১০:২৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ: জলজ স্বর্গের একদিনের গল্প

সিলেটের বুকে এক বিস্ময়

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় অবস্থিত ‘টাঙ্গুয়ার হাওর’ প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়। ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই হাওর কেবল একটি জলাভূমি নয়, এটি জীববৈচিত্র্য, প্রকৃতি আর লোকজ সংস্কৃতির এক অনন্য মিলনস্থল। বর্ষায় জলরাজ্যে পরিণত হওয়া টাঙ্গুয়ার হাওর যেন এক ভাসমান স্বর্গ। এ হাওরে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য, নৌকাভ্রমণ, মেঘালয়ের পাহাড়ের পেছনে সূর্য লুকানো আর রাতের তারাভরা আকাশ—সবকিছু মিলেই এক স্বপ্নময় অভিজ্ঞতা।

যাত্রা শুরু: সুনামগঞ্জের পথে

ঢাকা থেকে বাসে করে সরাসরি সুনামগঞ্জ পৌঁছানো যায়, সময় লাগে প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা। সেখান থেকে সিএনজি বা স্থানীয় বাসে তাহিরপুর যাওয়া যায়। আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ভোরবেলায়। সুনামগঞ্জ পৌঁছানোর পর শহরের কাঁচাবাজার ঘুরে কিছু ফলমূল ও শুকনো খাবার সংগ্রহ করে আমরা সিএনজিতে উঠি। শহর ছাড়িয়ে প্রকৃতির কোলে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট—দিগন্তজোড়া ধানক্ষেত, নদী, ছোট ছোট খাল, মেঘে ঢাকা পাহাড়ের রেখা।

টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ সহায়িকা – পর্যটন বিচিত্রা

টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রথম স্পর্শ

তাহিরপুর পৌঁছে স্থানীয় ইঞ্জিনচালিত নৌকায় উঠি আমরা। হাওরের জলরাশির মধ্যে নৌকা ভেসে চলেছে ধীরে ধীরে। চারপাশে শুধু পানি আর পানি, দূরে খালের মাথায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে হিজল-করচের গাছ। পাখির কূজন আর নৌকার শব্দ মিলেমিশে এক ধরনের মন ছুঁয়ে যাওয়া অনুভূতি তৈরি করে। জলরাশি এতটাই স্বচ্ছ যে পানির নিচে মাছের চলাফেরা পর্যন্ত দেখা যায়। বর্ষাকালে হাওরের বিস্তৃতি আরও বেড়ে যায়, এই সময়ে হাওর যেন এক বিশাল লেক।

নৌকায় রাত: তারার নিচে অন্যরকম অভিজ্ঞতা

আমরা একটি মাঝারি আকারের কাঠের নৌকা ভাড়া করেছিলাম, যার ছাদে বসে সূর্যাস্ত দেখার মতো সৌভাগ্য ক’জনের হয়! মেঘালয়ের পাহাড়ের গায়ে সূর্য ধীরে ধীরে লুকিয়ে যাচ্ছিল, আকাশে ছড়িয়ে পড়ছিল কমলা-গোলাপি রঙের ক্যানভাস। রাতে নৌকার ছাদেই বিছানা পেতে ঘুমিয়েছিলাম। উপরে তারাভরা আকাশ, চারপাশে নিস্তব্ধ জল, মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসছিল পাখির ডাক। এই অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।

টাঙ্গুয়ার হাওর - যাওয়ার উপায় ও ঘোরাঘুরির বিস্তারিত ভ্রমণ গাইড » আদার ব্যাপারী

হাওরের জীববৈচিত্র্য: পাখি ও জলজ প্রাণী

টাঙ্গুয়ার হাওর শুধুমাত্র পর্যটকদের জন্য নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য অঞ্চলও। এখানে শীতকালে হাজার হাজার অতিথি পাখি আসে—বকের ঝাঁক, পাতি সরালি, গাঙচিল, জলমুরগি। এছাড়া বিভিন্ন জাতের মাছেরও প্রাচুর্য রয়েছে। স্থানীয় জেলেরা পরিবেশবান্ধব উপায়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। হাওরের পানিতে ছিপ ফেলেই আমরা ধরেছিলাম কয়েকটি ছোট মাছ, যেগুলো নৌকার রান্নাঘরে রান্না করে খেয়েছিলাম।

