০৭:৩৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

আলু চাষের ভবিষ্যৎ: কৃষক উৎপাদন খরচের পাঁচ ভাগের এক ভাগ দাম পায় না

উৎপাদন ব্যয় ও বাজার মূল্যের বৈপরীত্য

২০২৫ সালে বাংলাদেশের কৃষকরা প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে গড়ে ২২ টাকা ব্যয় করেছেন। বীজসারকীটনাশকসেচশ্রম ও পরিবহনসহ নানা খরচের হিসাব ধরলে প্রতিটি কৃষকের জন্য এই ব্যয় বাস্তব এবং অনিবার্য। কিন্তু কৃষিপণ্যের বাজারে যখন সেই আলু বিক্রির পালা আসেতখন কৃষকদের হাতে ফিরছে মাত্র ৪ টাকা প্রতি কেজি! এই চরম বৈপরীত্য শুধু কৃষকদের হতাশই করছে নাবরং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতির ভবিষ্যৎকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

কৃষকদের আর্থিক ক্ষতি এবং ঋণের বোঝা

গরিব ও প্রান্তিক কৃষকরা মূলত ঋণ নিয়ে চাষাবাদ শুরু করেন। উৎপাদনের খরচ পুষিয়ে লাভ তো দূরের কথামূলধনই ফেরত পাচ্ছেন না তারা। মাঠপর্যায়ের অনেকে এখন চাষ বন্ধের কথা ভাবছেনকেউ-বা আবার জমি বিক্রি করে অন্য পেশায় চলে যাওয়ার চিন্তা করছেন। ব্যাংক ঋণের পাশাপাশি এনজিও ও মহাজনের চড়া সুদের ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে অনেক কৃষক বর্তমানে দারুণ সংকটে পড়েছেন।

আলু চাষ করার উপযুক্ত সময় এখনই

বাজার ব্যবস্থাপনায় অব্যবস্থা

আলু উৎপাদন ভালো হলেও বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনায় নজিরবিহীন অব্যবস্থা রয়েছে। কৃষক ও ভোক্তার মধ্যবর্তী অংশে রয়েছে একাধিক দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীযারা মূলত লাভের বড় অংশ নিয়ে নিচ্ছে। সরকারি নীতিমালার অভাবসরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহের কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদিত আলুর ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না কৃষকরা।

সরকারি সহায়তা ও নীতির ব্যর্থতা

যদিও কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রতি বছর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়বাস্তবে তার প্রভাব মাঠে পড়ে না। কৃষক পর্যায়ে সংগ্রহকেন্দ্রহিমাগার সুবিধা বা মূল্য সংরক্ষণ নীতির যথাযথ বাস্তবায়ন নেই। একদিকে কৃষক কম দামে বিক্রি করছেনঅন্যদিকে ভোক্তা পর্যায়ে আলুর দাম ২০২৫ টাকা পর্যন্ত উঠছেএই দ্বৈত বাস্তবতা রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতা নির্দেশ করে।

ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা: কী হবে আলু চাষের?

যদি এই পরিস্থিতি চলতে থাকেতবে আগামী ২৩ বছরে অনেক কৃষকই আলু চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। এতে দেশে আলুর উৎপাদন হ্রাস পেতে পারেযা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। এছাড়া কৃষি খাত থেকে কৃষকদের সরে যাওয়া গ্রামীণ অর্থনীতিতে চরম মন্দা সৃষ্টি করতে পারে।

কৃষি বিভাগের সকল খবর - সমকাল

উত্তরণের সম্ভাব্য পথ

১. সরকারি হিমাগার ব্যবস্থার সম্প্রসারণ: চাষ মৌসুমের শেষে কৃষক যেন আলু সংরক্ষণ করতে পারে এবং ভালো দামে বিক্রি করতে পারে।
২. কৃষকের সরাসরি বিপণন সুযোগ: কৃষক বাজারঅ্যাপ-ভিত্তিক বিক্রি বা কো-অপারেটিভ মডেলের মাধ্যমে কৃষক যেন ভোক্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হতে পারেন।
৩. ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ ও ক্রয় গ্যারান্টি: সরকারের উচিত একটি ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করা এবং সেই দামে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে আলু ক্রয়ের ব্যবস্থা করা।
৪. রপ্তানির পথ উন্মুক্ত করা: দেশে যখন উদ্বৃত্ত আলু থাকেতখন তা রপ্তানি করে কৃষকদের লাভবান করার উদ্যোগ নিতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ামধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে আলুর চাহিদা রয়েছে।

বাংলাদেশের কৃষি এখনও প্রধান অর্থনৈতিক খাতগুলোর একটিএবং আলু অন্যতম প্রধান ফসল। কিন্তু যদি উৎপাদন ব্যয় ২২ টাকা হয়ে যায় এবং বিক্রিমূল্য থাকে ৪ টাকাতবে সেই কৃষক দীর্ঘদিন এই চাষ টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। ভবিষ্যৎ কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জন্য এটি এক বড় হুমকি। এখনই সময়নীতি নির্ধারকদের জেগে ওঠারকৃষকের পাশে দাঁড়ানোর এবং কৃষিকে টিকিয়ে রাখার। তা না হলেদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ জীবনব্যবস্থার উপর ধস নামা অনিবার্য।

