চীনের প্রতি ভরসা কমছে মার্কিন ব্যবসায়ীদের
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সস্তা শ্রম, উৎপাদনক্ষমতা ও বিশাল সরবরাহব্যবস্থার কারণে চীন ছিল আমেরিকান কোম্পানিগুলোর প্রধান উৎপাদনকেন্দ্র। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ এই স্থিতিশীল সম্পর্ককে নড়বড়ে করেছে। ফলে বহু মার্কিনমুখী কোম্পানি দ্রুত বিকল্প খুঁজছে—বিশেষ করে ভিয়েতনামের মতো দেশে।
ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ: ব্যবসায়ীদের সিদ্ধান্ত বদলে দিয়েছে
ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করলে ডেনিশ–স্টাইলের সোফা প্রস্তুতকারী সাইমন লিশটেনবার্গ ভেবেছিলেন, পরিস্থিতি সময়ের সঙ্গে স্বাভাবিক হবে।
১৯৯০–এর দশক থেকে তাঁর চীনে কারখানা ছিল। তিনি অপেক্ষা করেছিলেন—কিন্তু আর নয়।
২০২৫ সালে তিনি প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে তাঁর মার্কিন গ্রাহকদের জন্য তৈরি কারখানাটি ভিয়েতনামে সরিয়ে নেন। নতুন যুদ্ধবিরতির ঘোষণাও তাঁর মত বদলায়নি। তাঁর মতে, চীন–মার্কিন শত্রুতার গভীরতা ব্যবসার ভবিষ্যৎ অর্থনীতি বদলে দিয়েছে।
তিনি বলেন, “চীন–মার্কিন সম্পর্কের স্থিতিশীলতায় এখন আর কেউ বিশ্বাস রাখে না।” হঠাৎ আরোপিত উচ্চ শুল্কের কারণে তাঁর কোম্পানি ট্রেটন গ্রুপ শুধু এই বছরেই বড় অঙ্কের ক্ষতির মুখে পড়েছে।
কেন কোম্পানিগুলো চীন ছাড়ছে
চীনে উৎপাদন ব্যয় কম হলেও যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা ফিরিয়ে আনা অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অসম্ভব—কারণ খরচ ও শ্রমিকসংকট বড় বাধা।
তাই যারা চীন ছাড়ছে, তারা যাচ্ছে ভিয়েতনামসহ কাছাকাছি দেশে, যেখানে সস্তা শ্রম ও কাঁচামাল পরিবহন সহজ।
ট্রাম্প সম্প্রতি শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর কিছু শুল্ক কমালেও সামগ্রিক অস্থিরতা কমেনি।
হ্যানয়ের আমেরিকান চেম্বারের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডাম সিটকফ বলেন,
“দীর্ঘমেয়াদে চীনে উৎপাদনের ঝুঁকি বাড়বে। এটাই ব্যবসার হিসাব বদলে দিয়েছে।”
বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোর দিকবদল
নাইকি, অ্যাপল, ইন্টেল—সবাই চীনে তৈরি পণ্যের ওপর নির্ভরতা দ্রুত কমিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সর্বাধিক জুতার উৎস এখন চীন নয়, ভিয়েতনাম।
ল্যাপটপ ও স্মার্টফোনের বড় অংশও ভারত ও ভিয়েতনাম থেকে আসছে।
শুল্ক–ছাড় পাওয়া অনেক পণ্যেও একই প্রবণতা। তথ্য বলছে—চীন আর আমেরিকার নির্ভরযোগ্য কারখানা নয়।
অনিশ্চয়তা বাড়ছে: “আপনি দৌড়াতে পারবেন, লুকোতে পারবেন না”
ট্রাম্পের শুল্কনীতি এখনও অনিশ্চিত। আদালতে আইনি ভিত্তি চ্যালেঞ্জ হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।
এখন মূল প্রশ্ন—
ভিয়েতনামে তৈরি হলেও যদি চীনা বিনিয়োগ বা কাঁচামাল থাকে, তাহলে কি সেটিকে ‘চীনা’ পণ্য হিসেবে ধরা হবে?
