০২:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫

‘জেনারেশন জেড’-এর হতাশার মূল কোথায়, কেন আত্মহত্যা বাড়ছে ?

অশনিসংকেত

দক্ষিণ চীনা মর্নিং পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে হংকংয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা রেকর্ড-সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো— হংকং এর মতো শুধু প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকই নয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, তরুণ পুলিশকর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী—সবাই এই তালিকায় আছে বাংলাদশে সহ বিভিন্ন দেশজুড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঢেউয়ের কেন্দ্রে আছে ‘জেনারেশন জেড’ (১৯৯৭–২০১২ সালে জন্ম নেওয়া প্রজন্ম)-এর গভীর হতাশা ও দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ।

আত্মঘাতী প্রবণতার ভয়াবহ পরিসংখ্যান

প্রতিবেদন বলছে, ২০২৫-এর প্রথম কয়েক মাসেই আত্মহত্যার সংখ্যা ২০১৭ সালের পর সর্বোচ্চ হয়েছে। স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মৃত্যুসংবাদ ক্রমেই সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠছে। পুলিশ বাহিনীতেও তরুণ অফিসারদের আত্মহত্যা বাড়ছে। শুধু সংখ্যা নয়, আত্মহননের এই প্রবণতা নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ডেকে এনেছে।

শিক্ষা-ব্যবস্থার চাপ ও প্রতিযোগিতা

হংকংয়ের শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানের হলেও মারাত্মক প্রতিযোগিতামূলক। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—সব স্তরে পরীক্ষা, প্রবেশিকা যুদ্ধ ও পারিবারিক প্রত্যাশার ভারে শিক্ষার্থীরা শারীরিক-মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। এই অবস্থা বাংলাদেশ সহ অনেকগুলো দেশে।
করোনাভাইরাস মহামারির পর অনলাইন ক্লাস ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা কিশোর-কিশোরীদের উদ্বেগ-বিষণ্নতা আরও বাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্কুলে মানসিক স্বাস্থ্য-সহায়তা সীমিত, আর শিক্ষকদেরও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেই।

কর্মক্ষেত্রের অনিশ্চয়তা ও তরুণদের হতাশা

বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থার প্রভাব ছোট দেশগুলোতে স্পষ্ট। চাকরি পাওয়া কঠিন; মেলে কম বেতন, বেশি কাজের চাপ, উন্নতি-সুযোগ সীমিত। ধনী-গরিবের ব্যবধান বেড়ে যাওয়ায় অনেক তরুণ মনে করেন, তারা কখনোই ‘ফ্ল্যাট’ কেনার সামর্থ্য অর্জন করতে পারবেন না। পাবে না কোন ভালো জীবন।
পুলিশ বাহিনীর মতো সরকারি পেশায় যোগ দেওয়া তরুণরাও সামাজিক-রাজনৈতিক চাপের মুখে। বিক্ষোভ দমনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে চলমান বিতর্ক তাদের ওপর বাড়তি মানসিক বোঝা তৈরি করছে।

সামাজিক সম্পর্কের দুর্বলতা

অত্যন্ত ব্যস্ত ও ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে প্রতিটি শহর, ব্যক্তিগত পরিসর কম। বন্ধুত্ব বা পরিবারকেন্দ্রিক সম্পর্ক প্রায়ই দুর্বল হয়ে যায়।
ডিজিটাল যুগে সবাই অনলাইনে থাকলেও গভীর মানবিক বন্ধন গড়ে ওঠা কঠিন। তরুণরা ‘একা’—এমনকি পরিবারের মধ্যেও মানসিক বিচ্ছিন্নতায় ভোগে।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক ট্যাবু

সবচেয়ে বড় বাধা মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। অনেকের ধারণা, মানসিক সমস্যার কথা বললে তা ‘দুর্বলতা’ প্রমাণ করে। ফলে কেউ কাউন্সেলিং বা চিকিৎসা নিতে চান না। সমস্যার তীব্রতা চরমে পৌঁছালে আত্মহত্যাই শেষ উপায় বলে মনে হয়।

সমাধানের পথ খোঁজে সমাজ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্কুল-কলেজে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা চালু করা জরুরি। পরিবার ও শিক্ষকদের বোঝাতে হবে—মানসিক চাপ স্বাভাবিক; তা মোকাবিলার কৌশল শিখতে হবে।
সরকার হেল্পলাইন, স্কুল কাউন্সেলর নিয়োগ ও জনসচেতনতামূলক প্রচারণা শুরু করেছে, তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা এখনও অপ্রতুল।

জেনারেশ জের মানসিক স্বাস্থ্যর প্রতি গুরুত্ব দেয়া

হংকংয়ে আত্মহত্যার এই ঢেউ শুধু একটি শহরের সংকট নয়; এটি বৈশ্বিক প্রজন্মগত সমস্যার প্রতীচিহ্ন। প্রযুক্তি, তীব্র প্রতিযোগিতা ও অনিশ্চয়তা-মিশ্রিত সময়ে বড় হওয়া জেনারেশন জেড-এর মানসিক স্বাস্থ্যের দায় সমাজেরই। তরুণদের প্রতি সহমর্মিতা, যথাযথ সহায়তা ও চাপ-মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করাই এখন সবার অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

 

‘জেনারেশন জেড’-এর হতাশার মূল কোথায়, কেন আত্মহত্যা বাড়ছে ?

