০৮:৩১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ জুলাই ২০২৫

ভুল পথে এক পা দিলে ফেরার আর পথ থাকবে না

বিশ্ব রাজনীতির চালচিত্র দিনে দিনে আরও জটিল হয়ে উঠছে। প্রতিটি দেশ, বিশেষ করে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো, এক ধরনের কৌশলগত প্যাঁচে জড়িয়ে পড়ছে যেখানে পরাশক্তিগুলো তাদের স্বার্থ রক্ষায় নানা প্রলোভন ও চাপ প্রয়োগ করছে। বাংলাদেশ সেই প্যাঁচের বাইরে নয়। কিন্তু এই প্যাঁচ থেকে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবে, সেটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। একদিকে চীন, অন্যদিকে ভারত এবং এই দু’জনের মাথার ওপর বসে থাকা যুক্তরাষ্ট্র। এই তিনটি শক্তির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে বাংলাদেশকে এগোতে হবে, যেন কোনো পক্ষের হাতিয়ার হয়ে না যায়, আবার কোনো পক্ষের শত্রুও না হয়। চীন ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের টানাপড়েনের ইতিহাস বহন করে। ১৯৬২ সালের সীমান্ত যুদ্ধ, তারপরে ২০১৭ সালের ডোকলাম সঙ্কট এবং সর্বশেষ ২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষে উভয় দেশের সম্পর্ক বারবার উত্তপ্ত হয়েছে। কিন্তু একটি বিষয় লক্ষণীয়—ভারত কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বা আহ্বানে সাড়া দিয়ে চীনের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেয়নি। এর পেছনে রয়েছে ভারতের একটি সুস্পষ্ট নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি—‘ভারতের স্বার্থই ভারতের পররাষ্ট্রনীতির একমাত্র ভিত্তি’। যুক্তরাষ্ট্র বহুবার চেয়েছে ভারতকে চীনের মোকাবিলায় একটি ফ্রন্টলাইন সহযোগী হিসেবে ব্যবহার করতে, কিন্তু ভারত তাতে সাড়া দেয়নি। এমনকি কোয়াড জোটে যুক্ত থাকলেও ভারত কোনোদিন চীনকে সরাসরি প্রতিপক্ষ হিসেবে ঘোষণা করেনি। এর কারণ একটাই—ভারত জানে, যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে, সে মুখ ফিরিয়ে নিতে একটুও দেরি করবে না এবং তখন ভারত একা পড়ে যাবে। এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন অন্য কৌশল নিচ্ছে, ভারতের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করছে নানাভাবে। একটি বিষয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে—হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ভারতীয় অভিবাসীদের ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। তাদেরকে আটক করে বিমানযোগে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা কেবল আইন প্রয়োগ নয়, একপ্রকার কূটনৈতিক বার্তা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অভিবাসীসমৃদ্ধ দেশ যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয়রা সংখ্যায় বড় একটি গোষ্ঠী।

তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক অবৈধভাবে আছে, এটা নতুন নয়, বহু বছরের বিষয়। কিন্তু এই বিষয়ে এখন এমনভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে যেন ভারতীয়রা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক অস্বস্তির কারণ। এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবলে ভুল হবে। বরং এটা একটি বড় কৌশলের অংশ—ভারতকে চাপে রাখা, বার্তা দেওয়া যে ‘তুমি যদি চীনের বিরুদ্ধে না দাঁড়াও, তাহলে আমরা তোমার গায়ে কাঁটা লাগাবো।‘ আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে যখন দেখা যায়, ভারত বহু বছর আগেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার জন্য আগাম অর্থ প্রদান করেছে। কিন্তু এখনো একটি বিমানও হাতে পায়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্র বলছে খুচরা যন্ত্রাংশের জন্য বাড়তি অর্থ দিতে হবে। এটা কেবল সময়ক্ষেপণ নয়, এটি এক ধরনের ‘স্ট্র্যাটেজিক ইনসাল্ট’। ভারত, তার শক্তি, অর্থনীতি এবং কূটনৈতিক অবস্থান থাকার পরেও এই আচরণ ভোগ করছে কারণ সে চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা অনুযায়ী দাঁড়ায়নি। তাহলে বাংলাদেশের জন্য কী বার্তা? বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এখন এক কঠিন বাঁকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্র বারবার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে যে, তারা চীনবিরোধী ব্লকে বাংলাদেশকে চায়। কখনও ইন্ডো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির নামে, কখনও শ্রমমানবাধিকার বা গণতন্ত্রের ব্যানারে, আবার কখনও সামরিক বা প্রযুক্তিগত সহযোগিতার প্রস্তাবে তারা বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসে। কিন্তু তাদের প্রত্যাশা একটাই—বাংলাদেশ যেন চীনকে বিরোধী শক্তি হিসেবে গণ্য করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে দক্ষিণ এশিয়ার একটি ‘নতুন অক্ষ’ গঠন করে। এই প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে কিছু সুস্পষ্ট ঝুঁকি। প্রথমত, চীন বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বড় অবকাঠামোগত বিনিয়োগকারী, রপ্তানি খাতের অন্যতম অংশীদার এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে এক নীরব সহায়তাকারী শক্তি। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর উন্নয়ন, বন্দর নির্মাণ, সড়ক, রেলপথসহ বহুখাতে চীনের বিনিয়োগ ও কারিগরি সহায়তা রয়েছে।

এইসব সম্পর্ক একদিনে গড়ে ওঠেনি, এবং এগুলো ভেঙে ফেললে ক্ষতি হবে আমাদেরই। দ্বিতীয়ত, চীনের সঙ্গে শত্রুতা তৈরি করা মানে কেবল একটি পরাশক্তির বিরুদ্ধাচরণ নয়—এটা হবে এক ধরনের অর্থনৈতিক আত্মহত্যা। আমাদের রপ্তানির বাজার, প্রকল্প অর্থায়ন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা চীনের অংশীদারিত্বে অনেকখানি নির্ভর করে। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, যদি আমরা যুক্তরাষ্ট্রের চাপে চীনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিই, তাহলে একবার যে অবস্থানে যাবো, সেখান থেকে আর ফেরা যাবে না। কারণ চীন কখনোই বাংলাদেশের এই অবস্থানকে ভুলে যাবে না। তাদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ তখন হয়ে উঠবে একটি ‘শত্রুপ্রতিম’ রাষ্ট্র, যা কৌশলগতভাবে বিপজ্জনক। তখন শুধু চীন নয়, তার সঙ্গে থাকা রাশিয়া, ইরান বা অন্যান্য রাষ্ট্রও আমাদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে। আমরা হারাবো একাধিক বন্ধু এবং পাবো শুধু একটি চঞ্চল ও স্বার্থনির্ভর মিত্র—যুক্তরাষ্ট্র, যার সম্পর্কের ভিত্তি হলো প্রয়োজন, ভালোবাসা নয়। আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূরাজনৈতিক খেলা নতুন নয়। তারা এক সময় আফগানিস্তানকে ব্যবহার করেছে, ইরাককে ব্যবহার করেছে, লিবিয়াকে ব্যবহার করেছে। একসময় পাকিস্তানের ‘বন্ধু’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, পরে একদম মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। যারা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহারযোগ্য, তাদেরকে ব্যবহার করে এবং প্রয়োজনে ফেলে দেয়। বাংলাদেশের অবস্থাও এই তালিকায় যুক্ত হতে পারে, যদি আমরা সতর্ক না থাকি। বাংলাদেশের প্রতিবেশী হিসেবে ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের ঐতিহাসিক ভূমিকা আছে, বর্তমানে অর্থনীতি ও বাণিজ্যে অনেক সংযোগ রয়েছে। আবার বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের দাদাগিরির মনোভাবও অগ্রহণযোগ্য। তবে মনে রাখতে হবে, ভারতও একইসঙ্গে চীনের সঙ্গে কৌশলগত প্রতিযোগিতায় রয়েছে। তবে বাংলাদেশকে ভারতের পথ অনুসরণ করতে হবে না, বরং শিক্ষা নিতে হবে। ভারত যেভাবে চীনের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে না গিয়ে বরং কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করেছে, বাংলাদেশকেও সেভাবে চলতে হবে। আমাদের কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে সরাসরি দাঁড়ানো নয়, বরং নিজের স্বার্থের জায়গা থেকে চলা উচিত। যুক্তরাষ্ট্রকে ‘না’ বলা মানেই শত্রুতা নয়, বরং সুস্পষ্ট ও স্বাধীন নীতির ইঙ্গিত। আজ যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বলে চীনকে এড়িয়ে চলতে, কাল বলবে অন্য কাউকে। তারপর যদি আমরা তাদের প্রত্যাশা পূরণ না করি, তাহলে তারা আমাদের নিয়েও অভ্যন্তরীণ প্রচার চালাবে, মানবাধিকার প্রশ্ন তুলবে, নির্বাচন প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করবে, ভিসা নীতি প্রয়োগ করবে। এমনকি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বা রপ্তানি শুল্ক বৃদ্ধির মতো ব্যবস্থা নিতে পারে। এসব কোনো কল্পনা নয়, বরং সাম্প্রতিক ইতিহাসে বহু দেশের সঙ্গে তারা এমন আচরণ করেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে যা করতে হবে তা হলো একটি স্বাধীন, স্বার্থসচেতন ও সুদূরপ্রসারী কূটনীতি গড়ে তোলা।

