তেলের দাম বৃদ্ধির বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় ২ শতাংশ বেড়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি ধীরগতির মধ্যেও জ্বালানির চাহিদা কিছুটা শক্তিশালী থাকায় এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ কয়েকটি প্রধান তেল উৎপাদক অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এই বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওপেক ও রাশিয়ার পক্ষ থেকে সরবরাহ সীমিত রাখার নীতিও মূল্যবৃদ্ধি প্রলম্বিত করছে।
বাংলাদেশের আমদানি নির্ভরতা ও সরবরাহ শৃঙ্খল
বাংলাদেশ জ্বালানি, বিশেষ করে অপরিশোধিত তেল এবং পরিশোধিত জ্বালানি পণ্যের জন্য ব্যাপকভাবে আমদানিনির্ভর। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প ও পরিবহন খাতে তেলের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। বৈশ্বিক বাজারে দামের এই ২ শতাংশ বৃদ্ধি সরাসরি আমদানি ব্যয়ের ওপর চাপ তৈরি করবে। বাণিজ্য ভারসাম্যের ঘাটতি আরও বাড়ার আশঙ্কা থাকবে, কারণ সরকারকে বেশি দামে তেল কিনতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হবে।
মুদ্রার বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইতিমধ্যেই নানা কারণে চাপে রয়েছে। তেলের দাম বেড়ে গেলে সরকারের ওপর বছরে শত শত কোটি ডলারের অতিরিক্ত ব্যয়ের চাপ পড়বে। ফলে ডলার কিনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে খরচ বাড়বে, যা টাকার মানকে আরও দুর্বল করে তুলতে পারে। টাকার অবমূল্যায়ন আমদানি খরচ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে এবং তৈরি করতে পারে একটি নেতিবাচক চক্র।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর সম্ভাব্য প্রভাব
বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে প্রায়শই অভ্যন্তরীণ দামে সমন্বয় আনে। অতীতে দেখা গেছে, বৈশ্বিক বাজারে দাম বাড়লে দেশে ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন ও রান্নার গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে। এতে পরিবহন ব্যয় বাড়ে, যা সকল পণ্য ও সেবার দামে প্রভাব ফেলে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে।
শিল্প ও উৎপাদন খাতে সম্ভাব্য ঝুঁকি
তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি শিল্প খাতেও পড়বে। অনেক শিল্প ইউনিট লোডশেডিং বা গ্যাস সংকটের সময় ডিজেল-চালিত জেনারেটর ব্যবহার করে বিদ্যুৎ চালায়। তেলের দাম বাড়লে উৎপাদন খরচও বাড়বে, যা শিল্পপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে এবং রপ্তানিযোগ্য পণ্যের প্রতিযোগিতা কমিয়ে দিতে পারে। এতে পোশাক শিল্প, চামড়া শিল্পসহ অন্যান্য রপ্তানিমুখী খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ মানুষের কষ্ট
বিশ্ববাজারে তেলের দাম ২ শতাংশ বাড়া সামান্য মনে হলেও অর্থনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বাংলাদেশের জন্য এর প্রভাব হতে পারে গভীর। রিকশা-অটো, বাস, ট্রাকের ভাড়া বাড়তে পারে। নিত্যপণ্যের পরিবহন ব্যয় বাড়লে বাজারে শাকসবজি, চাল, ডাল, মাছ-মাংসসহ সব কিছুর দাম চড়া হবে। রান্নার গ্যাসের দাম বাড়লে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো আরও সমস্যায় পড়বে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ বর্তমানে একটি অনিশ্চিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা নীতিনির্ধারণে বিলম্ব বা অদূরদর্শিতা তৈরি করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার তেলের ভর্তুকি দেবে নাকি দাম বাড়াবে – এই সিদ্ধান্ত নিতে চাপের মধ্যে থাকবে। একদিকে জনগণের ক্ষোভ এড়াতে ভর্তুকি দিয়ে দাম স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা হতে পারে, অন্যদিকে এতে বাজেট ঘাটতি ও ঋণগ্রহণের চাপ বাড়িয়ে অর্থনীতি আরও দুর্বল করতে পারে।
বহুস্তরীয় প্রভাব
বিশ্ববাজারে তেলের দাম ২ শতাংশ বাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বহুস্তরীয় প্রভাব ফেলতে পারে – বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ, মুদ্রার মান দুর্বল হওয়া, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি, শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নীতিনির্ধারকরা দ্রুত ও দূরদর্শী সমাধান দিতে ব্যর্থ হলে এই ক্ষতি আরও গভীর হতে পারে। সুতরাং এখনই সাবধানী পরিকল্পনা ও বিকল্প জ্বালানি উৎসে বিনিয়োগের ওপর জোর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।