মান ওয়া ইউএসএ–এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাব্রিয়েলে নাতালে বলেন,
“প্রথম মেয়াদে ট্রাম্পের কারণে সবাই চীন ছাড়ে। এবার তিনি সবদিকে আঘাত করছেন—আপনি দৌড়াতে পারবেন, লুকোতে পারবেন না।”
তাঁদের ২০১৯ সালে ভিয়েতনামে গড়ে ওঠা ৫.৮ মিলিয়ন স্কয়ার–ফুট কারখানাই এখন উত্তর আমেরিকার সব পণ্যের উৎস।
মার্কিন খুচরা বিক্রেতাদের চাপ বাড়ছে
আমেরিকান ক্রেতারা সরবরাহকারীদের চীননির্ভরতা কমাতে বলছে।
ভিয়েতনামে মোমবাতি তৈরি করা ফ্লেমিং ইন্টারন্যাশনালকে যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ফলে তারা আর্কানসাসে নতুন কারখানা খুলছে—যেখানে উৎপাদন ব্যয় ভিয়েতনামের তুলনায় দ্বিগুণ বা তিনগুণ।
লোয়েল নিউম্যান বলেন, “এটা দীর্ঘমেয়াদি কৌশল। তাৎক্ষণিক লাভ আশা করা যায় না।”
হঠাৎ শুল্কে ব্যবসায়ীরা দিশেহারা
সাইমন লিশটেনবার্গের অভিজ্ঞতা সবচেয়ে নাটকীয়।
১০ অক্টোবর রাতে ট্রাম্প হঠাৎ শি জিনপিংকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
পরদিন সকালে লিশটেনবার্গ দেখেন—চীনের ওপর নতুন ১০০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর।
ছয় মাস আগে শুল্ক ছিল ১২৫ শতাংশ; পরে বাড়িয়ে ১৪৫ শতাংশ করা হয়েছিল।
সৌভাগ্যক্রমে তাঁর চীনমুখী কন্টেইনার তখন কম ছিল—তবুও উৎপাদন পরিকল্পনা ভেঙে পড়ে।
ভিয়েতনামে ব্যস্ততা, চীনে শূন্য কারখানা
এখন তাঁর মোট উৎপাদনের অর্ধেক ভিয়েতনামের নতুন কারখানায়। আরও ১২টি প্রতিষ্ঠানও চীন ছেড়ে সেখানে যাচ্ছে।
কিন্তু সাংহাইয়ের উপকণ্ঠে প্রস্তুত তাঁর নতুন কারখানাটি এখন প্রায় ফাঁকা।
সারি–সারি খালি ধাতব তাক, বন্ধ অবস্থায় নতুন রোবট, এবং ৫০০ শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পর নিস্তব্ধ উৎপাদন লাইন—সবই এখন স্থবির।
তিনি বলেন,
“ভাবছিলাম আগামী বছরই এটি পূর্ণ সক্ষমতায় চলবে। এখন আগের চেয়ে আরও বেশি শূন্য।”
অস্থির সময়ের নতুন ব্যবসায়িক পথচলা
চীন–মার্কিন সম্পর্কের অস্থিরতা ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত বদলে দিচ্ছে। বহু প্রতিষ্ঠান আর চীনকে পূর্বের মতো নির্ভরযোগ্য উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে দেখছে না।
ভিয়েতনাম, ভারত, মেক্সিকো ও পূর্ব ইউরোপ—সবই দ্রুত বিকল্প কেন্দ্র হিসেবে উঠে আসছে।
তবুও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
ব্যবসায়ীরা বলছেন:
এখন fallback নয়—চীন থেকে দূরে থাকা বাধ্যতামূলক অর্থনৈতিক কৌশল।
#চীন-মার্কিন_বাণিজ্য | #ভিয়েতনাম_উৎপাদন | #মার্কিন_ব্যবসা |# ট্রাম্প_নীতি | #বৈশ্বিক_বাণিজ্য
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















