পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাচীন পরিচয়
চার শতাধিক বছরের ইতিহাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম (চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টস) ছিল একটি স্বতন্ত্র ভূগোল ও সংস্কৃতির জনপদ। তিনটি জেলা – রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান – নিয়ে গঠিত এই অঞ্চল পাহাড়-পর্বত, অরণ্য, নদী-ঝর্ণায় সমৃদ্ধ।
চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, খিয়াং, লুসাই, বম, পাংখোয়া, তঞ্চঙ্গা সহ একাধিক জাতিগোষ্ঠী এখানে বাস করত। তাদের জীবনধারা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন – জুম চাষের উপর নির্ভরশীল, স্বনির্ভর, সমবায় নির্ভর সমাজব্যবস্থা, স্থানীয় শাসনব্যবস্থা (রাজা, হেডম্যান, কারবারি), এবং নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি ও আচার-অনুষ্ঠান।
প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীবনের সহাবস্থান
অঞ্চলটির প্রকৃতি ছিল বৈচিত্র্যময়। ঘন বন, পাহাড়ি নদী, ঝর্ণা ও জীববৈচিত্র্য এখানকার স্বাভাবিক রূপ। আদিবাসীরা এই প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সহাবস্থানে ছিল।
জুম চাষে পাহাড় কেটে সাময়িকভাবে জমি ব্যবহার করা হলেও পরবর্তী কয়েক বছর সেই জমি পরিত্যক্ত করে বনকে পুনরুজ্জীবিত হতে দেওয়া হতো। এতে মাটির উর্বরতা, জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় থাকত।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামলে প্রশাসনিক রূপান্তর
ব্রিটিশ শাসনে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়াল এই অঞ্চলকে “সংরক্ষিত” হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। সমতল থেকে অভিবাসন রোধ, জমি বিক্রি সীমিতকরণ, এবং শাসনব্যবস্থায় রাজার ক্ষমতা স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু পাকিস্তান আমলে এই নীতিতে পরিবর্তন আসে। ১৯৪৭–৫৯ সময়ে পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে “পিছিয়ে পড়া” অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ কাপ্তাই বাঁধ ও লেক।
কাপ্তাই বাঁধ ও লেক সৃষ্টির ধ্বংসাত্মক প্রভাব
১৯৫৭–৬২ সালে কর্ণফুলী নদীর ওপর কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয় কাপ্তাই লেক – দেশের সবচেয়ে বড় কৃত্রিম জলাধার।
এই লেক প্রায় ৫৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ডুবিয়ে দেয়। প্রায় ১৮ হাজার পরিবার (আনুমানিক ১ লক্ষ মানুষ) বাস্তুচ্যুত হয়। হাজার হাজার একর জমি – চাষের, বসতির, বনভূমি – স্থায়ীভাবে জলের নিচে চলে যায়।
কাপ্তাই বাঁধ প্রকল্পে স্থানীয়দের মতামত নেওয়া হয়নি। ক্ষতিপূরণও প্রায় কেউ পায়নি। এই গণ বাস্তুচ্যুতি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামাজিক বিপর্যয়।
সমতল থেকে বাঙালি বসতি স্থাপন: সাংস্কৃতিক ও সামাজিক টানাপোড়েন
স্বাধীনতার পর ১৯৭০–৯০ দশকে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিকল্পিত বাঙালি পুনর্বাসন কর্মসূচি চালায়। লক্ষাধিক বাঙালি পরিবারকে সমতল থেকে এনে পাহাড়ে পুনর্বাসিত করা হয়।
ফলাফল হয় জমি-দখল নিয়ে বিরোধ, সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনের রূপান্তর। পাহাড়ি জনগণ জমি হারায়, জীবিকা হারায়, গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা ভেঙে যায়।
এতে পাহাড়িদের জীবনে ভয়াবহ সামাজিক বৈষম্য তৈরি হয়। নতুন বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের সাথে সংঘাত, বৈরিতা, অবিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষয় ও বনাঞ্চল নিধন
কাপ্তাই লেক তৈরির পর এবং বাঙালি পুনর্বাসনের পরে পাহাড়ে দ্রুত বনাঞ্চল উজাড় হয়। বনজ সম্পদ বাণিজ্যিকভাবে আহরণ শুরু হয়।
সড়ক, বাজার, নগরায়ণ – উন্নয়নের নামে পাহাড়ের প্রকৃতি বদলে যায়। পাহাড়ি নদী-ঝর্ণা শুকিয়ে যেতে থাকে, জুম চাষের জমি কমতে থাকে। এতে জীববৈচিত্র্যও বিপন্ন হয়।
সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবিকা পরিবর্তন
যেখানে একসময় পাহাড়িরা স্বনির্ভর, সমবায় নির্ভর কৃষি সমাজ গড়ে তুলেছিল, সেখানে এখন বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং নগরাধারিত জীবিকার ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে।
অনেকেই পার্বত্য জেলা সদর বা চট্টগ্রামে গিয়ে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী হয়ে গেছে। কিছু পরিবার পর্যটন বা স্থানীয় ব্যবসার সাথে যুক্ত হলেও বৈষম্য রয়ে গেছে।
শান্তি চুক্তি ও চলমান বাস্তবতা
১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে দীর্ঘকালীন সশস্ত্র সংঘাতের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয়। চুক্তিতে স্বায়ত্তশাসন, ভূমি কমিশন এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি ছিল।
কিন্তু অনেকাংশেই এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি বলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অভিযোগ। ভূমি বিরোধ, নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন – এগুলো এখনও রয়ে গেছে।
রূপান্তরের দায় ও টেকসই ভবিষ্যতের ভাবনা
চার শতাব্দীর পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে সর্বাধিক রূপান্তর এসেছে গত ৬–৭ দশকে। কাপ্তাই লেক, পরিকল্পিত অভিবাসন এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পাহাড়ের স্বকীয়তা বদলে দিয়েছে।
আদিবাসীদের ভাষা-সংস্কৃতি, সামাজিক কাঠামো এবং জীবিকার ভিত্তি নষ্ট হয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে অপরিমেয়।
যতক্ষণ পর্যন্ত টেকসই উন্নয়ন, ভূমি-অধিকার, সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি এবং পরিবেশ সংরক্ষণকে সমন্বিতভাবে ভাবা না হয়, ততক্ষণ এই পরিবর্তন পাহাড়িদের জন্য ক্ষতিসাধন করেই যাবে।