আন্দোলনের সূচনা: সরকারি চাকরির স্বপ্ন
গত বছরের জুলাই মাসে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের হাজারো শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমেছিলেন একটি মৌলিক দাবির সুবাদে—সরকারি চাকরিতে স্বচ্ছতা, মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ও বেকার শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা। তাদের বিক্ষোভ, রেলপথ–সড়ক অবরোধ ও অনশন কর্মসূচি এক পর্যায়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে টালমাটাল করে তোলে। সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনরোষ তৈরি হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন সরকারও পদত্যাগের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে। অনেকেই এটিকে তরুণ প্রজন্মের ‘বিজয়’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি: সবার জন্য চাকরি?
আন্দোলনের সময় এই তরুণ নেতারা জনসভায়, টিভি টকশোতে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় দৃঢ় ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন—এই আন্দোলন কোনও দলীয় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য নয়। তাদের একটাই দাবি: দেশের শিক্ষিত বেকারদের জন্য পর্যাপ্ত সরকারি চাকরি, স্বচ্ছ নিয়োগ পরীক্ষা এবং মেধার যথাযথ মর্যাদা। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মনে তখন আশার আলো জ্বলেছিল। তারা ভেবেছিল, ক্ষমতার পরিবর্তনের পর পরীক্ষাগুলো সুষ্ঠু ও দুর্নীতিমুক্ত হবে এবং চাকরির নতুন সুযোগ আসবে।
বাস্তবতা: নতুন দল, নতুন ক্ষমতা, পুরনো কাহিনি
কিন্তু সরকার পতনের পর পরিস্থিতি একেবারে অন্য পথে মোড় নেয়। যারা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তারা হঠাৎ করেই ‘ছাত্র-জনতার প্রতিনিধি’ থেকে ‘নতুন রাজনৈতিক নেতা’ হয়ে গেলেন। তাদের অনেকে মিলে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করলেন, মন্ত্রী–প্রতিমন্ত্রীর আসন ভাগ করে নিলেন এবং ক্ষমতাধর উপদেষ্টা হয়ে উঠলেন। রাতারাতি তাদের জীবনযাপন পাল্টে গেল—দামী গাড়ি, রাজকীয় অফিস, প্রভাবশালী বৈঠক এবং বিলাসবহুল বাড়ি। কিন্তু আন্দোলনে অংশ নেওয়া সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের জন্য সরকারি চাকরির কোনো বিজ্ঞপ্তি হয়নি, নতুন কোনো পদ তৈরি হয়নি, এবং গত ১১ মাসে একটিও পরীক্ষা হয়নি।
ক্ষমতা ও নৈতিকতার বিচ্যুতি
অনেকের প্রশ্ন: যারা সরকারের অপদার্থতা, স্বজনপ্রীতি ও লোভের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন, তারা কেন ক্ষমতায় গিয়ে স্বচ্ছতা ও ন্যায়ের কথা ভুলে গেলেন? অধিকাংশ নেতার আয়ের উৎস আজও অজানা। জনগণ দেখছে, গত বছরের মধ্যবিত্ত–গরিব ছাত্রনেতারা আজ কোটি টাকা মূল্যের গাড়িতে চড়েন, বিদেশ সফরে যান এবং দামী রেস্তোরাঁয় খান। যেখানে আন্দোলনের মূল দাবি ছিল ‘সব ছাত্রের জন্য চাকরি’, সেই লক্ষ্য এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জনগণের চোখে এটি এক ধরণের বিশ্বাসঘাতকতা।
তরুণ প্রজন্মের মনে হতাশার বীজ
এই ঘটনা শুধু রাজনৈতিক নেতাদের নয়, গোটা যুবসমাজের কাছে একটি বিপজ্জনক বার্তা পৌঁছে দেয়। যুবকরা দেখছে: আন্দোলন করে, স্লোগান দিয়ে এবং রাস্তায় রক্ত ঝরিয়ে শেষ পর্যন্ত লাভবান হচ্ছে কেবল নেতৃত্বর ক্ষুদ্র এক গোষ্ঠী। এতে সাধারণ ছাত্রদের মনে হতাশা, বিতৃষ্ণা ও অবিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে। অনেকে ভাবছে: ‘দেশে ন্যায়বিচার নেই’, ‘কোনো আদর্শ নেই’ এবং ‘রাজনীতি মানে শুধু নিজের পকেট ভরানো’। এই বোধ ধীরে ধীরে দেশের শিক্ষিত তরুণদের নাগরিক দায়িত্ববোধ, নৈতিকতা ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
সমাজে বিভাজন ও বৈষম্য
এরকম পরিস্থিতি সমাজে ভয়াবহ বৈষম্য তৈরি করে। একদিকে ক্ষমতাসীন নতুন রাজনৈতিক নেতারা অজানা সম্পদে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন, অন্যদিকে তাদের সঙ্গে থাকা সহপাঠীরা এখনও বেকার, হতাশ ও পরিবারের বোঝা হয়ে আছে। এতে সামাজিক হিংসা, অপরাধ প্রবণতা, মাদকের আসক্তি ও অভিবাসনের প্রবণতা বেড়ে যায়। দেশের মেধাবী তরুণেরা বিদেশে চলে যেতে চায়। সমতা ও ন্যায়ের সমাজ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়।
রাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকি
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই পরিস্থিতি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে। নাগরিকদের রাষ্ট্রের ওপর আস্থা নষ্ট হয়। যখন তরুণ সমাজ ভাবে: ‘আন্দোলন করেও কিছু হয় না’, তখন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ভেঙে যায়। জনগণ সহিংস, চরমপন্থী কিংবা অগণতান্ত্রিক পথে সমাধান খুঁজতে শুরু করে। রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়, বিনিয়োগ কমে যায় এবং অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
স্বপ্নের অপমৃত্যু
গত জুলাইয়ের আন্দোলন হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীকে ন্যায্য, স্বচ্ছ ও সমতার সমাজ গড়ার স্বপ্নে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। আজ ১১ মাস পর সেই স্বপ্ন ধূলায় মিশে গেছে। নেতৃত্বের ব্যক্তিগত স্বার্থে সেই জনতার দাবি বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। যতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব নৈতিক দায়িত্ববদ্ধতা, স্বচ্ছতা ও জনস্বার্থকে প্রাধান্য না দেয়, ততদিন দেশের শিক্ষিত বেকারদের সমস্যা সমাধান হবে না, বরং আরও জটিল হবে। এটাই আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বড় বিপদ।