০৩:৪২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

বিমান বিধ্বস্তের পর পরিস্থিতি সামলাতে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে

  • Sarakhon Report
  • ০৬:৪৫:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
  • 11

ঢাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে শিশুদের হতাহতের মর্মান্তিক ঘটনার পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার সমন্বয়হীনতা ও ব্যর্থতার নজির স্থাপন করেছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।

এই ঘটনায় সরকারের সক্ষমতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, একইসঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে–– জনবহুল এলাকায় কেন যুদ্ধবিমান চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে এবং ঘটনার দায় কার?

একসঙ্গে এত শিশুর মৃত্যু কমই দেখেছে বাংলাদেশ। গত সোমবার যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের সময় বিধ্বস্ত হয়ে স্কুলটিতে আছড়ে পড়লে শিশুদের র্মমান্তিক মৃত্যু ও হতাহতের ঘটনা দেশজুড়ে মানুষের মাঝে আবেগ সৃষ্টি করে।

কিন্তু পরবর্তী পরিস্থিতি সামলাতে সরকার যে সব পদক্ষেপ নেয়, প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েই প্রশ্ন ওঠে এবং নানা আলোচনার জন্ম দেয় বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।

তারা বলছেন, এই ঘটনায় সরকারের সিদ্ধান্ত নিতে গড়িমসি, সমন্বয়ের ঘাটতি, দক্ষতার অভাব স্পষ্ট হয়েছে। বড় কোনো দুর্ঘটনা সামাল দিতে জাতীয় সক্ষমতা, ব্যবস্থাপনা কতটা ভঙ্গুর, তা আরেকবার প্রকাশ পেয়েছে।

রাজনীতিকদের কেউ কেউ বলছেন, এই দুর্ঘটনায় সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা কমেছে।

সরকার আসলে ঘটনার গুরুত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিল কি না, এমন প্রশ্নও উঠছে।

বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে সরকারের দুই সংস্থার দুই রকম তথ্যেও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে
বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে সরকারের দুই সংস্থার দুই রকম তথ্যেও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে

সরকারের ব্যর্থতার প্রশ্ন কেন আসছে?

বিধ্বস্ত বিমানের আগুনে পুড়ে শিশুদের হতাহতের ঘটনা নিয়ে অভিভাবকসহ সারাদেশের মানুষ যখন উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি, ভিডিওসহ নানা তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে–– তখনও হতাহতের পরিসংখ্যান তুলে ধরতে অনেক সময় নেওয়া হয়।

দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর সরকারের পক্ষ থেকে থেকে নিহত ও আহতদের পরিসংখ্যান দেওয়া হয়। ফলে মৃত্যুর সংখ্যা লুকানো হচ্ছে কি না––এমন সন্দেহ তৈরি হয় মানুষের মধ্যে।

উচ্চ মাধ্যমিক বা এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা ছিল ওই দুর্ঘটনার পরদিন। মাইলস্টোন স্কুলেও পরীক্ষার্থী রয়েছে। এই পরীক্ষা স্থগিত করার ক্ষেত্রেও সরকারের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে।

সোমবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে পরীক্ষা স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। তাও সেই সিদ্ধান্তের কথা প্রথমে জানা যায় একজন উপদেষ্টার ফেসবুক পোস্ট থেকে।

পরীক্ষা হবে কি না, সেটা জানার জন্য পরীক্ষার্থীরা সারারাত সামাজিক মাধ্যমে চোখ রাখবেন-এমন চিন্তা করা হলে তা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয় না বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।

সরকারের পক্ষ থেকে এভাবে সিদ্ধান্ত আসায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেক পরীক্ষার্থী পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার পর স্থগিত হওয়ার খবর জানতে পারে। এ নিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন।

আহতদের চিকিৎসায় হাসপাতালে বিশৃঙ্খল পরিবেশ নিয়ন্ত্রণেও সরকারের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ ওঠে।

শতাধিক আহতকে ঢাকায় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বেশি সংখ্যক আহত শিশুকে ভর্তি করা হয় জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে।

সোমবার দুর্ঘটনার পর আগুনে পুড়ে গুরুতর আহত শিশুদের একের পর এক যখন সেই হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল, তখন সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা তাদের প্রটোকল, দলবলসহ সেখানে পরিদর্শনে গেছেন। সেটা উপকারের চেয়ে আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটায়।

বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা দলবেধে হাসপাতালে গেছেন। তাদের নেতা-কর্মীদের ভিড়ে বার্ন ইনস্টিটিউটের ভেতরে-বাইরে তৈরি হয়েছিল বিশৃঙ্খল পরিবেশ।

এর বাইরে ছিল সাংবাদিক, বেসরকারি স্বেচ্ছ্বাসেবক ও উৎসুক মানুষের ভিড়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে হাসপাতালে ভিড় না করতে চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে বার বার আবেদন জানাতে হয়।

দুর্ঘটনার পর আহতদের চিকিৎসা যখন বড় ইস্যু বা প্রধান অগ্রাধিকার, সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রথমদিনে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। এ নিয়েও চলছে সমালোচনা।

অন্যদিকে, প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজ থেকে অর্থ সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে পোস্ট দেওয়া হয়। পরে সেই পোস্ট সরিয়ে নেওয়া হয় ব্যাপক সমালোচনার মুখে।

এ বিষয়গুলো খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মনে করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। নাগরিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার অধ্যাপক মুহাম্মদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সরকারের পদক্ষেপগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে শিশুতোষ, খামখেয়ালি আচরণ প্রকাশ পেয়েছে। তাদের সংবেদনশীল মনে হয়নি।”

সেকারণে সরকারের প্রতি হতাহতের তথ্য গোপন করার সন্দেহ দেখা দেয় ও ব্যর্থতার বিষয় আলোচনায় এসেছে বলে মনে করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

যদিও সরকারের একাধিক উপদেষ্টা বিবিসিকে বলেন, সরকারের পদক্ষেপগুলো প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা রয়েছে। সেজন্য অনেক অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।

তবে বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের দুর্বলতা, সমন্বয়হীনতা দৃশ্যমান হয়েছে। আর সরকারের কারণেই প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ছয় দফা দাবিতে বিক্ষোভ করে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা, তাতে যোগ দেয় আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও
ছয় দফা দাবিতে বিক্ষোভ করে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা, তাতে যোগ দেয় আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও

ক্ষোভ রুপ নিয়েছিল বিক্ষোভে

একদিকে মৃত্যুর সংখ্যা প্রকাশে বিলম্ব করা হয়। সে বিষয়টি মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষার্থীদেরও সন্দেহের মধ্যে ফেলে।

অন্যদিকে দুর্ঘটনার পর পরই সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা ঘটনাস্থলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। সে সময় স্কুলটির শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাউকে কাউকে লাঠিচার্জ, মারধর করার অভিযোগ ওঠে।

এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবার স্কুলে বিক্ষোভ করেন।

এরই মধ্যে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আববার ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম স্কুলটিতে গেলে বিক্ষোভকারীরা তাদের অবরুদ্ধ করে রাখে।

উপদেষ্টারা নয় ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর পুলিশের কড়া পাহারায় বিকল্প পথ দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন।

আর সচিবালয়ে বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে হয়েছে পুলিশকে লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত শেষ মুহূর্তে আসায় শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ওই বিক্ষোভে রুপ নিয়েছিল।

বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, সরকারের কর্মকাণ্ড যে ক্ষোভ তৈরি করেছে, তার প্রকাশ দেখা গেছে বিক্ষোভের মাধ্যমেও।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় বহু হতাহত হয়েছে
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় বহু হতাহত হয়েছে

ঢাকায় যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন

রাজধানীতে সামরিক স্থাপনা থাকা উচিত কি না–– এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ই আলোচনা হয়েছে। ঢাকা নগরীর ভেতরে বিমান ও নৌবাহিনী এবং এমনকি সেনানিবাস থাকা না থাকার প্রশ্নও উঠেছে বিভিন্ন সময়ের আলোচনায়।

এখন যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের সময় বিধ্বস্ত হয়ে স্কুলের অনেক শিশুর হতাতের ঘটনার প্রেক্ষাপটে ওই আলোচনা নতুন করে সামনে এসেছে।

বিশেষ করে জনবহুল এলাকায় যুদ্ধবিমান চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছে মাইলস্টোন স্কুল কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, এর অনুমতি মিলেছে কীভাবে-এই আলোচনাও চলছে।

বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, ঢাকা একটি জনবহুল শহর, যেখানে ঘন ঘন উঁচু ভবন, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনা আছে। এমন একটি শহরে যেকোনো দুর্ঘটনা অনেক মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

তাদেরও প্রশ্ন, ঘনবসতির বা জনবহুল ঢাকায় যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে কীভাবে?

বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলেন, সরকারগুলো মানুষের নিরাপত্তার বিষয়ে উদাসীন থেকেছে। সেকারণে বিকল্প পরিকল্পনা করা হয়নি। বর্তমানে ১১ মাস বয়সী অন্তর্বর্তী সরকার এত বড় দুর্ঘটনার পরও বিকল্প কোনো চিন্তা করতে পারবে, এমনটা তারা মনে করছেন না।

বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ও বেসরকারি বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত কমিটির প্রধান সালাহউদ্দিন এম রহমতুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যুদ্ধবিমান চালানোর জন্য যে দীর্ঘ রানওয়ে দরকার, তা বর্তমানে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও সিলেটে আছে। আমাদের বিমানবাহিনী চট্টগ্রাম রানওয়ে ব্যবহার করে, তবে সিলেটে অবস্থিত রানওয়েটি সীমান্ত এলাকা হওয়ায় সুবিধাজনক নয়।”

তিনি মনে করেন, লোকালয়ের বাইরে যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের জন্য বিকল্প ভাবনার বা পরিকল্পনা করার এখনই সময়।

কিন্তু সে ধরনের চিন্তার কোনো ইঙ্গিত নেই।

মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনার পর সামনে আসছে নানা প্রশ্ন
মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনার পর সামনে আসছে নানা প্রশ্ন

দায়-দায়িত্বের প্রশ্ন কেন তোলা হচ্ছে

যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। সামরিক খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে দোষারোপের বিষয় থাকে না। তবে প্রশ্ন থাকে দায়-দায়িত্বের।

তারা মনে করেন, যেহেতু এবার জনবহুল এলাকায় যুদ্ধবিমান চালানোর প্রশিক্ষণের সময় দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণহানি হয়েছে, এখানে লোকালয়ের বাইরে প্রশিক্ষণের বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিল। সরকার বা কর্তৃপক্ষ সে ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি। সেই প্রেক্ষাপটে তাদের দায়-দায়িত্বের প্রশ্ন আসছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।

এছাড়া যে ধরনের যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয়, সেই বিমানের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

মিগ টুয়েনটি ওয়ান যুদ্ধবিমান, যা এফ-সেভেন নামে পরিচিত, এই বিমান দিয়ে বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আধুনিক যুদ্ধবিমানের তুলনায় এতে নিরাপত্তাসম্পর্কিত ফিচার অনেক কম। এফ-সেভেনের মূল কাঠামোটাই বেশ পুরনো। এতে ‘ফ্লাই-বাই-ওয়্যার’ (এফবিডাব্লিউ) ব্যবস্থা নেই।

এ ধরনের ব্যবস্থায় পাইলটের দেওয়া নির্দেশনা বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত হয় এবং সে অনুযায়ী বিমানের বিভিন্ন অংশ পরিচালিত হয়। ফলে দুর্ঘটনার সংখ্যাও অন্যান্য যুদ্ধবিমানের চেয়ে বেশি বলে বলছেন এ সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞরা।।

তারা উল্লেখ করেন, এই এফ-সেভেন যুদ্ধ বিমান চীন বানানো শুরু করেছিল ১৯৬৬ সালে। চীন এই বিমান তৈরি বন্ধ করেছে ২০১৩ সালে।

সরকারি সূত্রে জানা গেছে, বাাংলাদেশের ৩৬টি এফ সেভেন যুদ্ধবিমান ছিল। এখন একটি বিধ্বস্ত হলো। এর আগে বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণ চলাকালে চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে তিনটি দুর্ঘটনা ঘটেছে।

সর্বশেষ ঢাকায় দুর্ঘটনার পর এ ধরনের যুদ্ধবিমান ব্যবহারের বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ ব্যাপারে সরকার ও কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব। তবে বিকল্প বা ভিন্ন কোনো পরিকল্পনা কখনো করা হয়নি। আর এ কারণেও দুর্ঘটনার দায় নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

১৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক
১৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক করেন বুধবার

রাজনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকেও সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

নানা প্রশ্ন, আলোচনা-সমালোচনার মুখে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দুই দিনে ১৭টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