আমাদের কোনো পক্ষের দালাল হওয়া চলবে না। আমরা যদি এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসক্রিপশন নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিই, তাহলে শুধু আমাদের পররাষ্ট্রনীতি বিপন্ন হবে না—আমাদের অর্থনীতি, বিনিয়োগ এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনকি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাঁধে এক অপ্রয়োজনীয় শত্রুতা ও জটিলতা চাপিয়ে দেওয়া হবে। বাংলাদেশের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত—প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা, পরাশক্তিদের সঙ্গে কৌশলগত ভারসাম্য রাখা এবং কোনো পক্ষের হাতে ‘ইউজেবল স্টেট’ হয়ে না ওঠা। এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের কূটনীতিকদের বিচক্ষণতা, নীতিনির্ধারকদের সাহসিকতা এবং জাতির বিবেকের জাগরণ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বিশ্বরাজনীতির এই ভয়ংকর খেলায় কোনো ভুল পদক্ষেপই আমাদের চরম মাশুল দিতে বাধ্য করবে। এখন সময়—নিজেকে রক্ষা করার, আত্মসম্মান বজায় রাখার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি স্বাধীন, স্থিতিশীল ও সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করার। আজ আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসক্রিপশন মেনে চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিই, কাল আমেরিকার প্রয়োজন শেষ হলে তারা আমাদের প্রতি এমন ব্যবহার করবে, যেভাবে করেছে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া বা এখন করছে ভারতীয় অভিবাসীদের সঙ্গে। আর তখন ফিরে আসার পথ থাকবে না—কারণ প্রতিবেশীরা তখন আমাদের প্রতিপক্ষ হয়ে যাবে। তাই এখন প্রয়োজন—একটি ঠান্ডা মাথার বাস্তববাদী কূটনীতি। আমাদের উচিত বন্ধুত্বের ভিত্তিতে প্রতিটি দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করা, নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, নিজের অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা ধীরে ধীরে বাড়ানো এবং বিশেষ করে আমেরিকার কৌশলগত চাপে কোনো ফাঁদে না পড়ে, নিজেদের স্বাধীন অবস্থানকে নিরুৎসাহিত না করা। বাংলাদেশের একটিই কাজ—প্রতিবেশীদের সঙ্গে শত্রুতা নয়, বন্ধুত্বই হোক লক্ষ্য। ভূরাজনীতির ভয়ংকর খেলা থেকে নিজেকে রক্ষা করার একমাত্র উপায়—সতর্কতা, দূরদর্শিতা এবং আত্মসম্মান। যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য যে কোনো পরাশক্তির কৌশলগত ফাঁদ থেকে দূরে থাকতে না পারলে, বাংলাদেশ এক ভয়াবহ বিপদের মধ্যে পড়বে—যার দায় জাতি হিসেবেই আমাদের বহন করতে হবে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

( এই লেখার মতামত লেখকের নিজস্ব)

পুরান ঢাকার অতীত দিনের কথা ( কিস্তি- ৪২)