স্থানীয় জীবনধারা ও সংস্কৃতি

তাহিরপুরের মানুষের জীবন হাওরের উপর নির্ভরশীল। তারা মাছ ধরে, নৌকা চালায়, পর্যটকদের জন্য গাইড হিসেবে কাজ করে। স্থানীয় ভাষায় কথা বলার ভঙ্গি, তাদের অতিথিপরায়ণতা আর সারল্য মুগ্ধ করে। নৌকার মাঝি আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন একটি ছোট চরে, যেখানে স্থানীয় কিছু কৃষক ধান কেটেছিলেন। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা হাওরের জীবন নিয়ে গর্ব অনুভব করেন। হাওরের কচুরিপানা, পদ্মফুল আর নরম কাদার গন্ধ যেন হৃদয়ে মিশে যায়।

Movement of tourist boats suspended in Tanguar Haor

বিদায়ের ক্ষণ: ফিরে আসার মনখারাপ

দুই দিনের এই ভ্রমণ শেষ হয়েছিল এক চিরন্তন বিষাদ নিয়ে। হাওর ছাড়ার সময় মন যেন কেঁদে উঠছিল। ঢাকায় ফিরে আসার বাসে বসে বারবার মনে পড়ছিল সেই নির্জনতা, সেই জলরাশি আর রাতের তারা। টাঙ্গুয়ার হাওর শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, এটি আত্মার সঙ্গে প্রকৃতির এক সেতুবন্ধন।

যে কেউ ফিরে যেতে চায় বারবার

টাঙ্গুয়ার হাওর একবার দেখলে বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। যারা প্রকৃতি ভালোবাসেন, যাদের মন খোলা আকাশে ভাসতে চায়, যাদের হৃদয় খোঁজে শান্তি—তাদের জন্য টাঙ্গুয়ার হাওর এক আদর্শ গন্তব্য। এটি যেন এক নীরব ডাক, যে ডাকে সাড়া না দিলে মন শান্তি পায় না।

টাঙ্গুয়ার হাওরের জলজ অভিজ্ঞতা হৃদয়ে রেখে ফিরি নগর জীবনের ব্যস্ততায়কিন্তু মনে রয়ে যায় সেই জলের গান।

তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ: জলজ স্বর্গের একদিনের গল্প

০৩:০৬:০৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

সিলেটের বুকে এক বিস্ময়

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় অবস্থিত ‘টাঙ্গুয়ার হাওর’ প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়। ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই হাওর কেবল একটি জলাভূমি নয়, এটি জীববৈচিত্র্য, প্রকৃতি আর লোকজ সংস্কৃতির এক অনন্য মিলনস্থল। বর্ষায় জলরাজ্যে পরিণত হওয়া টাঙ্গুয়ার হাওর যেন এক ভাসমান স্বর্গ। এ হাওরে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য, নৌকাভ্রমণ, মেঘালয়ের পাহাড়ের পেছনে সূর্য লুকানো আর রাতের তারাভরা আকাশ—সবকিছু মিলেই এক স্বপ্নময় অভিজ্ঞতা।

যাত্রা শুরু: সুনামগঞ্জের পথে

ঢাকা থেকে বাসে করে সরাসরি সুনামগঞ্জ পৌঁছানো যায়, সময় লাগে প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা। সেখান থেকে সিএনজি বা স্থানীয় বাসে তাহিরপুর যাওয়া যায়। আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ভোরবেলায়। সুনামগঞ্জ পৌঁছানোর পর শহরের কাঁচাবাজার ঘুরে কিছু ফলমূল ও শুকনো খাবার সংগ্রহ করে আমরা সিএনজিতে উঠি। শহর ছাড়িয়ে প্রকৃতির কোলে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট—দিগন্তজোড়া ধানক্ষেত, নদী, ছোট ছোট খাল, মেঘে ঢাকা পাহাড়ের রেখা।

টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ সহায়িকা – পর্যটন বিচিত্রা

টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রথম স্পর্শ

তাহিরপুর পৌঁছে স্থানীয় ইঞ্জিনচালিত নৌকায় উঠি আমরা। হাওরের জলরাশির মধ্যে নৌকা ভেসে চলেছে ধীরে ধীরে। চারপাশে শুধু পানি আর পানি, দূরে খালের মাথায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে হিজল-করচের গাছ। পাখির কূজন আর নৌকার শব্দ মিলেমিশে এক ধরনের মন ছুঁয়ে যাওয়া অনুভূতি তৈরি করে। জলরাশি এতটাই স্বচ্ছ যে পানির নিচে মাছের চলাফেরা পর্যন্ত দেখা যায়। বর্ষাকালে হাওরের বিস্তৃতি আরও বেড়ে যায়, এই সময়ে হাওর যেন এক বিশাল লেক।

নৌকায় রাত: তারার নিচে অন্যরকম অভিজ্ঞতা

আমরা একটি মাঝারি আকারের কাঠের নৌকা ভাড়া করেছিলাম, যার ছাদে বসে সূর্যাস্ত দেখার মতো সৌভাগ্য ক’জনের হয়! মেঘালয়ের পাহাড়ের গায়ে সূর্য ধীরে ধীরে লুকিয়ে যাচ্ছিল, আকাশে ছড়িয়ে পড়ছিল কমলা-গোলাপি রঙের ক্যানভাস। রাতে নৌকার ছাদেই বিছানা পেতে ঘুমিয়েছিলাম। উপরে তারাভরা আকাশ, চারপাশে নিস্তব্ধ জল, মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসছিল পাখির ডাক। এই অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।

টাঙ্গুয়ার হাওর - যাওয়ার উপায় ও ঘোরাঘুরির বিস্তারিত ভ্রমণ গাইড » আদার ব্যাপারী

হাওরের জীববৈচিত্র্য: পাখি ও জলজ প্রাণী

টাঙ্গুয়ার হাওর শুধুমাত্র পর্যটকদের জন্য নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য অঞ্চলও। এখানে শীতকালে হাজার হাজার অতিথি পাখি আসে—বকের ঝাঁক, পাতি সরালি, গাঙচিল, জলমুরগি। এছাড়া বিভিন্ন জাতের মাছেরও প্রাচুর্য রয়েছে। স্থানীয় জেলেরা পরিবেশবান্ধব উপায়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। হাওরের পানিতে ছিপ ফেলেই আমরা ধরেছিলাম কয়েকটি ছোট মাছ, যেগুলো নৌকার রান্নাঘরে রান্না করে খেয়েছিলাম।

স্থানীয় জীবনধারা ও সংস্কৃতি

তাহিরপুরের মানুষের জীবন হাওরের উপর নির্ভরশীল। তারা মাছ ধরে, নৌকা চালায়, পর্যটকদের জন্য গাইড হিসেবে কাজ করে। স্থানীয় ভাষায় কথা বলার ভঙ্গি, তাদের অতিথিপরায়ণতা আর সারল্য মুগ্ধ করে। নৌকার মাঝি আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন একটি ছোট চরে, যেখানে স্থানীয় কিছু কৃষক ধান কেটেছিলেন। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা হাওরের জীবন নিয়ে গর্ব অনুভব করেন। হাওরের কচুরিপানা, পদ্মফুল আর নরম কাদার গন্ধ যেন হৃদয়ে মিশে যায়।

Movement of tourist boats suspended in Tanguar Haor

বিদায়ের ক্ষণ: ফিরে আসার মনখারাপ

দুই দিনের এই ভ্রমণ শেষ হয়েছিল এক চিরন্তন বিষাদ নিয়ে। হাওর ছাড়ার সময় মন যেন কেঁদে উঠছিল। ঢাকায় ফিরে আসার বাসে বসে বারবার মনে পড়ছিল সেই নির্জনতা, সেই জলরাশি আর রাতের তারা। টাঙ্গুয়ার হাওর শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, এটি আত্মার সঙ্গে প্রকৃতির এক সেতুবন্ধন।

যে কেউ ফিরে যেতে চায় বারবার

টাঙ্গুয়ার হাওর একবার দেখলে বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। যারা প্রকৃতি ভালোবাসেন, যাদের মন খোলা আকাশে ভাসতে চায়, যাদের হৃদয় খোঁজে শান্তি—তাদের জন্য টাঙ্গুয়ার হাওর এক আদর্শ গন্তব্য। এটি যেন এক নীরব ডাক, যে ডাকে সাড়া না দিলে মন শান্তি পায় না।

টাঙ্গুয়ার হাওরের জলজ অভিজ্ঞতা হৃদয়ে রেখে ফিরি নগর জীবনের ব্যস্ততায়কিন্তু মনে রয়ে যায় সেই জলের গান।