বাংলা শিশুসাহিত্যের তিন মহীরূহ
বাংলা শিশুসাহিত্যের ইতিহাসে তিনটি নাম বিশেষ উজ্জ্বল হয়ে আছে—উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায় এবং সত্যজিৎ রায়। এরা কেবল তিন প্রজন্মের প্রতিনিধি নন, বরং বাংলা ভাষায় শিশুদের জন্য সাহিত্য, চিত্রকলার বই, বিজ্ঞানচিন্তা ও কল্পনার জগতকে সমৃদ্ধ করার এক মহাকাব্যিক ধারা তৈরি করেছেন।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী: সূচনাকারীর সৃজনশীলতা
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীকে বাংলা শিশুসাহিত্যের প্রথম যুগের আধুনিক রূপকার বলা হয়। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, চিত্রশিল্পী, ছাপাখানার প্রযুক্তিবিদ ও সম্পাদক। ১৯১৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকা—যা বাংলা শিশুসাহিত্যে নতুন যুগের সূচনা করে।
তিনি শিশুদের জন্য গল্প লিখেছেন যেমন: “ছোটদের রামায়ণ”, “ছোটদের মহাভারত”, যেখানে সহজ ভাষায় মহাকাব্যগুলোকে গল্পের আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। শিশুদের মনে বিজ্ঞান ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা জাগাতে তিনি নিজের আঁকা অসাধারণ ছবি ব্যবহার করেছেন। তাঁর বইগুলোতে বাস্তব বর্ণনা ও কল্পনার মিশ্রণ ছিল খুব আকর্ষণীয়। ছাপার প্রযুক্তিতেও তিনি উন্নতি এনে ‘হাফটোন ব্লক’ তৈরি করে বাংলার বই প্রকাশনায় বিপ্লব ঘটান।
সুকুমার রায়: শিশুকাব্যের বিপ্লবী
উপেন্দ্রকিশোরের ছেলে সুকুমার রায় বাংলা শিশুসাহিত্যে একেবারে নতুন মাত্রা আনেন। তিনি বাংলা ছড়া ও রম্যলেখাকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেন। তাঁর লেখা ‘আবোল তাবোল’ শিশুদের কল্পনার জগৎকে সম্পূর্ণ নতুন রঙে রাঙিয়ে তোলে।
সুকুমার রায় ছিলেন শব্দের জাদুকর। তাঁর ছড়ায় আছে ছন্দ, হাস্যরস, শব্দের খেলায় উদ্ভট চরিত্র ও দৃশ্য, যা শিশুদের ভাবনাকে মুক্ত উড়ান দেয়। ‘হযবরল’, ‘পাগলা দাশু’, ‘খাই খাই’ – এসব লেখা কেবল মজার নয়, ভাষার স্বাভাবিক সৃজনশীলতা ও শিশুমনের বৈজ্ঞানিক কৌতূহলকেও উসকে দেয়। সুকুমার রায় বাংলা শিশুসাহিত্যে ননসেন্সের ধারা প্রবর্তন করেন, যা বাংলা সাহিত্যে এক অভাবনীয় সংযোজন।
সত্যজিৎ রায়: চলচ্চিত্রকার থেকে শিশুসাহিত্যিক
সত্যজিৎ রায়, উপেন্দ্রকিশোরের নাতি এবং সুকুমারের ছেলে, সারা বিশ্বের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে বিখ্যাত হলেও বাংলা শিশুসাহিত্যে তাঁর অবদানও অসামান্য। তিনি তাঁর বাবার ‘সন্দেশ’ পত্রিকাকে পুনরুজ্জীবিত করেন ১৯৬১ সালে এবং সম্পাদনার পাশাপাশি লেখাও শুরু করেন।
সত্যজিৎ রায়ের তৈরি ‘ফেলুদা’ গোয়েন্দা চরিত্র ও ‘প্রফেসর শঙ্কু’ বিজ্ঞান-কথার চরিত্র বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে বিপুল জনপ্রিয়। ফেলুদার গল্পগুলোতে শৈল্পিক প্লট, যুক্তি-তর্ক, পর্যটনের বর্ণনা এবং প্রাঞ্জল ভাষা মিলে শিশুদের রোমাঞ্চ আর বুদ্ধির খেলা শেখায়। অন্যদিকে প্রফেসর শঙ্কু চরিত্রে তিনি বিজ্ঞানমনস্কতার পাশাপাশি অদ্ভুত কল্পনা, বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। তাঁর গল্পগুলো বাংলার শিশুদের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ জাগিয়েছে।
তিন প্রজন্মের ধারা: এক সৃজনশীল উত্তরাধিকার
উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার ও সত্যজিৎ—তিন প্রজন্মে এই পরিবারের অবদান কেবল তিনটি আলাদা শৈলীর সৃষ্টি নয়। বরং তারা মিলে বাংলার শিশুদের জন্য এক সমৃদ্ধ সাহিত্যিক উত্তরাধিকার গড়ে তুলেছেন। উপেন্দ্রকিশোরের ছাপা ছবি ও সহজগল্পের আঙ্গিক, সুকুমারের ছড়ার খেয়ালি বৈজ্ঞানিক কৌতূহল ও ভাষার খেলা, এবং সত্যজিতের গোয়েন্দা-বিজ্ঞান গল্পের যুক্তিনির্ভর রোমাঞ্চ—সব মিলিয়ে বাংলা শিশুসাহিত্যে তারা বৈচিত্র্যের এক অপরূপ জগৎ তৈরি করেছেন।
বাংলা শিশুসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ
বাংলা শিশুসাহিত্য আজ যে সমৃদ্ধ, বৈচিত্র্যময় এবং বাঙালি শিশুদের কল্পনা ও বুদ্ধিকে শাণিত করার উপায় হিসেবে কাজ করে, তার পেছনে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায় ও সত্যজিৎ রায়ের অবদান অমলিন। তাঁদের লেখা শিশুদের শুধু আনন্দ দেয় না, তাদের ভাবনা-চিন্তা, যুক্তি, কল্পনা ও সৃজনশীলতাকে এক নতুন মাত্রা দেয়। বাংলা শিশুসাহিত্য নিয়ে আলোচনা হলে এ তিন প্রজন্মের অবদানকে সম্মান ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করতেই হবে।