গৃহস্থালির গ্যাস: ১০ মাসে মূল্য কত বেড়েছে?
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত সময়কালে গৃহস্থালি ব্যবহারের জন্য তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)-এর দাম একাধিকবার বেড়েছে। বিগত ১০ মাসে গ্যাসের দাম গড়ে ৪০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে বলে ভোক্তারা অভিযোগ করছেন। যদিও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) তথ্য অনুযায়ী, সরকার গৃহস্থালি গ্যাসের দাম সরাসরি বাড়িয়েছে দুই দফায়।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক চুলার জন্য গৃহস্থালি গ্যাসের মাসিক বিল ছিল ৯৯০ টাকা এবং দুই চুলার জন্য ১,০৮০ টাকা। ২০২৫ সালের জুলাইতে এসে এক চুলার বিল দাঁড়িয়েছে ১,৩৫০ টাকা এবং দুই চুলার জন্য ১,৪৪০ টাকা। এর বাইরে সিলিন্ডার গ্যাসের দামও একাধিকবার পরিবর্তিত হয়েছে, যা সাধারণ গ্রাহকদের খরচ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
মধ্যবিত্ত পরিবার: রান্না করা এখন বিলাস?
ধানমন্ডির গৃহবধূ শামসুন্নাহার বলেন,
“আগে মাসে ১,০৮০ টাকা দিয়ে গ্যাস বিল দিতাম, এখন সেটা ১,৪৪০ টাকা। একই রান্না, একই চুলা, কিন্তু খরচ বেশি। আমরা তো আয় বাড়াইনি, বরং কষ্ট করে চালাতে হচ্ছে। সবকিছুর দামই বাড়ছে—তেল, ডাল, চাল, তার উপর গ্যাস!”
মিরপুরের আরেক গৃহবধূ রিনা আক্তার জানান,
“আমরা সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করি। গত বছর প্রতি সিলিন্ডার ১,২৫০ টাকায় কিনতাম, এখন তা প্রায় ১,৬০০ টাকা। অনেক সময় দোকানদাররা মজুত করে রাখে, দাম বাড়ার পর বিক্রি করে। এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বাড়ে।”
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বিপাকে
পুরান ঢাকার একটি ক্ষুদ্র চায়ের দোকান চালান আব্দুর রহিম। তার ভাষায়,
“গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে এখন অনেক সময় সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করতে হয়। এক সিলিন্ডার আগের চেয়ে ৩৫০–৪০০ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এতে খরচ বেড়ে যায়, কিন্তু ক্রেতাদের কাছ থেকে দাম বাড়ানো যাচ্ছে না।”
চট্টগ্রামের হোটেল ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন,
“হোটেলে রুটি, ভাত, তরকারি রান্না করতে দিনে অন্তত দুটি সিলিন্ডার লাগে। গ্যাসের দাম বাড়ায় প্রতিদিনই অতিরিক্ত হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। এই চাপ সামাল দেওয়া কঠিন।”
নিম্ন আয়ের মানুষ: গ্যাস বিলের জন্য অন্য খরচ কাটছাঁট
গাজীপুরের একজন পোশাক কারখানার কর্মী রওশন আরা বলেন,
“গ্যাসের বিল এত বেড়ে গেছে যে এখন আমাদের বাচ্চাদের দুধ কিনতে পারছি না। কিছু করার নেই, সিলিন্ডার লাগতেই হয়। মাঝে মাঝে কেরোসিন দিয়েও চালাতে হয়,যা স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।”
আইনজীবীদের অভিমত: খরচ বাড়লেও আয় বাড়ছে না
ঢাকার এক আইনজীবী ফারজানা সুলতানা বলেন,
“আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পেশাজীবীদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, কিন্তু আয়ের উৎস বাড়ছে না। বিচারালয়ে এখন কাজ কম, মামলার সংখ্যা কমে গেছে, ফলে উপার্জনও সীমিত। এর মাঝে গ্যাস বিল বেড়ে যাওয়া মানেই পারিবারিক বাজেট ভেঙে যাওয়া।”
অর্থনীতিবিদের বিশ্লেষণ: দুর্বল পরিকল্পনা ও আমদানিনির্ভরতা দায়ী
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একজন সাবেক বলেন,
“বাংলাদেশ এখনও গ্যাস আমদানিতে অনেকাংশে নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বাড়লে দেশে সেটার প্রভাব পড়ে। তবে সমস্যা হচ্ছে, সরকার পর্যাপ্ত গ্যাস রিজার্ভ গড়ে তুলতে পারেনি, আবার গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থায় অনেক অপচয় হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন,
“বিকল্প জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ না বাড়ালে ভবিষ্যতে এই সংকট আরও তীব্র হবে। একইসঙ্গে গ্যাস ব্যবহারে শ্রেণিভেদ করা দরকার—অর্থাৎ শিল্প ও অভিজাত আবাসিক এলাকায় আলাদা মূল্য নির্ধারণ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে কিছুটা ছাড় দেওয়া যেতে পারে।”
রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর হলেও প্রভাব গভীর
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি এমন একটি ইস্যু যা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর হলেও সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করার মতো কার্যকর কোনো পরিকল্পনা বা স্বচ্ছতা এখন পর্যন্ত সামনে আসেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৬ সালের বাজেটের আগে নতুন করে আবার গ্যাসের দাম সমন্বয় হতে পারে—যা আরও জনদুর্ভোগ বাড়াবে।
গত ১০ মাসে গৃহস্থালি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠেছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে গৃহিণী, আইনজীবী থেকে শুরু করে পোশাকশ্রমিক—সব শ্রেণির মানুষই এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ও বিপর্যস্ত। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটা শুধু দাম বাড়ার সমস্যা নয়, বরং পুরো জ্বালানি নীতির পুনর্বিন্যাসের সময় এখনই।
সরকার যদি এই সংকটে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা না নেয়, তাহলে সামনের দিনগুলোতে কেবল গ্যাস নয়, জীবনের প্রতিটি খাতেই ব্যয় ও যন্ত্রণার ঘনঘটা বাড়বে—এ আশঙ্কা অমূলক নয়।