যুদ্ধ নিয়ে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ
যুদ্ধ মানবজাতির সবচেয়ে কম যুক্তিসঙ্গত কাজগুলোর একটি। এতে বিপুল খরচ হয়, প্রাণহানি ঘটে এবং মানুষের দুর্দশা বাড়ে—চোখে পড়ার মতো উদাহরণ সুদান থেকে গাজা পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। অনেক যুদ্ধ শুরু হয় ব্যক্তিগত অহংকার বা অন্ধ দেশপ্রেমের কারণে। নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণ বা ১৯৪১ সালে জাপানের এমন এক পরাশক্তির সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানো, যাদের হারানোর কোনো সুযোগই ছিল না—এগুলো তার উদাহরণ।
অনেকে ভাবতে পারেন, অর্থনীতি—যা স্বার্থসিদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে কাজ করে—যুদ্ধ নিয়ে তেমন কিছু বলার নেই। কিন্তু ‘ব্লাড অ্যান্ড ট্রেজার’ বইয়ে ডানকান ওয়েলডন দেখিয়েছেন, এই ধারণা ভুল।
প্রণোদনা বনাম বীরত্ব
অর্থনীতিবিদরা প্রণোদনা নিয়ে ভাবেন—যা সৈনিকরাও করেন। ১৫ শতকে ইতালির শহরগুলো যখন ভাড়াটে সেনা নিয়োগ করত, তখন এই কনডোতিয়েরি নেতা ও তাদের সৈন্যরা যুদ্ধ এড়াতে নানা চালাক কৌশল নিত। মুখে তারা রোমান ও গ্রিক যুদ্ধতত্ত্বের উদাহরণ দিতেও দ্বিধা করত না, কিন্তু আসল উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধ না করে টাকাটা তুলে নেওয়া। দুই দিকের ভাড়াটে সৈন্যরা এই অযুদ্ধের নীতিতে মৌন সম্মতি দিত। তারা ধনী হয়ে উঠত এবং সেই অর্থে দা ভিঞ্চির মতো শিল্পীদের আঁকা ছবি কিনত, যা রেনেসাঁর বিকাশে ভূমিকা রাখে।
অযৌক্তিক মনে হলেও কিছু কৌশল আসলে যৌক্তিক
উদাহরণ হিসেবে ফ্রান্সের লংবোর ব্যবহার না করার বিষয়টি নেওয়া যায়। ১৪১৫ সালে ইংরেজ লংবোম্যানরা আজিঙ্কুরের যুদ্ধে সংখ্যায় বড় ফরাসি বাহিনীকে সহজেই হারিয়েছিল। এর আগে ক্রেসির যুদ্ধে একই কৌশল কাজ করেছিল। লংবো শিখতে কঠিন হলেও এক দক্ষ তীরন্দাজ ছয়টি তীর ছুঁড়তে পারত, যেখানে ক্রসবোম্যান ছুঁড়ত মাত্র একটি।
ইংল্যান্ডে রাজারা পুরুষদের নিয়মিত তীর ধনুক চালনা শিখতে বাধ্য করত। কিন্তু ফ্রান্সে রাজারা তীর ধনুককে নিরুৎসাহিত করত। ওয়েলডন বলছেন, এতে কোনো উন্মাদনা ছিল না। বরং এটি ছিল রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা। ফ্রান্সে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ছিল কম। রাজারা চাইত না গ্রামীণ কৃষকদের হাতে এমন অস্ত্র থাকুক যা দিয়ে তারা অশ্বারোহী অভিজাতদের হত্যা করতে পারে। ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্র তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ছিল, তাই তারা এমন অস্ত্র ব্যবহার করত যা বিদেশি যুদ্ধ জেতায় সাহায্য করবে।
সমুদ্র ডাকাতদের প্রণোদনা
১৮ শতকের সমুদ্র ডাকাতরাও যুদ্ধ এড়াতে চাইত। যুদ্ধ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল এবং শিকার জাহাজটি ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি থাকত। তাই তারা হুমকি দিত ক্রুদের হত্যা করার, কিন্তু যারা আত্মসমর্পণ করত, তাদের ছেড়ে দিত। ভাষার পার্থক্য সত্ত্বেও এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে তারা ‘জলি রজার’ পতাকা ব্যবহার করত—একটি কার্যকর আন্তর্জাতিক প্রতীক।
বীরত্বের গল্প বনাম বাস্তব কারণ
জনপ্রিয় ধারণায় বিজয় আসে জাতির সাহস আর দক্ষতার কারণে। ওয়েলডন এর চেয়ে বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা দেন।