০৮:০০:০৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫

অশনিসংকেত

দক্ষিণ চীনা মর্নিং পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে হংকংয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা রেকর্ড-সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো— হংকং এর মতো শুধু প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকই নয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, তরুণ পুলিশকর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী—সবাই এই তালিকায় আছে বাংলাদশে সহ বিভিন্ন দেশজুড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঢেউয়ের কেন্দ্রে আছে ‘জেনারেশন জেড’ (১৯৯৭–২০১২ সালে জন্ম নেওয়া প্রজন্ম)-এর গভীর হতাশা ও দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ।

আত্মঘাতী প্রবণতার ভয়াবহ পরিসংখ্যান

প্রতিবেদন বলছে, ২০২৫-এর প্রথম কয়েক মাসেই আত্মহত্যার সংখ্যা ২০১৭ সালের পর সর্বোচ্চ হয়েছে। স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মৃত্যুসংবাদ ক্রমেই সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠছে। পুলিশ বাহিনীতেও তরুণ অফিসারদের আত্মহত্যা বাড়ছে। শুধু সংখ্যা নয়, আত্মহননের এই প্রবণতা নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ডেকে এনেছে।

শিক্ষা-ব্যবস্থার চাপ ও প্রতিযোগিতা

হংকংয়ের শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানের হলেও মারাত্মক প্রতিযোগিতামূলক। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—সব স্তরে পরীক্ষা, প্রবেশিকা যুদ্ধ ও পারিবারিক প্রত্যাশার ভারে শিক্ষার্থীরা শারীরিক-মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। এই অবস্থা বাংলাদেশ সহ অনেকগুলো দেশে।
করোনাভাইরাস মহামারির পর অনলাইন ক্লাস ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা কিশোর-কিশোরীদের উদ্বেগ-বিষণ্নতা আরও বাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্কুলে মানসিক স্বাস্থ্য-সহায়তা সীমিত, আর শিক্ষকদেরও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেই।

কর্মক্ষেত্রের অনিশ্চয়তা ও তরুণদের হতাশা

বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থার প্রভাব ছোট দেশগুলোতে স্পষ্ট। চাকরি পাওয়া কঠিন; মেলে কম বেতন, বেশি কাজের চাপ, উন্নতি-সুযোগ সীমিত। ধনী-গরিবের ব্যবধান বেড়ে যাওয়ায় অনেক তরুণ মনে করেন, তারা কখনোই ‘ফ্ল্যাট’ কেনার সামর্থ্য অর্জন করতে পারবেন না। পাবে না কোন ভালো জীবন।
পুলিশ বাহিনীর মতো সরকারি পেশায় যোগ দেওয়া তরুণরাও সামাজিক-রাজনৈতিক চাপের মুখে। বিক্ষোভ দমনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে চলমান বিতর্ক তাদের ওপর বাড়তি মানসিক বোঝা তৈরি করছে।

সামাজিক সম্পর্কের দুর্বলতা

অত্যন্ত ব্যস্ত ও ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে প্রতিটি শহর, ব্যক্তিগত পরিসর কম। বন্ধুত্ব বা পরিবারকেন্দ্রিক সম্পর্ক প্রায়ই দুর্বল হয়ে যায়।
ডিজিটাল যুগে সবাই অনলাইনে থাকলেও গভীর মানবিক বন্ধন গড়ে ওঠা কঠিন। তরুণরা ‘একা’—এমনকি পরিবারের মধ্যেও মানসিক বিচ্ছিন্নতায় ভোগে।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক ট্যাবু

সবচেয়ে বড় বাধা মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। অনেকের ধারণা, মানসিক সমস্যার কথা বললে তা ‘দুর্বলতা’ প্রমাণ করে। ফলে কেউ কাউন্সেলিং বা চিকিৎসা নিতে চান না। সমস্যার তীব্রতা চরমে পৌঁছালে আত্মহত্যাই শেষ উপায় বলে মনে হয়।

সমাধানের পথ খোঁজে সমাজ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্কুল-কলেজে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা চালু করা জরুরি। পরিবার ও শিক্ষকদের বোঝাতে হবে—মানসিক চাপ স্বাভাবিক; তা মোকাবিলার কৌশল শিখতে হবে।
সরকার হেল্পলাইন, স্কুল কাউন্সেলর নিয়োগ ও জনসচেতনতামূলক প্রচারণা শুরু করেছে, তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা এখনও অপ্রতুল।

জেনারেশ জের মানসিক স্বাস্থ্যর প্রতি গুরুত্ব দেয়া

হংকংয়ে আত্মহত্যার এই ঢেউ শুধু একটি শহরের সংকট নয়; এটি বৈশ্বিক প্রজন্মগত সমস্যার প্রতীচিহ্ন। প্রযুক্তি, তীব্র প্রতিযোগিতা ও অনিশ্চয়তা-মিশ্রিত সময়ে বড় হওয়া জেনারেশন জেড-এর মানসিক স্বাস্থ্যের দায় সমাজেরই। তরুণদের প্রতি সহমর্মিতা, যথাযথ সহায়তা ও চাপ-মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করাই এখন সবার অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।