০৩:১৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫
ঘূর্ণিঝড় দিত্বাহর ধ্বংসযজ্ঞের পর শ্রীলঙ্কার পাশে বিশ্বব্যাংক গ্রুপ চীনা ঐতিহ্যেই ব্র্যান্ডের নতুন গল্প, বদলাচ্ছে বিপণনের ভাষা দুর্যোগের আগেই পাশে দাঁড়ায় যে মানবতার শক্তি, মালয়েশিয়ায় ইউনাইটেড শিখসের নীরব সেবা থাইল্যান্ড-কাম্বোডিয়া সীমান্তে উত্তেজনা থামাতে কুয়ালালামপুর বৈঠকের দিকে তাকিয়ে জাপানের পারমাণবিক প্রত্যাবর্তন ফুকুশিমার পনেরো বছর পর আবার চালু হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম কেন্দ্র প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আঘাত: মাইকেল মিলার দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে ‘হিন্দু চরমপন্থীদের’ বিক্ষোভ – কী ঘটেছিল ১১ মাসে মাত্র ২৫ দিন ক্লাসে উপস্থিত: পরীক্ষার অযোগ্য ঘোষণায় শিক্ষককে হাতুড়ি দিয়ে মারধর বিএনপি কার্যালয়ে হামলার অভিযোগ, আহত চার নেতা-কর্মী পত্রিকা অফিসে হামলার আগাম গোয়েন্দা তথ্য ছিল, তবু গুরুত্ব দেওয়া হয়নি: সালাহউদ্দিন আহমদ

আন্তর্জাতিক পরিসরেও শক্তিশালী অভিনেত্রী ববিতা

শৈশব ও পরিবার

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়িকা ববিতা ১৯৫৩ সালে যশোর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম ফেরদৌসী রহমান ববিতা। ববিতার পরিবার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছিল – তার বড় বোন সুচন্দা এবং ছোট বোন চম্পা দুজনেই বিখ্যাত অভিনেত্রী। বাবার সরকারি চাকরির সূত্রে শৈশবে বিভিন্ন জেলায় বসবাস করেছেন। মা ছিলেন সাংস্কৃতিক রুচিসম্পন্ন, যিনি শিশুদের গান, কবিতা আর অভিনয়ের প্রতি উৎসাহ দিতেন। এই পরিবারে বড় হওয়া ববিতার জন্য অভিনয় ছিল খুব স্বাভাবিক একটি গন্তব্য।

চলচ্চিত্রে আগমন

ববিতার চলচ্চিত্রে প্রবেশ ঘটে ১৯৬৭ সালে শিশুশিল্পী হিসেবে। তবে নায়িকা হিসেবে তিনি প্রথম বড় সুযোগ পান জহির রায়হানের বিখ্যাত ছবি জলছবি (১৯৬৯)-তে। এরপর থেকেই তিনি বাংলা সিনেমায় ধীরে ধীরে নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করেন। তার সৌন্দর্য, বাচনভঙ্গি এবং অভিনয়ের গভীরতা দর্শকদের মন জয় করে নেয়।

‘অশনি সংকেত’–আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

ববিতার অভিনয়জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় সত্যজিৎ রায়ের অশনি সংকেত (১৯৭৩) ছবিতে তার অভিনয়। তিনি সেখানে গঙ্গা চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি অর্জন করেন। এই ছবি বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির স্বীকৃতি পায়। ববিতার জন্য এটি ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বদরবারে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার বিরল সুযোগ।

স্বর্ণযুগের নায়িকা

১৯৭০ এবং ৮০-এর দশকে ববিতা ছিলেন বাংলা বাণিজ্যিক ছবির অবিসংবাদিত রানী। শিবলি সাদিক, আজিজুর রহমান, আলমগীর কবির, দেওয়ান নজরুল প্রমুখ পরিচালকের ছবিতে তিনি জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। ‘নয়নমণি’, ‘বসুন্ধরা’, ‘আলোর মিছিল’, ‘নতুন সুর’, ‘শিমুলপারুল’ প্রভৃতি ছবিতে তার চরিত্রগুলো আজও দর্শকের মনে গেঁথে আছে।

সমকালীন নায়কদের সঙ্গে রসায়ন

ববিতা ছিলেন নায়ক রাজ রাজ্জাকের অন্যতম সফল জুটি। রাজ্জাক–ববিতা জুটি বাংলা সিনেমার রোমান্টিক ধারার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এছাড়া ফারুক, আলমগীর, সোহেল রানার সঙ্গেও তার বহু সফল ছবি আছে। সেসব ছবিতে রোমান্টিক, সামাজিক, পারিবারিক সব ধরনের চরিত্রে তার সহজাত অভিনয় দর্শককে মুগ্ধ করত।

