বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নীতি: তিন মাস পর ঋণ শ্রেণিবিন্যাস
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি একটি কঠোর নিয়ম চালু করেছে—যদি কোনো ব্যবসায়ী ধার করা অর্থের তিন মাসের সুদ পরিশোধ করতে না পারেন, তাহলে তার ঋণ ‘ক্লাসিফায়েড’ বা শ্রেণিবিন্যস্ত ঋণ হিসেবে বিবেচিত হবে। এর ফলে সেই ব্যবসায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ডিফল্টার’ হিসেবে চিহ্নিত হবেন এবং ভবিষ্যতে নতুন ঋণ পাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এই নিয়ম কঠোর করতে চেয়েছে ঋণখেলাপি প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং ব্যাংকিং খাতকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে। এর পক্ষে যুক্তি হল, খেলাপি ঋণ দেশের আর্থিক খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, ব্যাংকের পুঁজির ওপর চাপ ফেলে এবং সাধারণ মানুষের আমানতের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলে।
রপ্তানি খাতের বাস্তবতা: ১৮০ দিনের শর্ত
তবে রপ্তানিমুখী শিল্পখাতের উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, এই তিন মাসের সীমা তাদের বাস্তবতার সঙ্গে একেবারেই বেমানান। কারণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে রপ্তানি আদেশের শর্ত অনুযায়ী, অনেক ক্ষেত্রেই ক্রেতা ১৮০ দিনের মধ্যে (প্রায় ছয় মাসে) পণ্য নেয় এবং দাম মেটায়।
যদি একজন উদ্যোক্তা বিদেশে কাপড়, চামড়া বা অন্য কোনো শিল্পপণ্য রপ্তানি করেন, ক্রেতা ৩০ বা ৪৫ দিনের মধ্যে মূল্য দেন না, বরং ছয় মাস পর্যন্ত সময় নেন। ফলে রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত অর্থ আসতে দেরি হয়। এই সময়ে ব্যাংকের সুদ শিডিউল ঠিকমতো মেটানো উদ্যোক্তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
শিল্প উৎপাদনে প্রভাব: অনিশ্চয়তা ও মন্দা
নতুন নিয়ম কার্যকর হওয়ার পর অনেক উদ্যোক্তা ব্যাংক ঋণ পেতে সমস্যায় পড়েছেন। যেসব উদ্যোক্তার ঋণ ইতিমধ্যে ক্লাসিফায়েড হয়েছে, তারা কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন না, নতুন উৎপাদন চালু করতে পারছেন না।
ফলাফল হিসেবে দেশের গার্মেন্টস, চামড়া, প্লাস্টিক, সিরামিক, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ নানা খাতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কিছু কারখানা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে, কিছু কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়েছে। উৎপাদন ব্যাহত হলে রপ্তানি আদেশও বাতিল হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
করোনার সময়ের অভিজ্ঞতা: শিথিল নীতি দিয়েছিল সরকার
করোনাভাইরাস মহামারির সময় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক পরিস্থিতি বুঝে এই ঋণ শ্রেণিবিন্যাসের সময়সীমা শিথিল করেছিল। তখন ছয় মাস বা তার বেশি সময় ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে অনেক কারখানা বাঁচতে পেরেছিল, উৎপাদন চলেছিল, কর্মসংস্থানও টিকে ছিল।
সেই অভিজ্ঞতা থেকে ব্যবসায়ীদের দাবি, এখন যখন বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে, বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা, ক্রেতাদের অর্ডার কমছে, শুল্ক-অশুল্ক প্রতিবন্ধকতা বাড়ছে—তখন এই ধরনের কঠোর নিয়ম উৎপাদন ও রপ্তানি দুইয়ের জন্যই ক্ষতিকর।
ডলার সংকট ও বৈদেশিক বাণিজ্যের চাপ
বর্তমানে দেশের ডলার রিজার্ভ কমেছে। ব্যাংকগুলো পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা না থাকায় কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলায় সীমাবদ্ধতা দিচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এমনিতেই তারা কাঁচামাল আনতে বিলম্বিত এলসি পাচ্ছেন, ডলার সংকটে দাম বেশি দিতে হচ্ছে। এই অবস্থায় উৎপাদন চালু রাখতে ঋণ সহজ শর্তে প্রয়োজন।
কিন্তু তিন মাস পরপর সুদ না দিতে পারলে ‘ডিফল্টার’ হয়ে যাওয়ার ভয় নতুন বিনিয়োগকে রীতিমতো নিরুৎসাহিত করছে। ফলে ব্যাংক ঋণের প্রবাহ শুষ্ক হচ্ছে, শিল্পায়নের গতি থমকে যাচ্ছে।
নীতি কি শিল্পায়ন-বান্ধব?
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ না করলে ব্যাংক খাত টেকসই হবে না। কিন্তু অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একই নিয়ম সব খাতে একভাবে চাপানো যৌক্তিক নয়। রপ্তানি শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি অর্থপ্রবাহ ও বৈদেশিক ক্রেতার শর্ত বিবেচনা করে আলাদা ঋণ শ্রেণিবিন্যাস নীতি প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যেসব খাত ১৮০ দিনের ক্রেডিট টার্মে চলে, তাদের জন্য তিন মাসে ঋণ শ্রেণিবিন্যাস করা বাস্তবতাবিবর্জিত। এমন নীতি শিল্পায়ন-বান্ধব নয়, বরং উৎপাদন ও রপ্তানি খাতকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে।
নীতিতে সমন্বয় জরুরি
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক কঠিন পর্যায়ে—ডলার সংকট, বৈদেশিক বাজারের অস্থিরতা, স্থানীয় মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এর মধ্যে শিল্পোন্নয়ন ও রপ্তানি আয় বাড়ানো অপরিহার্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ শ্রেণিবিন্যাস নীতি পুনর্বিবেচনা করা সময়ের দাবি। ব্যবসায়ীদের আস্থা ফেরাতে, উৎপাদন-রপ্তানি চালু রাখতে