যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বাণিজ্য আলোচনা ব্যর্থ: শুল্ক নিয়ে সমঝোতা হয়নি
যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদলের মধ্যে সাম্প্রতিক বৈঠকে ৩৫ শতাংশ শুল্ক ইস্যুতে কোনো সমঝোতা হয়নি। ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে আরোপিত এই শুল্ককে বাংলাদেশ “অযৌক্তিক এবং শাস্তিমূলক” আখ্যা দিলেও মার্কিন পক্ষ এটিকে সরানোর কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
রয়টার্স, ব্লুমবার্গ এবং ফাইনানশিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আলোচনায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে এই শুল্ক উন্নয়নশীল দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে এবং জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দেওয়ারও দাবি তুলেছে। তবে মার্কিন পক্ষ স্পষ্ট করে বলেছে যে “আমেরিকান শ্রমিক ও শিল্পের সুরক্ষাই” তাদের প্রধান অগ্রাধিকার।
ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি: শাস্তিমূলক বা প্রতিযোগিতা রক্ষা?
ট্রাম্প প্রশাসন ২০১৯–২০২০ সালে বাংলাদেশি গার্মেন্টসের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে এবং পরবর্তীতে আরও ৩৫ শতাংশ শুল্কের প্রস্তাব আনে, যা ২০২৫ সালের শুরুর দিকে কার্যকর হতে পারে।
আমেরিকান থিঙ্ক ট্যাঙ্ক “Peterson Institute for International Economics (PIIE)” বলছে, ট্রাম্পের শুল্কনীতির লক্ষ্য চীনা ও অন্যান্য সস্তা উৎপাদকদের বাজার থেকে সরিয়ে আমেরিকান উৎপাদন বাড়ানো। কিন্তু এতে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত বা নিম্নমধ্য আয়ের দেশও শিকার হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক, IMF এবং OECD-এর বিশ্লেষণ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্কনীতি বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে দিতে পারে এবং দক্ষিণ এশিয়ার রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে।
অর্ডার বাতিল ও স্থগিত: বাংলাদেশের কারখানায় তীব্র প্রভাব
ফাইনানশিয়াল টাইমস ও ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্কিন খুচরা ব্র্যান্ডগুলো ইতিমধ্যেই ২০২৫ সালের স্প্রিং এবং সামার কালেকশনের বেশ কিছু অর্ডার বাতিল বা স্থগিত করেছে। বড় বড় মার্কিন খুচরা চেইন যেমন Walmart, Target এবং GAP, শুল্ক বৃদ্ধি এড়াতে উৎপাদন অন্য দেশে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
Bangladesh Garment Manufacturers and Exporters Association (BGMEA)-এর তথ্য উদ্ধৃত করে Reuters বলছে, বাংলাদেশের প্রায় ২০ শতাংশ রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রমুখী। এই বাজারে অর্ডার হ্রাস মানে হাজার হাজার শ্রমিকের চাকরি ঝুঁকিতে পড়বে।
আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষকের মন্তব্য
Moody’s Analytics: বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত যদি ৫০ শতাংশ শুল্কের মুখে পড়ে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ৬০–৭০ শতাংশ শেয়ার হারাতে পারে।
World Bank: এই শুল্ক বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ২–৩ শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে দিতে পারে এবং টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগে ভাটা পড়বে।
McKinsey Global Institute: সরবরাহ শৃঙ্খল পুনর্গঠন (reshoring / near-shoring) প্রক্রিয়া আরও জোরদার হলে বাংলাদেশি পোশাক প্রস্তুতকারকরা আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার নতুন প্রতিযোগীর মুখে পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতা ও স্থানচ্যুতি ঝুঁকি
শুল্ক বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ভিয়েতনাম, মেক্সিকো এবং মধ্য আমেরিকার দেশগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় হারতে পারে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ Gary Hufbauer (PIIE) বলেছেন, “বাংলাদেশ ৫০ শতাংশ শুল্কের বোঝা নিয়ে আমেরিকায় প্রতিযোগিতা করতে পারবে না। আমেরিকার ব্র্যান্ডগুলো তাদের অর্ডার মেক্সিকো বা মধ্য আমেরিকায় সরিয়ে নেবে যেখানে শুল্কমুক্ত সুবিধা রয়েছে।”
বিশ্বব্যাপী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সতর্কবার্তা
OECD Trade Policy Paper: উচ্চ শুল্ক নীতির কারণে গ্লোবাল গার্মেন্ট সাপ্লাই চেইনে “টেকটনিক শিফট” হবে, যেখানে বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া ও শ্রীলঙ্কা বড় ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
IMF: স্বল্পোন্নত রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিতে এই ধরনের শুল্ক বৃদ্ধির ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমবে, কর্মসংস্থান কমবে এবং সামাজিক অস্থিরতা বাড়তে পারে।
ভবিষ্যৎ প্রক্ষেপণ: বাংলাদেশি গার্মেন্টসের জন্য কোন পথ?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি মোট শুল্ক প্রায় ৫০ শতাংশে গিয়ে ঠেকে (পূর্বের ১৫ শতাংশ এবং প্রস্তাবিত ৩৫ শতাংশ), তাহলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে রপ্তানি বাজারে টিকে থাকতে হলে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে:
- বাজার বৈচিত্র্য: ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান—এই বাজারে প্রবেশ ও শুল্কমুক্ত সুবিধা আরও বাড়ানো।
- মান উন্নয়ন: হাই-এন্ড পোশাক উৎপাদন করে নীচের দামের প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসা।
- যুক্তরাষ্ট্রে লবিং: মার্কিন কংগ্রেস ও প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতা চেষ্টা করা, যাতে শুল্ক মওকুফ বা হ্রাস পায়।
- গবেষণা ও প্রযুক্তি: উৎপাদন প্রক্রিয়া আধুনিক করে খরচ কমানো এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানো।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় সমঝোতা না হওয়ায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এক কঠিন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ হলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত মারাত্মক বিপদে পড়বে। বিশ্বখ্যাত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, এর প্রভাব শুধু রপ্তানি আয় নয়—মোট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং লাখ লাখ শ্রমিকের জীবিকায়ও পড়বে। এখন জরুরি হলো নীতিনির্ধারকদের কৌশলগত সিদ্ধান্ত, বাজার বৈচিত্র্য, এবং উন্নত উৎপাদনশীলতার দিকে মনোযোগ দেওয়া।