চরিত্রাভিনয়ে দক্ষতা

বাণিজ্যিক ছবির গ্ল্যামার ছাড়াও ববিতা ছিলেন শক্তিশালী চরিত্রাভিনেত্রী। ‘বসুন্ধরা’ ছবিতে নারী স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার লড়াই, ‘নয়নমণি’-তে গ্রামীণ নারীর জীবনসংগ্রাম, ‘আলোর মিছিল’-এ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দেশের প্রতি প্রেম – এসব ছবিতে তিনি গভীর আবেগ এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অভিনয় করেন।

জাতীয় পুরস্কার ও সম্মাননা

ববিতা বহুবার বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন। ‘নয়নমণি’, ‘বসুন্ধরা’, ‘শিমুলপারুল’, ‘রামের সুমতি’, ‘স্বয়ংদেবী’ – এসব ছবির জন্য তিনি সেরা অভিনেত্রীর স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি একুশে পদকসহ আরও অনেক সম্মাননা পেয়েছেন যা তার দীর্ঘ ও সৃজনশীল ক্যারিয়ারের স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হয়।

আন্তর্জাতিক উপস্থিতি

ববিতা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ‘অশনি সংকেত’-এর সুবাদে তিনি বিশ্বের নানা চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিয়েছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের সিনেমা যখন বিদেশে প্রদর্শিত হয়েছে, তখনও তিনি ছিলেন প্রধান আকর্ষণ।

ব্যক্তিজীবন ও অবসর

ববিতা ব্যক্তিজীবনে কিছুটা অন্তর্মুখী। একমাত্র ছেলে অনিককে নিয়েই তার পরিবার। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে বেছে বেছে কিছু ছবি করেন। পরে ধীরে ধীরে রূপালি পর্দা থেকে সরে আসেন। তবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্রের সম্মাননা মঞ্চে তাকে এখনও দেখা যায়।

ববিতার অবদান ও উত্তরাধিকার

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ববিতার অবদান শুধু নায়িকা হিসেবে নয় – তিনি একসময়কার নারীপ্রধান চলচ্চিত্র ধারার বিকাশে অগ্রণী ছিলেন। তার অভিনয় দর্শককে শুধু বিনোদন নয়, ভাবনার খোরাকও জুগিয়েছে। নতুন প্রজন্মের অভিনেত্রীদের কাছে তিনি এখনও অনুপ্রেরণা।

কিংবদন্তি

ববিতা বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম। তার সৌন্দর্য, প্রতিভা, নিষ্ঠা আর অভিনয়ের বহুমাত্রিকতা তাকে কিংবদন্তি করে তুলেছে। বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের এই নায়িকা আজও আমাদের স্মৃতিতে জীবন্ত।

জনপ্রিয় সংবাদ

ঘূর্ণিঝড় দিত্বাহর ধ্বংসযজ্ঞের পর শ্রীলঙ্কার পাশে বিশ্বব্যাংক গ্রুপ

আন্তর্জাতিক পরিসরেও শক্তিশালী অভিনেত্রী ববিতা

১১:০০:৩৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫

শৈশব ও পরিবার

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়িকা ববিতা ১৯৫৩ সালে যশোর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম ফেরদৌসী রহমান ববিতা। ববিতার পরিবার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছিল – তার বড় বোন সুচন্দা এবং ছোট বোন চম্পা দুজনেই বিখ্যাত অভিনেত্রী। বাবার সরকারি চাকরির সূত্রে শৈশবে বিভিন্ন জেলায় বসবাস করেছেন। মা ছিলেন সাংস্কৃতিক রুচিসম্পন্ন, যিনি শিশুদের গান, কবিতা আর অভিনয়ের প্রতি উৎসাহ দিতেন। এই পরিবারে বড় হওয়া ববিতার জন্য অভিনয় ছিল খুব স্বাভাবিক একটি গন্তব্য।

চলচ্চিত্রে আগমন

ববিতার চলচ্চিত্রে প্রবেশ ঘটে ১৯৬৭ সালে শিশুশিল্পী হিসেবে। তবে নায়িকা হিসেবে তিনি প্রথম বড় সুযোগ পান জহির রায়হানের বিখ্যাত ছবি জলছবি (১৯৬৯)-তে। এরপর থেকেই তিনি বাংলা সিনেমায় ধীরে ধীরে নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করেন। তার সৌন্দর্য, বাচনভঙ্গি এবং অভিনয়ের গভীরতা দর্শকদের মন জয় করে নেয়।