বন্ধুত্বের গল্প হোক রঙ বাংলাদেশ’র রঙিন আয়োজনে

আলু চাষের ভবিষ্যৎ: কৃষক উৎপাদন খরচের পাঁচ ভাগের এক ভাগ দাম পায় না

১১:৩০:৩৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

উৎপাদন ব্যয় ও বাজার মূল্যের বৈপরীত্য

২০২৫ সালে বাংলাদেশের কৃষকরা প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে গড়ে ২২ টাকা ব্যয় করেছেন। বীজসারকীটনাশকসেচশ্রম ও পরিবহনসহ নানা খরচের হিসাব ধরলে প্রতিটি কৃষকের জন্য এই ব্যয় বাস্তব এবং অনিবার্য। কিন্তু কৃষিপণ্যের বাজারে যখন সেই আলু বিক্রির পালা আসেতখন কৃষকদের হাতে ফিরছে মাত্র ৪ টাকা প্রতি কেজি! এই চরম বৈপরীত্য শুধু কৃষকদের হতাশই করছে নাবরং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতির ভবিষ্যৎকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

কৃষকদের আর্থিক ক্ষতি এবং ঋণের বোঝা

গরিব ও প্রান্তিক কৃষকরা মূলত ঋণ নিয়ে চাষাবাদ শুরু করেন। উৎপাদনের খরচ পুষিয়ে লাভ তো দূরের কথামূলধনই ফেরত পাচ্ছেন না তারা। মাঠপর্যায়ের অনেকে এখন চাষ বন্ধের কথা ভাবছেনকেউ-বা আবার জমি বিক্রি করে অন্য পেশায় চলে যাওয়ার চিন্তা করছেন। ব্যাংক ঋণের পাশাপাশি এনজিও ও মহাজনের চড়া সুদের ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে অনেক কৃষক বর্তমানে দারুণ সংকটে পড়েছেন।

আলু চাষ করার উপযুক্ত সময় এখনই

বাজার ব্যবস্থাপনায় অব্যবস্থা

আলু উৎপাদন ভালো হলেও বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনায় নজিরবিহীন অব্যবস্থা রয়েছে। কৃষক ও ভোক্তার মধ্যবর্তী অংশে রয়েছে একাধিক দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীযারা মূলত লাভের বড় অংশ নিয়ে নিচ্ছে। সরকারি নীতিমালার অভাবসরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহের কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদিত আলুর ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না কৃষকরা।

সরকারি সহায়তা ও নীতির ব্যর্থতা

যদিও কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রতি বছর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়বাস্তবে তার প্রভাব মাঠে পড়ে না। কৃষক পর্যায়ে সংগ্রহকেন্দ্রহিমাগার সুবিধা বা মূল্য সংরক্ষণ নীতির যথাযথ বাস্তবায়ন নেই। একদিকে কৃষক কম দামে বিক্রি করছেনঅন্যদিকে ভোক্তা পর্যায়ে আলুর দাম ২০২৫ টাকা পর্যন্ত উঠছেএই দ্বৈত বাস্তবতা রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতা নির্দেশ করে।

ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা: কী হবে আলু চাষের?

যদি এই পরিস্থিতি চলতে থাকেতবে আগামী ২৩ বছরে অনেক কৃষকই আলু চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। এতে দেশে আলুর উৎপাদন হ্রাস পেতে পারেযা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। এছাড়া কৃষি খাত থেকে কৃষকদের সরে যাওয়া গ্রামীণ অর্থনীতিতে চরম মন্দা সৃষ্টি করতে পারে।

কৃষি বিভাগের সকল খবর - সমকাল

উত্তরণের সম্ভাব্য পথ

১. সরকারি হিমাগার ব্যবস্থার সম্প্রসারণ: চাষ মৌসুমের শেষে কৃষক যেন আলু সংরক্ষণ করতে পারে এবং ভালো দামে বিক্রি করতে পারে।
২. কৃষকের সরাসরি বিপণন সুযোগ: কৃষক বাজারঅ্যাপ-ভিত্তিক বিক্রি বা কো-অপারেটিভ মডেলের মাধ্যমে কৃষক যেন ভোক্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হতে পারেন।
৩. ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ ও ক্রয় গ্যারান্টি: সরকারের উচিত একটি ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করা এবং সেই দামে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে আলু ক্রয়ের ব্যবস্থা করা।
৪. রপ্তানির পথ উন্মুক্ত করা: দেশে যখন উদ্বৃত্ত আলু থাকেতখন তা রপ্তানি করে কৃষকদের লাভবান করার উদ্যোগ নিতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ামধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে আলুর চাহিদা রয়েছে।

বাংলাদেশের কৃষি এখনও প্রধান অর্থনৈতিক খাতগুলোর একটিএবং আলু অন্যতম প্রধান ফসল। কিন্তু যদি উৎপাদন ব্যয় ২২ টাকা হয়ে যায় এবং বিক্রিমূল্য থাকে ৪ টাকাতবে সেই কৃষক দীর্ঘদিন এই চাষ টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। ভবিষ্যৎ কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জন্য এটি এক বড় হুমকি। এখনই সময়নীতি নির্ধারকদের জেগে ওঠারকৃষকের পাশে দাঁড়ানোর এবং কৃষিকে টিকিয়ে রাখার। তা না হলেদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ জীবনব্যবস্থার উপর ধস নামা অনিবার্য।