ভুল পথে এক পা দিলে ফেরার আর পথ থাকবে না

০৮:০০:১৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২১ জুলাই ২০২৫

বিশ্ব রাজনীতির চালচিত্র দিনে দিনে আরও জটিল হয়ে উঠছে। প্রতিটি দেশ, বিশেষ করে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো, এক ধরনের কৌশলগত প্যাঁচে জড়িয়ে পড়ছে যেখানে পরাশক্তিগুলো তাদের স্বার্থ রক্ষায় নানা প্রলোভন ও চাপ প্রয়োগ করছে। বাংলাদেশ সেই প্যাঁচের বাইরে নয়। কিন্তু এই প্যাঁচ থেকে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবে, সেটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। একদিকে চীন, অন্যদিকে ভারত এবং এই দু’জনের মাথার ওপর বসে থাকা যুক্তরাষ্ট্র। এই তিনটি শক্তির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে বাংলাদেশকে এগোতে হবে, যেন কোনো পক্ষের হাতিয়ার হয়ে না যায়, আবার কোনো পক্ষের শত্রুও না হয়। চীন ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের টানাপড়েনের ইতিহাস বহন করে। ১৯৬২ সালের সীমান্ত যুদ্ধ, তারপরে ২০১৭ সালের ডোকলাম সঙ্কট এবং সর্বশেষ ২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষে উভয় দেশের সম্পর্ক বারবার উত্তপ্ত হয়েছে। কিন্তু একটি বিষয় লক্ষণীয়—ভারত কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বা আহ্বানে সাড়া দিয়ে চীনের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেয়নি। এর পেছনে রয়েছে ভারতের একটি সুস্পষ্ট নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি—‘ভারতের স্বার্থই ভারতের পররাষ্ট্রনীতির একমাত্র ভিত্তি’। যুক্তরাষ্ট্র বহুবার চেয়েছে ভারতকে চীনের মোকাবিলায় একটি ফ্রন্টলাইন সহযোগী হিসেবে ব্যবহার করতে, কিন্তু ভারত তাতে সাড়া দেয়নি। এমনকি কোয়াড জোটে যুক্ত থাকলেও ভারত কোনোদিন চীনকে সরাসরি প্রতিপক্ষ হিসেবে ঘোষণা করেনি। এর কারণ একটাই—ভারত জানে, যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে, সে মুখ ফিরিয়ে নিতে একটুও দেরি করবে না এবং তখন ভারত একা পড়ে যাবে। এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন অন্য কৌশল নিচ্ছে, ভারতের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করছে নানাভাবে। একটি বিষয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে—হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ভারতীয় অভিবাসীদের ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। তাদেরকে আটক করে বিমানযোগে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা কেবল আইন প্রয়োগ নয়, একপ্রকার কূটনৈতিক বার্তা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অভিবাসীসমৃদ্ধ দেশ যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয়রা সংখ্যায় বড় একটি গোষ্ঠী।

তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক অবৈধভাবে আছে, এটা নতুন নয়, বহু বছরের বিষয়। কিন্তু এই বিষয়ে এখন এমনভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে যেন ভারতীয়রা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক অস্বস্তির কারণ। এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবলে ভুল হবে। বরং এটা একটি বড় কৌশলের অংশ—ভারতকে চাপে রাখা, বার্তা দেওয়া যে ‘তুমি যদি চীনের বিরুদ্ধে না দাঁড়াও, তাহলে আমরা তোমার গায়ে কাঁটা লাগাবো।‘ আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে যখন দেখা যায়, ভারত বহু বছর আগেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার জন্য আগাম অর্থ প্রদান করেছে। কিন্তু এখনো একটি বিমানও হাতে পায়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্র বলছে খুচরা যন্ত্রাংশের জন্য বাড়তি অর্থ দিতে হবে। এটা কেবল সময়ক্ষেপণ নয়, এটি এক ধরনের ‘স্ট্র্যাটেজিক ইনসাল্ট’। ভারত, তার শক্তি, অর্থনীতি এবং কূটনৈতিক অবস্থান থাকার পরেও এই আচরণ ভোগ করছে কারণ সে চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা অনুযায়ী দাঁড়ায়নি। তাহলে বাংলাদেশের জন্য কী বার্তা? বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এখন এক কঠিন বাঁকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্র বারবার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে যে, তারা চীনবিরোধী ব্লকে বাংলাদেশকে চায়। কখনও ইন্ডো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির নামে, কখনও শ্রমমানবাধিকার বা গণতন্ত্রের ব্যানারে, আবার কখনও সামরিক বা প্রযুক্তিগত সহযোগিতার প্রস্তাবে তারা বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসে। কিন্তু তাদের প্রত্যাশা একটাই—বাংলাদেশ যেন চীনকে বিরোধী শক্তি হিসেবে গণ্য করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে দক্ষিণ এশিয়ার একটি ‘নতুন অক্ষ’ গঠন করে। এই প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে কিছু সুস্পষ্ট ঝুঁকি। প্রথমত, চীন বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বড় অবকাঠামোগত বিনিয়োগকারী, রপ্তানি খাতের অন্যতম অংশীদার এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে এক নীরব সহায়তাকারী শক্তি। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর উন্নয়ন, বন্দর নির্মাণ, সড়ক, রেলপথসহ বহুখাতে চীনের বিনিয়োগ ও কারিগরি সহায়তা রয়েছে।

এইসব সম্পর্ক একদিনে গড়ে ওঠেনি, এবং এগুলো ভেঙে ফেললে ক্ষতি হবে আমাদেরই। দ্বিতীয়ত, চীনের সঙ্গে শত্রুতা তৈরি করা মানে কেবল একটি পরাশক্তির বিরুদ্ধাচরণ নয়—এটা হবে এক ধরনের অর্থনৈতিক আত্মহত্যা। আমাদের রপ্তানির বাজার, প্রকল্প অর্থায়ন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা চীনের অংশীদারিত্বে অনেকখানি নির্ভর করে। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, যদি আমরা যুক্তরাষ্ট্রের চাপে চীনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিই, তাহলে একবার যে অবস্থানে যাবো, সেখান থেকে আর ফেরা যাবে না। কারণ চীন কখনোই বাংলাদেশের এই অবস্থানকে ভুলে যাবে না। তাদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ তখন হয়ে উঠবে একটি ‘শত্রুপ্রতিম’ রাষ্ট্র, যা কৌশলগতভাবে বিপজ্জনক। তখন শুধু চীন নয়, তার সঙ্গে থাকা রাশিয়া, ইরান বা অন্যান্য রাষ্ট্রও আমাদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে। আমরা হারাবো একাধিক বন্ধু এবং পাবো শুধু একটি চঞ্চল ও স্বার্থনির্ভর মিত্র—যুক্তরাষ্ট্র, যার সম্পর্কের ভিত্তি হলো প্রয়োজন, ভালোবাসা নয়। আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূরাজনৈতিক খেলা নতুন নয়। তারা এক সময় আফগানিস্তানকে ব্যবহার করেছে, ইরাককে ব্যবহার করেছে, লিবিয়াকে ব্যবহার করেছে। একসময় পাকিস্তানের ‘বন্ধু’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, পরে একদম মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। যারা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহারযোগ্য, তাদেরকে ব্যবহার করে এবং প্রয়োজনে ফেলে দেয়। বাংলাদেশের অবস্থাও এই তালিকায় যুক্ত হতে পারে, যদি আমরা সতর্ক না থাকি। বাংলাদেশের প্রতিবেশী হিসেবে ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের ঐতিহাসিক ভূমিকা আছে, বর্তমানে অর্থনীতি ও বাণিজ্যে অনেক সংযোগ রয়েছে। আবার বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের দাদাগিরির মনোভাবও অগ্রহণযোগ্য। তবে মনে রাখতে হবে, ভারতও একইসঙ্গে চীনের সঙ্গে কৌশলগত প্রতিযোগিতায় রয়েছে। তবে বাংলাদেশকে ভারতের পথ অনুসরণ করতে হবে না, বরং শিক্ষা নিতে হবে। ভারত যেভাবে চীনের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে না গিয়ে বরং কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করেছে, বাংলাদেশকেও সেভাবে চলতে হবে। আমাদের কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে সরাসরি দাঁড়ানো নয়, বরং নিজের স্বার্থের জায়গা থেকে চলা উচিত। যুক্তরাষ্ট্রকে ‘না’ বলা মানেই শত্রুতা নয়, বরং সুস্পষ্ট ও স্বাধীন নীতির ইঙ্গিত। আজ যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বলে চীনকে এড়িয়ে চলতে, কাল বলবে অন্য কাউকে। তারপর যদি আমরা তাদের প্রত্যাশা পূরণ না করি, তাহলে তারা আমাদের নিয়েও অভ্যন্তরীণ প্রচার চালাবে, মানবাধিকার প্রশ্ন তুলবে, নির্বাচন প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করবে, ভিসা নীতি প্রয়োগ করবে। এমনকি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বা রপ্তানি শুল্ক বৃদ্ধির মতো ব্যবস্থা নিতে পারে। এসব কোনো কল্পনা নয়, বরং সাম্প্রতিক ইতিহাসে বহু দেশের সঙ্গে তারা এমন আচরণ করেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে যা করতে হবে তা হলো একটি স্বাধীন, স্বার্থসচেতন ও সুদূরপ্রসারী কূটনীতি গড়ে তোলা।

আমাদের কোনো পক্ষের দালাল হওয়া চলবে না। আমরা যদি এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসক্রিপশন নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিই, তাহলে শুধু আমাদের পররাষ্ট্রনীতি বিপন্ন হবে না—আমাদের অর্থনীতি, বিনিয়োগ এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনকি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাঁধে এক অপ্রয়োজনীয় শত্রুতা ও জটিলতা চাপিয়ে দেওয়া হবে। বাংলাদেশের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত—প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা, পরাশক্তিদের সঙ্গে কৌশলগত ভারসাম্য রাখা এবং কোনো পক্ষের হাতে ‘ইউজেবল স্টেট’ হয়ে না ওঠা। এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের কূটনীতিকদের বিচক্ষণতা, নীতিনির্ধারকদের সাহসিকতা এবং জাতির বিবেকের জাগরণ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বিশ্বরাজনীতির এই ভয়ংকর খেলায় কোনো ভুল পদক্ষেপই আমাদের চরম মাশুল দিতে বাধ্য করবে। এখন সময়—নিজেকে রক্ষা করার, আত্মসম্মান বজায় রাখার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি স্বাধীন, স্থিতিশীল ও সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করার। আজ আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসক্রিপশন মেনে চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিই, কাল আমেরিকার প্রয়োজন শেষ হলে তারা আমাদের প্রতি এমন ব্যবহার করবে, যেভাবে করেছে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া বা এখন করছে ভারতীয় অভিবাসীদের সঙ্গে। আর তখন ফিরে আসার পথ থাকবে না—কারণ প্রতিবেশীরা তখন আমাদের প্রতিপক্ষ হয়ে যাবে। তাই এখন প্রয়োজন—একটি ঠান্ডা মাথার বাস্তববাদী কূটনীতি। আমাদের উচিত বন্ধুত্বের ভিত্তিতে প্রতিটি দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করা, নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, নিজের অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা ধীরে ধীরে বাড়ানো এবং বিশেষ করে আমেরিকার কৌশলগত চাপে কোনো ফাঁদে না পড়ে, নিজেদের স্বাধীন অবস্থানকে নিরুৎসাহিত না করা। বাংলাদেশের একটিই কাজ—প্রতিবেশীদের সঙ্গে শত্রুতা নয়, বন্ধুত্বই হোক লক্ষ্য। ভূরাজনীতির ভয়ংকর খেলা থেকে নিজেকে রক্ষা করার একমাত্র উপায়—সতর্কতা, দূরদর্শিতা এবং আত্মসম্মান। যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য যে কোনো পরাশক্তির কৌশলগত ফাঁদ থেকে দূরে থাকতে না পারলে, বাংলাদেশ এক ভয়াবহ বিপদের মধ্যে পড়বে—যার দায় জাতি হিসেবেই আমাদের বহন করতে হবে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

( এই লেখার মতামত লেখকের নিজস্ব)