‘অশনি সংকেত’–আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

ববিতার অভিনয়জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় সত্যজিৎ রায়ের অশনি সংকেত (১৯৭৩) ছবিতে তার অভিনয়। তিনি সেখানে গঙ্গা চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি অর্জন করেন। এই ছবি বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির স্বীকৃতি পায়। ববিতার জন্য এটি ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বদরবারে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার বিরল সুযোগ।

স্বর্ণযুগের নায়িকা

১৯৭০ এবং ৮০-এর দশকে ববিতা ছিলেন বাংলা বাণিজ্যিক ছবির অবিসংবাদিত রানী। শিবলি সাদিক, আজিজুর রহমান, আলমগীর কবির, দেওয়ান নজরুল প্রমুখ পরিচালকের ছবিতে তিনি জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। ‘নয়নমণি’, ‘বসুন্ধরা’, ‘আলোর মিছিল’, ‘নতুন সুর’, ‘শিমুলপারুল’ প্রভৃতি ছবিতে তার চরিত্রগুলো আজও দর্শকের মনে গেঁথে আছে।

সমকালীন নায়কদের সঙ্গে রসায়ন

ববিতা ছিলেন নায়ক রাজ রাজ্জাকের অন্যতম সফল জুটি। রাজ্জাক–ববিতা জুটি বাংলা সিনেমার রোমান্টিক ধারার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এছাড়া ফারুক, আলমগীর, সোহেল রানার সঙ্গেও তার বহু সফল ছবি আছে। সেসব ছবিতে রোমান্টিক, সামাজিক, পারিবারিক সব ধরনের চরিত্রে তার সহজাত অভিনয় দর্শককে মুগ্ধ করত।

চরিত্রাভিনয়ে দক্ষতা

বাণিজ্যিক ছবির গ্ল্যামার ছাড়াও ববিতা ছিলেন শক্তিশালী চরিত্রাভিনেত্রী। ‘বসুন্ধরা’ ছবিতে নারী স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার লড়াই, ‘নয়নমণি’-তে গ্রামীণ নারীর জীবনসংগ্রাম, ‘আলোর মিছিল’-এ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দেশের প্রতি প্রেম – এসব ছবিতে তিনি গভীর আবেগ এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অভিনয় করেন।

জাতীয় পুরস্কার ও সম্মাননা

ববিতা বহুবার বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন। ‘নয়নমণি’, ‘বসুন্ধরা’, ‘শিমুলপারুল’, ‘রামের সুমতি’, ‘স্বয়ংদেবী’ – এসব ছবির জন্য তিনি সেরা অভিনেত্রীর স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি একুশে পদকসহ আরও অনেক সম্মাননা পেয়েছেন যা তার দীর্ঘ ও সৃজনশীল ক্যারিয়ারের স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হয়।

আন্তর্জাতিক উপস্থিতি

ববিতা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ‘অশনি সংকেত’-এর সুবাদে তিনি বিশ্বের নানা চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিয়েছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের সিনেমা যখন বিদেশে প্রদর্শিত হয়েছে, তখনও তিনি ছিলেন প্রধান আকর্ষণ।

ব্যক্তিজীবন ও অবসর

ববিতা ব্যক্তিজীবনে কিছুটা অন্তর্মুখী। একমাত্র ছেলে অনিককে নিয়েই তার পরিবার। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে বেছে বেছে কিছু ছবি করেন। পরে ধীরে ধীরে রূপালি পর্দা থেকে সরে আসেন। তবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্রের সম্মাননা মঞ্চে তাকে এখনও দেখা যায়।

ববিতার অবদান ও উত্তরাধিকার

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ববিতার অবদান শুধু নায়িকা হিসেবে নয় – তিনি একসময়কার নারীপ্রধান চলচ্চিত্র ধারার বিকাশে অগ্রণী ছিলেন। তার অভিনয় দর্শককে শুধু বিনোদন নয়, ভাবনার খোরাকও জুগিয়েছে। নতুন প্রজন্মের অভিনেত্রীদের কাছে তিনি এখনও অনুপ্রেরণা।

কিংবদন্তি

ববিতা বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম। তার সৌন্দর্য, প্রতিভা, নিষ্ঠা আর অভিনয়ের বহুমাত্রিকতা তাকে কিংবদন্তি করে তুলেছে। বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের এই নায়িকা আজও আমাদের স্মৃতিতে জীবন্ত।