটলাইফের আলাদা আবেদন আছে। কিন্তু কিয়োটো মানেই যেন ইতিহাসে ফেরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুদ্ধমন্ত্রী এই শহরকে বোমাবর্ষণ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, তাই এখনো অক্ষত রয়েছে প্রাচীন মন্দির আর শ্রাইন। এই ঐতিহ্যই এখন ইনস্টাগ্রামের ব্যাকড্রপ হয়ে গেছে।
ট্যুরিস্ট শিকার
যাসাকা শ্রাইনে দেখা যায় বিদেশি পর্যটকদের দল। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা থেকে আসা তরুণীরা বলে, ‘‘টিকটকেই দেখেছি!’’ তাদের লক্ষ্য এক দিনেই ১২০০ বছরের ইতিহাস দেখা। শিনকানসেনে করে দ্রুতগতিতে আসা মানুষজন দিনে প্রায় দেড় লাখ।
চলাফেরার গল্প
লেখক বর্ণনা করেছেন, কিয়ামাচি স্ট্রিটে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা পর্যটকরা ঐতিহাসিক মাচিয়া বাড়ি থেকে কফি কিনছে। বিশ্বখ্যাত পারফিউম ব্র্যান্ড লে লাবোও এখানে ক্যাফে খুলেছে। কিয়োটো যেমন জাপানি, তেমনি হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক—রিটজ-কার্লটন, ফোর সিজনস, আমান—সব আছে।
মাচিয়ার রূপান্তর
ম্যাগি জেমস বলেন, ‘‘সব ব্র্যান্ডই পুরনো মাচিয়া কিনতে চায়।’’ অনেকে রক্ষণশীল নন—স্থানীয় কারিগরদের সঙ্গে কাজ করে ‘গল্প’ বেচা হয়। তবে বাজার বদলে যাচ্ছে। নিশিকি মার্কেট এখন পর্যটকে ঠাসা। একসময় যা ছিল স্থানীয়দের কেনাকাটার জায়গা, এখন তা ভরে গেছে ইংরেজি সাইন আর ম্যাচা শপে।
বেচা-কেনা বনাম ঐতিহ্য
মার্কেটের দোকানিরা দুই ভাগে বিভক্ত—একদল পর্যটক বিদায় চাইছে, অন্যদল টাকা রোজগার করে খুশি। কেউ কেউ দোকান বন্ধ করেই চলে গেছে। লেখক বলেন, ‘‘এখানকার অনেকেই কোভিডের সময়কার নীরবতা মিস করে।’’
ফুশিমি ইনারি: ইনস্টাগ্রাম বনাম আধ্যাত্মিকতা
লেখক সকাল ৮টায় গিয়ে দেখেন, ফুশিমি ইনারির ১০ হাজার তোরি গেটের নিচ দিয়ে মিনিটে ৫০ জনের বেশি পর্যটক যাচ্ছে। সেলফির জন্য থেমে যাচ্ছে চলাচল। এক পর্যায়ে তিনি ভাবেন—‘‘এখানে আসার মানে কী?’’
পর্যটন ব্যবস্থাপনা
লেখক আলেক্স কারের সাথে দেখা করেন। তিনি বলেন, ‘‘সবকিছু সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে—এই ধারণা বদলাতে হবে। রিজার্ভেশন, এন্ট্রি ফি চালু হোক, কিছু লোক বাদ যাবে—তাতে কিছু যায় আসে না।’’
স্থানীয়দের মানিয়ে নেওয়া
গেইশা উৎসব এখন বিদেশিদের জন্য টিকিট বিক্রি করছে। শতবর্ষী জুতার দোকানের মালিক বলেন, ‘‘গুগল বলেছে এই দোকান আছে।’’ ম্যাগি জেমস বলেন, ‘‘হলিউড তারকাদেরও বলি—অতিঘটিত জায়গায় যেয়ো না।’’
রিয়োকান অভিজ্ঞতা
লেখক বিখ্যাত হিরাগিয়া রিয়োকানে ছিলেন। ১১ পদে কাইসেকি ডিনার—কিছু খেতে পারেন, কিছু ফেলে দিতে হয়। ম্যাগি জেমস বলেন, ‘‘বিদেশিরা খায় না দেখে রিয়োকানগুলো মেনু বাদ দিচ্ছে।’’ তার স্বামী, খ্যাতনামা প্রতিযোগিতামূলক ইটার তাকেরু কোবায়াশি বলেন, ‘‘এটাই ব্যবসা। মানিয়ে নিতে হবে।’’
গোপন জায়গা, গোপনীয়তা
লেখক বলেন, সবচেয়ে ভালো অভিজ্ঞতা পেয়েছেন ছোট ইজাকায়া রেস্টুরেন্টে, যেখানে স্থানীয়দের সাথে বসে খাওয়া যায়। কিন্তু সেখানেও পর্যটক ঢুকে পড়ছে। দোকানদাররা চেষ্টা করছেন পর্যটক কমাতে। এক বন্ধুর ককটেল বার টিকটকে ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় এখন স্থানীয়রাই আর আসে না।
শেষে ভাবনা
লেখক বলেন, ‘‘একটি পারফেক্ট দিন কাটিয়েছিলাম পাহাড়ি ট্রেইলে হেঁটে, অনসেনে স্নান করে। তবে বাকি দিনগুলোও খারাপ ছিল না। কিয়োটো সত্যিই সুন্দর শহর—শুধু ভিড় ঠেলে দেখতে হয়।’’
ম্যাগি জেমসের কণ্ঠে শেষ কথা: ‘‘ওরা সবাই খুব খুশি দেখায়। বিচার করা ঠিক নয়।’’
এটাই আধুনিক পর্যটনের আসল সংকট। সবাই বাড়ি ফিরে বলে—‘‘দারুণ ছিল!’’ অথচ শহরের আসল রূপ হারিয়ে যায় ভিড়ের মধ্যে।