করোনাভাইরাস মহামারীর প্রারম্ভে, ২০১৯–২০ সালে বাংলাদেশে যখন লকডাউন ও সামাজিক দূরত্বের ব্যবস্থা জোরদার করা হয়, তখন অনলাইন বিতরণ ও হোম ডেলিভারি সেবার চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। রেস্টুরেন্টগুলো ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় শহরে কেবল হোম ডেলিভারির উপর নির্ভর করতে শুরু করে। পাশাপাশি, ফুডপান্ডা, পাঠাও, শেহজাদ, হাংরীনাকি এবং ই-ফুডের মতো প্ল্যাটফর্মে অর্ডারের পরিমাণও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেড়েছে।
ই-কমার্সের চোখে পড়ার মতো প্রবৃদ্ধি ঘটে। করোনার কারণে দোকানপাট বন্ধ হওয়া ও কঠোর লকডাউনের ফলে ই-কমার্স সাইটগুলোতে কেনাকাটার প্রবণতা বেড়ে যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে পণ্য সংগ্রহ ও ডেলিভারিতে সমস্যা থাকলেও সময়ের সঙ্গে তা ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হয়। ফেসবুক-ভিত্তিক প্রায় ৪০০ ধরনের অনলাইন ব্যবসা নিয়ে একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে খরচ, সরবরাহ চেইনের বিঘ্ন, লজিস্টিক সংকট এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অনলাইন ব্যবসাগুলো উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক রিপোর্টগুলোতেও দেখা যায় যে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত দ্রুত বিকশিত হচ্ছে এবং ২০২০–২০২১ সালের মধ্যে অনেক সংখ্যক দোকানও অনলাইনে যুক্ত হয়েছে।
তবে গত ছয় মাসে কিছু উল্লেখযোগ্য বিপর্যয় লক্ষ করা যাচ্ছে। বিভিন্ন অনলাইন ব্যবসা ও লজিস্টিক অফিস বন্ধ হচ্ছে বা সীমিত আকারে পরিচালিত হচ্ছে। ই-কমার্সে পঞ্জি প্রকৃতির প্রতারণামূলক মডেলের অন্তর্ভুক্তি এবং সরকারের কঠোর নির্দেশনার প্রভাবে কিছু প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে ধসে পড়েছে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে দেশজুড়ে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের ফলে অনলাইন ব্যবসার কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া, সরবরাহ ও ভর্তুকি সংকট দেখা দিয়েছে। লজিস্টিক কর্মীদের গ্রামের দিকে চলে যাওয়া, তেল ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া – এসব কারণে হোম ডেলিভারির খরচ বৃদ্ধি পেয়ে আর্থিক চাপ তৈরি হয়েছে।
মূল কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়:
১. চাহিদা–সরবরাহের মিশ্র পর্যায়: মহামারীর পরিস্থিতি পরিবর্তনের ফলে সরবরাহ চেইনে পুনরায় বাধা সৃষ্টি হয়েছে।
২. অপ্রতিরোধ্য খরচ বৃদ্ধি: কমিশন, ফি এবং লজিস্টিক খরচের কারণে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসইতা হারাচ্ছে।
৩. নিয়ন্ত্রিত অঙ্গীকার ও অনিয়ম: অসৎ উপায়ে অতিরিক্ত আয়ের চেষ্টা এবং অনিয়মিত কার্যক্রমের ফলে কিছু প্ল্যাটফর্ম বন্ধ হয়ে সংকটের পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
৪. নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসনিক বাধা: ইন্টারনেট বন্ধসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদক্ষেপ ব্যবসায় অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
সামগ্রিকভাবে দেখা যায়, ২০২০–২০২১ সালে অনলাইনে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যার জন্য প্রয়োজন রেগুলেটরি উন্নয়ন ও মান নিয়ন্ত্রণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়া ও বাধা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের সমন্বিত সমাধান। গ্রাহকের আস্থা বজায় রাখতে কমিশন ও শর্তভিত্তিক চুক্তিতে স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো জরুরি।
উপসংহারে বলা যায়, বাংলাদেশে গত ছয় বছরে অনলাইন ব্যবসা ও হোম ডেলিভারির পরিসর যথেষ্ট বেড়েছে। তবে সাম্প্রতিক ছয় মাসে নানা শঙ্কাজনক ঘটনা যেমন প্রশাসনিক বাধা, আর্থিক চাপ এবং অসদাচরণের কারণে কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। তবুও সামগ্রিকভাবে অনলাইন সেবা বাংলাদেশের জন্য প্রযুক্তিগতভাবে এবং চাহিদার দিক থেকে এখনও শক্তিশালী। এ প্রেক্ষাপটে সরকারি নীতি, স্বচ্ছ নিয়ন্ত্রণ এবং লজিস্টিক সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে একটি টেকসই ই-কমার্স পরিবেশ গড়ে তোলা বাঞ্ছনীয়।
সুপারিশসমূহ:
- সরকারের পক্ষ থেকে স্থিতিশীল ও দীর্ঘমেয়াদি ইন্টারনেট নীতি প্রণয়ন করা
- কমিশন-নিয়ন্ত্রিত চুক্তি পর্যালোচনা এবং প্রতারণামুক্ত নীতি প্রবর্তন
- ডেলিভারি ও লজিস্টিক খাতে বিনিয়োগ ও প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি
- ভোক্তা সুরক্ষা আইন ও তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা