একটি অমর ‘জম্বি’ ফ্র্যাঞ্চাইজির নতুন অধ্যায়
ড্যানি বয়েলের নতুন ছবি ২৮ ইয়ার্স লেটার এমন এক দুনিয়ার গল্প বলে যেখানে মৃত্যু সর্বত্র উপস্থিত, কিন্তু সেই মৃত্যু আমাদের সহানুভূতিও জাগায়। ছবির কেন্দ্রবিন্দুতে আছে একটি ভয়ংকর স্মৃতিসৌধ—মাথার খুলি দিয়ে তৈরি এক টাওয়ার। এর রক্ষণাবেক্ষক ডা. ইয়ান কেলসন (রাল্ফ ফাইনস), যিনি একসময় ডাক্তার ছিলেন, এখন এক অদ্ভুত নির্জন সন্ন্যাসীর মতো ব্রিটেনের জম্বি-দখলদার জগতের মাঝে বেঁচে আছেন।
যখন কেউ মারা যায়, কেলসন তার ত্বক পুড়িয়ে খুলিকে পালিশ করে টাওয়ারে রাখেন। প্রতিটি খুলি যেন একটি চিন্তার স্মারক। কেলসন বলেন, “এই চোখগুলো দেখেছে, এই চোয়ালগুলো খেয়েছে।” অনেকে তাকে পাগল ভাবে। তবে এমন দুনিয়ায় মানবিকতা বাঁচিয়ে রাখতে গেলে হয়তো খানিকটা পাগল হতে হয়ই।
মূল চলচ্চিত্রের ঐতিহ্য
২০০২ সালের ২৮ ডেজ লেটার কেবল জম্বি সিনেমা ছিল না। ‘রেজ ভাইরাস’-এ আক্রান্তরা ছায়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকত, হঠাৎ বের হয়ে মানুষের চরম আচরণ উসকে দিত। বয়েল আর গারল্যান্ড আসলে দেখাতে চেয়েছিলেন—মানব সভ্যতা ধ্বংস হলে মানুষেরা কেমন করে নিজেদের রূপ বদলায়। ছবিটি ৯/১১ পরবর্তী ভয়ের প্রেক্ষাপটে কম খরচের ডিজিটাল ক্যামেরায় শুট হয়ে এক প্রকার ভয়ানক সতর্কবার্তা হয়ে উঠেছিল—মাত্র ২৮ দিনেই সমাজ ভেঙে পড়তে পারে।
২০০৭ সালের ২৮ উইকস লেটার ছিল আরও ধরনের জম্বি সিনেমা। সেটি মার্কিন সেনা-অধিকৃত লন্ডনে তৈরি, তখন চলছিল ‘ফরেভার ওয়ার্স’। শেষ দৃশ্যে জম্বিরা প্যারিসে ঢুকে পড়েছিল, তবে নতুন কাহিনিতে সেই বিপদ নিয়ন্ত্রণে আছে—ব্রিটেন এখন কোয়ারান্টাইনে। একে বলা চলে এক রকম জোরপূর্বক ব্রেক্সিট।
বিচ্ছিন্ন দ্বীপের সমাজ
নতুন ছবির গল্প শুরু এক দ্বীপ গ্রামে। মূল ভূখণ্ডে জম্বি-উত্তর দুনিয়া থেকে আলাদা, জোয়ারে ডুবে থাকা এক দীর্ঘ বাঁধের ওপারে। সেন্ট জর্জের ক্রসের ছেঁড়া পতাকার নিচে তারা আবার সমাজ গড়ে তুলেছে। কৃষি, মাছ ধরা, অস্ত্র বানানো আর একসাথে গান গাওয়া (যেমন টম জোন্সের “ডেলাইলা”)—সবই চালু আছে। তবে যেকোনো বাইরের হুমকির বিরুদ্ধে তারা সদা প্রস্তুত।