সোমবার দুর্ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার রাতে অধ্যাপক ইউনূস বৈঠক করেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে।

পরদিন বুধবার তিনি এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ ১৩টি দলের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন।

এই দুটি বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা পরিস্থিতি সামলাতে দলগুলোর সহযোগিতা চেয়েছেন এবং ঐক্যের তাগিদ দিয়েছেন।

জানা গেছে, বিএনপি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কঠোর হতে বলেছে। আর সহযোগিতা ও ঐক্যের প্রশ্নে সব দলই একমত পোষণ করেছে।

তবে বুধবার ১৩টি দলের সঙ্গে বৈঠকে এই দলগুলোর নেতাদের কেউ কেউ সরকারের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, তারা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন, সরকার যখন সংকটে পড়ে, তখনই কেবল রাজনীতিকদের ডাকা হয়।

এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বিবিসি বাংলাকে বলেন, মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে শিশুদের হতাহতের ঘটনার পর সরকারের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এমনকি সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা কমেছে। এই বক্তব্য তিনি বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন।

রাজনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকেও সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন, সমালোচনা থেকে রেহাই মেলেনি বলা যায়। কোনো কোনো দলের নেতা সরকারের সমন্বয়হীনতার কথাও জোরালোভাবে তুলেছেন।

তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ নিয়ে সন্দেহ

দেশে বড় স্পর্শকাতর কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তদন্ত প্রতিবিদেন প্রকাশ করা হয়েছে, এমন ঘটনা বিরল।

সেকারণে মাইলস্টোন স্কুলে যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের সময় বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন কখনো প্রকাশ করা হবে কি না, সেই সন্দেহ রয়েছে।

ঘটনাটির ব্যাপারে বিমান বাহিনী ও সরকার দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

সাবেক একজন সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, দুর্ঘটনায় সরকারের ভূমিকায় এটা প্রমাণ হয়েছে যে, কোনো জটিল পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো সক্ষমতা নেই।

তিনি মনে করেন, সেজন্য ঘটনাটির কারণ অনুসন্ধান করে তা মানুষকে জানানো উচিত এবং তদন্তের ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

বিবিসি নিউজ বাংলা

বিমান বিধ্বস্তের পর পরিস্থিতি সামলাতে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে

০৬:৪৫:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

ঢাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে শিশুদের হতাহতের মর্মান্তিক ঘটনার পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার সমন্বয়হীনতা ও ব্যর্থতার নজির স্থাপন করেছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।

এই ঘটনায় সরকারের সক্ষমতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, একইসঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে–– জনবহুল এলাকায় কেন যুদ্ধবিমান চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে এবং ঘটনার দায় কার?

একসঙ্গে এত শিশুর মৃত্যু কমই দেখেছে বাংলাদেশ। গত সোমবার যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের সময় বিধ্বস্ত হয়ে স্কুলটিতে আছড়ে পড়লে শিশুদের র্মমান্তিক মৃত্যু ও হতাহতের ঘটনা দেশজুড়ে মানুষের মাঝে আবেগ সৃষ্টি করে।

কিন্তু পরবর্তী পরিস্থিতি সামলাতে সরকার যে সব পদক্ষেপ নেয়, প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েই প্রশ্ন ওঠে এবং নানা আলোচনার জন্ম দেয় বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।

তারা বলছেন, এই ঘটনায় সরকারের সিদ্ধান্ত নিতে গড়িমসি, সমন্বয়ের ঘাটতি, দক্ষতার অভাব স্পষ্ট হয়েছে। বড় কোনো দুর্ঘটনা সামাল দিতে জাতীয় সক্ষমতা, ব্যবস্থাপনা কতটা ভঙ্গুর, তা আরেকবার প্রকাশ পেয়েছে।

রাজনীতিকদের কেউ কেউ বলছেন, এই দুর্ঘটনায় সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা কমেছে।

সরকার আসলে ঘটনার গুরুত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিল কি না, এমন প্রশ্নও উঠছে।

বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে সরকারের দুই সংস্থার দুই রকম তথ্যেও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে
বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে সরকারের দুই সংস্থার দুই রকম তথ্যেও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে

সরকারের ব্যর্থতার প্রশ্ন কেন আসছে?

