প্রেম, বন্ধুত্ব ও ফলোয়ার: সম্পর্কের নতুন সংজ্ঞা
গত এক দশকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ ও এক্স (পূর্বে টুইটার)-এর অভাবনীয় প্রসারের ফলে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ধরনে এসেছে মৌলিক পরিবর্তন। একসময় যে সম্পর্কগুলো গড়ে উঠত সরাসরি সাক্ষাৎ, চিঠি কিংবা ফোনকলের মাধ্যমে, তা এখন গড়ে ওঠে ইনবক্স, স্টোরি রিঅ্যাকশন কিংবা ভার্চুয়াল লাইক-কমেন্টের মধ্য দিয়ে। সম্পর্কের শুরু, গতি এবং এমনকি শেষ হওয়াও এখন অনেকটাই নির্ভর করে এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর।
সহজে যোগাযোগ, দ্রুত বন্ধুত্ব
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সম্পর্ক তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে অভূতপূর্ব সুবিধা দিয়েছে। দূরের মানুষ এক ক্লিকে কাছে চলে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো বন্ধু, প্রবাসী স্বজন কিংবা একসময়কার পরিচিত কেউ হঠাৎ ইনবক্সে “হাই” বললেই কথা শুরু হয়ে যেতে পারে। এটি যেমন পুরনো সম্পর্কগুলো পুনর্জীবিত করতে সাহায্য করে, তেমনি নতুন মানুষের সঙ্গে দ্রুত বন্ধুত্ব তৈরি করাও সহজ করে তুলেছে।
ভার্চুয়াল ঘনিষ্ঠতা বনাম বাস্তব দূরত্ব
তবে এখানেই প্রশ্ন ওঠে—এই ঘনিষ্ঠতা কি সত্যিই ঘনিষ্ঠ? অনেক সময় দেখা যায়, ভার্চুয়াল ঘনিষ্ঠতা বাস্তব জীবনে দূরত্ব তৈরি করে। মানুষ তার সঙ্গী কিংবা পরিবারকে সময় না দিয়ে মগ্ন থাকে স্ক্রিনে, অন্যের জীবনে। এতে এক ধরনের আবেগগত বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, যা ধীরে ধীরে সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি করতে পারে।
সম্পর্কের ওপর অহেতুক চাপ
সোশ্যাল মিডিয়ার আরেকটি বড় প্রভাব হলো ‘পরিপূর্ণ সম্পর্কের’ এক ধরনের মিথ তৈরি করে দেওয়া। ইনস্টাগ্রামে কাপলদের সুখী ছবি দেখে অনেকেই নিজের সম্পর্ককে ত্রুটিপূর্ণ মনে করেন। এক ক্ষেত্রে তুলনামূলক মনোভাব, অসন্তুষ্টি ও ঈর্ষা জন্ম নেয়। কেউ কেউ আবার সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো ‘শেয়ার’ না করলে সন্দেহ করে বসেন। এই শেয়ার কালচার সম্পর্কের স্বাভাবিক গোপনীয়তাকে আঘাত করে।
বিশ্বাসের সংকট ও নজরদারি
বিশ্বাস একটি সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলেও সোশ্যাল মিডিয়া অনেক সময় সেই বিশ্বাসে ফাটল ধরায়। ইনবক্স চেক করা, অনলাইনে কার সঙ্গে বেশি কথা হচ্ছে তা খোঁজা, কার পোস্টে বেশি লাইক দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে সন্দেহ—এসব ব্যাপার সম্পর্কের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় নজরদারি তৈরি করে। ফলস্বরূপ, পারস্পরিক আস্থা কমে গিয়ে সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয়।
বিচ্ছেদ ও সামাজিক চাপ
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্পর্কের সমাপ্তি অনেক সময় হয়ে ওঠে একটি ‘পাবলিক ইভেন্ট’। ব্রেকআপ বা ডিভোর্সের পর প্রোফাইল ছবি পরিবর্তন, একে অপরকে আনফ্রেন্ড বা আনফলো করা, পুরনো পোস্ট ডিলিট করা—এসবই সমাজে সম্পর্কের ভাঙনের এক ধরনের আঘাত হিসেবে দেখা দেয়। এক ক্ষেত্রে মানসিক চাপে ভোগেন উভয় পক্ষই।
নতুন সম্পর্কে প্রবেশের সুযোগ
তবে সব দিক থেকেই বিষয়টি নেতিবাচক নয়। অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জীবনের সেরা বন্ধুটি খুঁজে পেয়েছেন, কেউ বা জীবনসঙ্গী। এটি এমন এক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে, যেখানে বৈচিত্র্যময় মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ থাকে, যেটা হয়তো বাস্তব জীবনে কখনোই হতো না। বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য এটি সংযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
ভারসাম্যই মূল চাবিকাঠি
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে সম্পূর্ণ নেতিবাচক বলা যেমন অন্যায়, তেমনি একে সম্পর্কের একমাত্র মাধ্যম বানানোও ভুল। ভার্চুয়াল জীবনের পাশাপাশি বাস্তব জীবনে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়া, সরাসরি সময় কাটানো, একে অপরের অনুভূতির প্রতি সম্মান বজায় রাখা ও বিশ্বাস বজায় রাখা—এই ভারসাম্যটাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে সুস্থ সম্পর্কের মূল চাবিকাঠি।
উপসংহার
প্রযুক্তি আমাদের সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দিয়েছে—তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে প্রযুক্তিকে সম্পর্কের সহায়ক হিসেবে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন আত্মসংযম, সহনশীলতা, বাস্তব যোগাযোগের অভ্যাস এবং একটি সত্যিকারের আবেগের জগত, যা অনলাইনের বাইরেও বেঁচে থাকে।