গ্রামের লোকেরা মাঝে মাঝে মূল ভূখণ্ডে যায়। গল্পের নায়ক, ১২ বছরের স্পাইক (আলফি উইলিয়ামস), তার বাবা জেমির (অ্যারন টেলর-জনসন) সঙ্গে প্রথম জম্বি শিকারে যায়। গ্রামবাসীর উল্লাসে বয়েল ছবিতে ক্লাসিক চিত্রকর্মের টুকরো আর লরেন্স অলিভিয়েরের হেনরি পঞ্চম (১৯৪৪) সিনেমার ফুটেজ ঢুকিয়ে দেন—যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ মনোবল, চাঙা করার এক স্মৃতি।
জম্বিদের রূপবদল
এবারের গল্প আগের দুই ছবির কয়েক দশক পরে। সংক্রমিতদের অনেকেই বিকৃত বা অবনত হয়েছে। কেউ মোটা, অলস, কেঁচো খায়—তাদের মারা সহজ। আবার পরিচিত দ্রুতগতির সংক্রমিতরাও আছে। সবচেয়ে ভয়ংকর ‘আলফা’ শ্রেণি—যারা শুধু কামড়ায় না, শিকারির মেরুদণ্ড টেনে বের করে ফেলে।
ভয়ের এই গল্প আসলে রূপক
জম্বি গল্পে সব সময়ই ছিল রূপক শক্তি—সংক্রমিত বাইরেরদের হাত ধরে প্রিয়জনও অচিন্তনীয় হিংস্রতায় পরিণত হয়। ২০০২-এর পর বয়েল আর পল ডব্লিউ এস অ্যান্ডারসনের “রেসিডেন্ট ইভিল” এই ধারা ফিরিয়ে আনে। তারপর জম্বি গল্প বড় ব্যবসা হলেও, রূপকটা হারায়নি।
২৮ ইয়ার্স লেটার সেই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখে। এর শোকাবহ স্মৃতিসৌধগুলো শুধু অতিমারির দীর্ঘ ছায়া নয়, আমাদের ফোনের স্ক্রিনে ভেসে থাকা অবিরাম সহিংসতার ছবির কথাও মনে করায়—যা আমরা অভ্যস্ত, হয়ে এড়িয়ে যাই। এক ধুলো-মাটি-লাগা, মগ্ন রাল্ফ ফাইনস যখন খুলিগুলো পালিশ করেন, তখন মনে হয় এগুলো কেবল দানবের নয়—মানুষের মুখ।
সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা
সবাই এই সিনেমা পছন্দ করবে না। অনেকেই একে অদ্ভুত, বিষণ্ণ, অসম্পূর্ণ মনে করবে। এটা নাকি একটি পরিকল্পিত ট্রিলজির প্রথম পর্ব। তাই অনেক ‘টু বি কন্টিনিউড’ ধাঁচের রহস্য, অসমাপ্ত চরিত্র, আর একেবারে অদ্ভুত একটি শেষ দৃশ্য রেখেছে। গল্পের কাঠামো অনেকখানি সেটআপে, কম রিটার্নে।
হরর ও অ্যাকশন ক্লিশে ব্যবহার করে গতি আনার চেষ্টা আছে, কিন্তু গল্পটা খানিকটা বিচ্ছিন্ন চিন্তার সমষ্টি হয়ে গেছে। রাল্ফ ফাইনস আর টেলর-জনসনের অভিনয় যত ভালোই হোক, ছবিটা ঠিক এককথায় ধরা যায় না। হয়তো সব শেষে এটার অর্থ ধরা পড়বে। বা হয়তো এটাকে এমনই হতে বলা হয়েছে—আমাদের সময়ের মতো বিভ্রান্ত আর বিক্ষিপ্ত।
শেষ পর্যন্ত ২৮ ইয়ার্স লেটার অগোছালো, অদ্ভুত, সব সময় বিশ্বাস যোগ্য নয়। কিন্তু এটাকে সহজে ভোলা যাবে না।