বিধ্বস্ত বিমানের আগুনে পুড়ে শিশুদের হতাহতের ঘটনা নিয়ে অভিভাবকসহ সারাদেশের মানুষ যখন উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি, ভিডিওসহ নানা তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে–– তখনও হতাহতের পরিসংখ্যান তুলে ধরতে অনেক সময় নেওয়া হয়।

দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর সরকারের পক্ষ থেকে থেকে নিহত ও আহতদের পরিসংখ্যান দেওয়া হয়। ফলে মৃত্যুর সংখ্যা লুকানো হচ্ছে কি না––এমন সন্দেহ তৈরি হয় মানুষের মধ্যে।

উচ্চ মাধ্যমিক বা এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা ছিল ওই দুর্ঘটনার পরদিন। মাইলস্টোন স্কুলেও পরীক্ষার্থী রয়েছে। এই পরীক্ষা স্থগিত করার ক্ষেত্রেও সরকারের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে।

সোমবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে পরীক্ষা স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। তাও সেই সিদ্ধান্তের কথা প্রথমে জানা যায় একজন উপদেষ্টার ফেসবুক পোস্ট থেকে।

পরীক্ষা হবে কি না, সেটা জানার জন্য পরীক্ষার্থীরা সারারাত সামাজিক মাধ্যমে চোখ রাখবেন-এমন চিন্তা করা হলে তা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয় না বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।

সরকারের পক্ষ থেকে এভাবে সিদ্ধান্ত আসায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেক পরীক্ষার্থী পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার পর স্থগিত হওয়ার খবর জানতে পারে। এ নিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন।

আহতদের চিকিৎসায় হাসপাতালে বিশৃঙ্খল পরিবেশ নিয়ন্ত্রণেও সরকারের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ ওঠে।

শতাধিক আহতকে ঢাকায় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বেশি সংখ্যক আহত শিশুকে ভর্তি করা হয় জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে।

সোমবার দুর্ঘটনার পর আগুনে পুড়ে গুরুতর আহত শিশুদের একের পর এক যখন সেই হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল, তখন সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা তাদের প্রটোকল, দলবলসহ সেখানে পরিদর্শনে গেছেন। সেটা উপকারের চেয়ে আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটায়।

বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা দলবেধে হাসপাতালে গেছেন। তাদের নেতা-কর্মীদের ভিড়ে বার্ন ইনস্টিটিউটের ভেতরে-বাইরে তৈরি হয়েছিল বিশৃঙ্খল পরিবেশ।

এর বাইরে ছিল সাংবাদিক, বেসরকারি স্বেচ্ছ্বাসেবক ও উৎসুক মানুষের ভিড়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে হাসপাতালে ভিড় না করতে চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে বার বার আবেদন জানাতে হয়।

দুর্ঘটনার পর আহতদের চিকিৎসা যখন বড় ইস্যু বা প্রধান অগ্রাধিকার, সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রথমদিনে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। এ নিয়েও চলছে সমালোচনা।

অন্যদিকে, প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজ থেকে অর্থ সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে পোস্ট দেওয়া হয়। পরে সেই পোস্ট সরিয়ে নেওয়া হয় ব্যাপক সমালোচনার মুখে।

এ বিষয়গুলো খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মনে করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। নাগরিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার অধ্যাপক মুহাম্মদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সরকারের পদক্ষেপগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে শিশুতোষ, খামখেয়ালি আচরণ প্রকাশ পেয়েছে। তাদের সংবেদনশীল মনে হয়নি।”

সেকারণে সরকারের প্রতি হতাহতের তথ্য গোপন করার সন্দেহ দেখা দেয় ও ব্যর্থতার বিষয় আলোচনায় এসেছে বলে মনে করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

যদিও সরকারের একাধিক উপদেষ্টা বিবিসিকে বলেন, সরকারের পদক্ষেপগুলো প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা রয়েছে। সেজন্য অনেক অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।

তবে বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের দুর্বলতা, সমন্বয়হীনতা দৃশ্যমান হয়েছে। আর সরকারের কারণেই প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ছয় দফা দাবিতে বিক্ষোভ করে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা, তাতে যোগ দেয় আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও
ছয় দফা দাবিতে বিক্ষোভ করে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা, তাতে যোগ দেয় আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও

ক্ষোভ রুপ নিয়েছিল বিক্ষোভে

একদিকে মৃত্যুর সংখ্যা প্রকাশে বিলম্ব করা হয়। সে বিষয়টি মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষার্থীদেরও সন্দেহের মধ্যে ফেলে।

অন্যদিকে দুর্ঘটনার পর পরই সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা ঘটনাস্থলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। সে সময় স্কুলটির শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাউকে কাউকে লাঠিচার্জ, মারধর করার অভিযোগ ওঠে।

এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবার স্কুলে বিক্ষোভ করেন।

এরই মধ্যে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আববার ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম স্কুলটিতে গেলে বিক্ষোভকারীরা তাদের অবরুদ্ধ করে রাখে।

উপদেষ্টারা নয় ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর পুলিশের কড়া পাহারায় বিকল্প পথ দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন।

আর সচিবালয়ে বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে হয়েছে পুলিশকে লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত শেষ মুহূর্তে আসায় শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ওই বিক্ষোভে রুপ নিয়েছিল।

বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, সরকারের কর্মকাণ্ড যে ক্ষোভ তৈরি করেছে, তার প্রকাশ দেখা গেছে বিক্ষোভের মাধ্যমেও।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় বহু হতাহত হয়েছে
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় বহু হতাহত হয়েছে

ঢাকায় যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন

রাজধানীতে সামরিক স্থাপনা থাকা উচিত কি না–– এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ই আলোচনা হয়েছে। ঢাকা নগরীর ভেতরে বিমান ও নৌবাহিনী এবং এমনকি সেনানিবাস থাকা না থাকার প্রশ্নও উঠেছে বিভিন্ন সময়ের আলোচনায়।

এখন যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের সময় বিধ্বস্ত হয়ে স্কুলের অনেক শিশুর হতাতের ঘটনার প্রেক্ষাপটে ওই আলোচনা নতুন করে সামনে এসেছে।

বিশেষ করে জনবহুল এলাকায় যুদ্ধবিমান চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছে মাইলস্টোন স্কুল কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, এর অনুমতি মিলেছে কীভাবে-এই আলোচনাও চলছে।

বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, ঢাকা একটি জনবহুল শহর, যেখানে ঘন ঘন উঁচু ভবন, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনা আছে। এমন একটি শহরে যেকোনো দুর্ঘটনা অনেক মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

তাদেরও প্রশ্ন, ঘনবসতির বা জনবহুল ঢাকায় যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে কীভাবে?

বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলেন, সরকারগুলো মানুষের নিরাপত্তার বিষয়ে উদাসীন থেকেছে। সেকারণে বিকল্প পরিকল্পনা করা হয়নি। বর্তমানে ১১ মাস বয়সী অন্তর্বর্তী সরকার এত বড় দুর্ঘটনার পরও বিকল্প কোনো চিন্তা করতে পারবে, এমনটা তারা মনে করছেন না।

বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ও বেসরকারি বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত কমিটির প্রধান সালাহউদ্দিন এম রহমতুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যুদ্ধবিমান চালানোর জন্য যে দীর্ঘ রানওয়ে দরকার, তা বর্তমানে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও সিলেটে আছে। আমাদের বিমানবাহিনী চট্টগ্রাম রানওয়ে ব্যবহার করে, তবে সিলেটে অবস্থিত রানওয়েটি সীমান্ত এলাকা হওয়ায় সুবিধাজনক নয়।”

তিনি মনে করেন, লোকালয়ের বাইরে যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের জন্য বিকল্প ভাবনার বা পরিকল্পনা করার এখনই সময়।

কিন্তু সে ধরনের চিন্তার কোনো ইঙ্গিত নেই।

মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনার পর সামনে আসছে নানা প্রশ্ন
মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনার পর সামনে আসছে নানা প্রশ্ন

দায়-দায়িত্বের প্রশ্ন কেন তোলা হচ্ছে

যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। সামরিক খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে দোষারোপের বিষয় থাকে না। তবে প্রশ্ন থাকে দায়-দায়িত্বের।

তারা মনে করেন, যেহেতু এবার জনবহুল এলাকায় যুদ্ধবিমান চালানোর প্রশিক্ষণের সময় দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণহানি হয়েছে, এখানে লোকালয়ের বাইরে প্রশিক্ষণের বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিল। সরকার বা কর্তৃপক্ষ সে ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি। সেই প্রেক্ষাপটে তাদের দায়-দায়িত্বের প্রশ্ন আসছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।

এছাড়া যে ধরনের যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয়, সেই বিমানের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

মিগ টুয়েনটি ওয়ান যুদ্ধবিমান, যা এফ-সেভেন নামে পরিচিত, এই বিমান দিয়ে বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আধুনিক যুদ্ধবিমানের তুলনায় এতে নিরাপত্তাসম্পর্কিত ফিচার অনেক কম। এফ-সেভেনের মূল কাঠামোটাই বেশ পুরনো। এতে ‘ফ্লাই-বাই-ওয়্যার’ (এফবিডাব্লিউ) ব্যবস্থা নেই।

এ ধরনের ব্যবস্থায় পাইলটের দেওয়া নির্দেশনা বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত হয় এবং সে অনুযায়ী বিমানের বিভিন্ন অংশ পরিচালিত হয়। ফলে দুর্ঘটনার সংখ্যাও অন্যান্য যুদ্ধবিমানের চেয়ে বেশি বলে বলছেন এ সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞরা।।

তারা উল্লেখ করেন, এই এফ-সেভেন যুদ্ধ বিমান চীন বানানো শুরু করেছিল ১৯৬৬ সালে। চীন এই বিমান তৈরি বন্ধ করেছে ২০১৩ সালে।

সরকারি সূত্রে জানা গেছে, বাাংলাদেশের ৩৬টি এফ সেভেন যুদ্ধবিমান ছিল। এখন একটি বিধ্বস্ত হলো। এর আগে বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণ চলাকালে চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে তিনটি দুর্ঘটনা ঘটেছে।

সর্বশেষ ঢাকায় দুর্ঘটনার পর এ ধরনের যুদ্ধবিমান ব্যবহারের বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ ব্যাপারে সরকার ও কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব। তবে বিকল্প বা ভিন্ন কোনো পরিকল্পনা কখনো করা হয়নি। আর এ কারণেও দুর্ঘটনার দায় নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

১৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক
১৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক করেন বুধবার

রাজনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকেও সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

নানা প্রশ্ন, আলোচনা-সমালোচনার মুখে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দুই দিনে ১৭টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

সোমবার দুর্ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার রাতে অধ্যাপক ইউনূস বৈঠক করেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে।

পরদিন বুধবার তিনি এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ ১৩টি দলের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন।

এই দুটি বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা পরিস্থিতি সামলাতে দলগুলোর সহযোগিতা চেয়েছেন এবং ঐক্যের তাগিদ দিয়েছেন।

জানা গেছে, বিএনপি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কঠোর হতে বলেছে। আর সহযোগিতা ও ঐক্যের প্রশ্নে সব দলই একমত পোষণ করেছে।

তবে বুধবার ১৩টি দলের সঙ্গে বৈঠকে এই দলগুলোর নেতাদের কেউ কেউ সরকারের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, তারা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন, সরকার যখন সংকটে পড়ে, তখনই কেবল রাজনীতিকদের ডাকা হয়।

এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বিবিসি বাংলাকে বলেন, মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে শিশুদের হতাহতের ঘটনার পর সরকারের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এমনকি সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা কমেছে। এই বক্তব্য তিনি বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন।

রাজনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকেও সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন, সমালোচনা থেকে রেহাই মেলেনি বলা যায়। কোনো কোনো দলের নেতা সরকারের সমন্বয়হীনতার কথাও জোরালোভাবে তুলেছেন।

তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ নিয়ে সন্দেহ

দেশে বড় স্পর্শকাতর কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তদন্ত প্রতিবিদেন প্রকাশ করা হয়েছে, এমন ঘটনা বিরল।

সেকারণে মাইলস্টোন স্কুলে যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের সময় বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন কখনো প্রকাশ করা হবে কি না, সেই সন্দেহ রয়েছে।

ঘটনাটির ব্যাপারে বিমান বাহিনী ও সরকার দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

সাবেক একজন সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, দুর্ঘটনায় সরকারের ভূমিকায় এটা প্রমাণ হয়েছে যে, কোনো জটিল পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো সক্ষমতা নেই।

তিনি মনে করেন, সেজন্য ঘটনাটির কারণ অনুসন্ধান করে তা মানুষকে জানানো উচিত এবং তদন্তের ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

বিবিসি নিউজ বাংলা