উদাহরণ হিসেবে ভাইকিংদের কথা বলা যায়। তারা “বার্সার্ক” হয়ে নগ্ন অবস্থায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে জয়লাভ করত—এ ধারণা মিথ। তাদের আসল সুবিধা ছিল দুটি। প্রথমত, তারা খ্রিস্টান ছিল না, তাই চার্চের ধনসম্পদ লুটে নিতে তাদের কোনো দ্বিধা ছিল না। দ্বিতীয়ত, ভাইকিং লংবোট ছিল সেই সময়ের ‘স্টেলথ ফাইটার’। সাধারণ জাহাজ বাতাসের ওপর নির্ভর করে উপকূলে নামত এবং লক্ষ্যবস্তুর দিকে এগোতে অনেক সময় লাগত, ফলে শিকার পালিয়ে যেত। লংবোট বাতাস ও বৈঠা দুই-ই ব্যবহার করে গোপনে এগিয়ে আসত। ফলে একটি মঠের হাতে মাত্র কয়েক ঘণ্টার সতর্কবার্তা থাকত।
মঙ্গলদের সাফল্যের পেছনে প্রণোদনা
মঙ্গল বাহিনীর বিজয়কে অনেকেই তাদের অশ্বারোহী দক্ষতার কৃতিত্ব দেন। আসলে আরও বড় কারণ ছিল রসদ সরবরাহ। ১৩০০ সালের দিকে মঙ্গল সাম্রাজ্যের হাতে বিশ্বের অর্ধেক ঘোড়া ছিল। এক একজন যোদ্ধার জন্য ২০টি ঘোড়া থাকত। ফলে তারা দিনে ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার অতিক্রম করতে পারত, যেখানে শত্রুরা পারত মাত্র ১০ কিলোমিটার। ওয়েলডনের মতে, চীন থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বাণিজ্যকে উৎসাহ দিয়ে জেনগিস খান ছিলেন ‘গ্লোবালাইজেশনের জনক’।
ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সাফল্য
১৮ শতকের শেষ ও ১৯ শতকের শুরুর দিকে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি সমুদ্র শাসন করত। ১৭৯৩ থেকে ১৮১৫ সালের মধ্যে তারা শত্রুর ৭টি জাহাজ ধ্বংস বা দখল করত প্রতি ১টি হারানোর বিনিময়ে। বড় যুদ্ধজাহাজের ক্ষেত্রে এই অনুপাত ছিল ১ : ৩৩। এর কারণ ছিল না যে ব্রিটিশ নাবিকরা ফরাসিদের চেয়ে সাহসী ছিল। বরং প্রণোদনার পার্থক্য ছিল। ফরাসি ক্যাপ্টেনরা আত্মসমর্পণ করলে মৃত্যুদণ্ডের আশঙ্কা করত, তাই তারা যুদ্ধ এড়াত। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেনরা দখল করা জাহাজের মূল্যের বড় অংশ পেত, ফলে তারা আরও আগ্রাসী ছিল।
ভুল বিশ্লেষণ এবং বাস্তব প্রণোদনা
যুদ্ধ বোঝার ক্ষেত্রে অর্থনীতি একটি কার্যকর হাতিয়ার। তবে অর্থনীতিবিদরাও কখনো ভুল করে। ওয়াল্ট রোস্টো, যিনি প্রেসিডেন্ট জনসনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন, বিশ্বাস করতেন উত্তর ভিয়েতনামের শিল্প অবকাঠামো ধ্বংস করলেই যুদ্ধ জেতা যাবে। কিন্তু হো চি মিনের প্রণোদনা ছিল দেশকে একত্রীকরণ, সেতু-ফ্যাক্টরি বাঁচানো নয়। আর আমেরিকা যত বেশি বোমা ফেলত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন তত বেশি সাহায্য করত।
অদৃশ্য হাত এবং নেতার স্বার্থ
ওয়েলডন বিভিন্ন যুদ্ধের পেছনে ‘অদৃশ্য হাতের’ প্রভাব খুঁজে বের করেছেন। তবে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব উপেক্ষা করেছেন তা হলো পাবলিক চয়েস থিওরি। নোবেল বিজয়ী জেমস বুচানান দেখিয়েছেন, অনেক নীতি তৈরি হয় জনগণের জন্য নয়, বরং স্বার্থান্বেষী নীতিনির্ধারকদের লাভের জন্য।
উদাহরণ হিসেবে ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণ। রাশিয়ার জন্য এটি লাভজনক নয়। এতে প্রায় ১০ লাখ রুশ নিহত হয়েছে এবং রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বের কাছে একঘরে হয়েছে, চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। পুতিন এটা করেছেন ব্যক্তিগত খ্যাতির জন্য। যুদ্ধ তাকে দেশপ্রেম উস্কে দিয়ে সমালোচক দমনে সুবিধা দিয়েছে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, খারাপ নেতার যোগান প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। তাই যুদ্ধ চলতেই থাকবে। অর্থনীতির এই নির্দয় বিশ্লেষণও আমাদের এ ধরনের কঠিন সত্যের মুখোমুখি করে।