রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: এক বছরের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয়। এই আলোচনায় পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের কর্মকাণ্ডের কঠোর মূল্যায়নের আহ্বান জানান।
হোসেন জিল্লুর রহমানের মতে, গত এক বছরে “মিষ্টি কথা, ভালো উদ্যোগ” হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখন জরুরি হলো পাওনার হিসাব কষা—বিচার, সংস্কার, নির্বাচন—এই তিন ক্ষেত্রে কী অর্জিত হয়েছে, সেটিই হওয়া উচিত আলোচনার মূল কেন্দ্র। একই সঙ্গে ভবিষ্যতের উত্তরণের স্পষ্ট পথরেখা টানতে হবে।
মানুষকে দর্শক থেকে অংশগ্রহণকারী করা
তিনি বলেন, মানুষকে গণনার বাইরে রেখে দেওয়া হয়েছে; বৃহৎ পরিবর্তনের পরও তারা দর্শক হয়ে আছে। মূল কাজ হলো—নাগরিককে আবার সক্রিয় অংশগ্রহণে ফিরিয়ে আনা। নির্বাচন একটি উপায় হলেও অন্য পথও ভাবতে হবে। সক্ষমতার যে ধস নেমেছে, তার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জরুরি; প্রয়োজনে দায়িত্বশীলদের বিদায় চাইতে হতে পারে, যাতে তারা শুনতে বাধ্য হন।
‘বাংকার মেন্টালিটি’ ও কাগুজে ঐকমত্যের সমালোচনা
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে চার দলের নেতাদের বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার আলোচনায় জনগণ কার্যত বাদ পড়ছে। ‘বাংকার মেন্টালিটি’—অর্থাৎ একটি সংকীর্ণ লেন্স দিয়ে সবকিছু দেখা এবং জনগণকে সহযোগী না ধরে কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির ওপর নির্ভর করা—এভাবে সমস্যার সমাধান হবে না।
তার মতে, ‘কাগুজে ঐকমত্য’ অর্জনের চেষ্টায় জাতীয় ঐক্যকে পিছনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বইপুস্তকীয় যোগ্যতার প্রদর্শনী চলছে, কিন্তু বাস্তব সক্ষমতা ভয়াবহভাবে কমে গেছে—নীতি নির্ধারণ, মন্ত্রণালয় পরিচালনা, দরকষাকষি—সবখানেই এই ধস স্পষ্ট।
শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা ও বেকারত্ব: ভয়াবহ চিত্র
তিনি শিক্ষা খাতে হতাশা, আইনশৃঙ্খলায় অবনতি এবং বেকারত্বের বিস্তারকে ‘পাওনার হিসাব’-এর অংশ হিসেবে উল্লেখ করেন। বগুড়ার উদাহরণ দিয়ে বলেন, ছুরি মারা এখন ‘স্বাভাবিক’ হয়েছে বলেই শুনেছেন। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, তরুণদের মধ্যে নারী নির্যাতনের উচ্চ হার এবং কর্মসংস্থানের সংকট তার বক্তৃতায় উঠে আসে। ঢাকা শহরে ইজি বাইকসহ নতুন পেশায় ঝুঁকে পড়া মানুষদের প্রসঙ্গও তিনি উল্লেখ করেন।
প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির প্রত্যাবর্তন
তার ভাষায়, গত বছরের ডিসেম্বরে একসময় ধারণা ছিল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভিন্ন পথে এগোনোর চেষ্টা হবে। কিন্তু পরবর্তীতে ‘নরমাল স্টেট ডাইনামিকস’ বুঝে গেছে বড় কিছু হবে না—ফলে ডিসেম্বরের পর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি পূর্ণোদ্যমে ফিরে এসেছে। শেখ হাসিনার পলায়ন ও সরকারের পতনের পর আশা জাগলেও আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ব আবার জেঁকে বসেছে।
গুটিয়ে নেওয়া নাগরিক: এক সতর্ক সংকেত
যারা পরিবর্তন এনেছিল, তারা এখন নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে—এটা স্থায়ী নয়, বরং একটি বার্তা। তাদের আশা ভেঙেছে, তারা দেখছে কথার ফুলঝুরি ও প্রাতিষ্ঠানিক চালবাজির আড়ালে অন্য কিছু চলছে—এমনই পর্যবেক্ষণ দেন তিনি।
ন্যায়বিচার বনাম প্রতিশোধ
ন্যায়ভিত্তিক সমাজের লক্ষ্যে জনপ্রিয় ‘ইনসাফ’ ধারণাকে স্মরণ করিয়ে তিনি সতর্ক করেন—ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথ হিসেবে প্রতিশোধকে বেছে নেওয়া হলে লক্ষ্য ও উপায়ের মধ্যে অমিল তৈরি হয়। প্রতিশোধের জ্বর ছড়িয়ে সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বলে তিনি প্রশ্ন তোলেন।
অংশগ্রহণকারীরা
প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফের সঞ্চালনায় গোলটেবিলে অংশ নেন লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন।
শুরুতেই উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় শোক জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।