“আমার দোষটা কী ছিল?”—প্রশ্নটি ছুড়ে দেয় সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া একটি কিশোরী, যার জীবনের গতিপথ গত এক মাসে সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। সে অংশ নিয়েছিল জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলনে, যেখানে হাজারো শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে নিজেদের অধিকার ও নিরাপত্তার দাবিতে স্বর উঁচু করেছিল। কিন্তু সেই সাহসী অংশগ্রহণই হয়ে উঠেছে তার জীবনের সবচেয়ে বড় মানসিক দুঃস্বপ্নের উৎস।
সাহস থেকেই যন্ত্রণা শুরু
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কিশোরী ঢাকার একটি স্বনামধন্য কলেজের ছাত্রী। তার ভাষায়, জুলাইয়ের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়া, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো। কিন্তু আন্দোলনের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে শুরু হয় অনলাইনে উপহাস, বিদ্রূপ, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, এমনকি অবমাননাকর বার্তা পাঠানো। কেউ কেউ তার পোশাক নিয়েও তীব্র ব্যঙ্গ করতে ছাড়েনি।
“কেউ লিখেছে আমি নাকি চরিত্রহীন, কেউ বলেছে আন্দোলনের নামে জনপ্রিয়তা খুঁজছি,” বলে সে। “যখনই ফোনে নোটিফিকেশন আসে, বুক কেঁপে ওঠে—আর কোনো হুমকি এসেছে কি না, তা ভাবি।”
পোশাক নিয়ে সমাজের তির্যক দৃষ্টি
এই কিশোরীর আরেকটি ‘অপরাধ’—সে জিনস ও টি-শার্ট পরতে ভালোবাসে। এটি তার পছন্দ, স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতীক। কিন্তু সেই পোশাকচয়নই যেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে পরিণত হয়েছে বিচারসভায়। গত এক মাসে অন্তত চারবার তাকে প্রকাশ্য রাস্তায় অপমানজনক মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হয়েছে—কখনো রিকশায় বসে, কখনো দোকানে দাঁড়িয়ে, কখনো কলেজের গেট পার হওয়ার সময়।
“একবার এক লোক বলল, ‘বাবা-মা কিছু শেখায়নি নাকি?’—শুধু একটা জিনস পরার জন্য আমাকে এমন কথা শুনতে হলো। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম,” জানায় মেয়েটি।
পরিবারের বোঝাপড়া ও সমাজের চাপ
যেখানে পরিবারের কাছ থেকে সহানুভূতি আশা করা যায়, অনেক সময় সেখান থেকেও আসে তিরস্কার। “তুই এত কথা বলিস না, সোশ্যাল মিডিয়ায় এত ছবি দিস কেন?”—মায়ের এমন প্রশ্ন তাকে আরও একা করে তোলে। বাবাও পরামর্শ দিয়েছেন, “কিছুদিন ঘরে থাক, সময় একটু স্বাভাবিক হোক।” কিন্তু স্বাভাবিক বলতে কী বোঝায়? স্বাধীনতা, নাকি আত্মগোপন?
মানসিক স্বাস্থ্য সংকট
চাপ, অপমান, অপবাদ—সব মিলিয়ে এই কিশোরীর মধ্যে জন্ম নিয়েছে এক ধরনের অবসাদ ও আতঙ্ক। ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে, খাওয়ায় অনিয়ম দেখা দিয়েছে, এবং বাইরে বের হওয়ার আগ্রহ একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে। সে বলছে, “যখন বাইরে যাই, মনে হয় সবাই তাকিয়ে আছে, বিচার করছে। আমি আর আগের মতো নেই।”
ঢাকার একটি মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সে নিয়মিত কাউন্সেলিং নিচ্ছে। এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলছেন, “এই ধরনের সামাজিক নিপীড়ন দীর্ঘমেয়াদে আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করে দেয়। আমাদের দেশে পোশাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে এখনো ভয়ংকর সংকীর্ণতা কাজ করছে।”
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নীরবতা
আশ্চর্যের বিষয়, কলেজ কর্তৃপক্ষ এখনও কোনো সহানুভূতিশীল অবস্থান নেয়নি। বরং আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের প্রতি নজরদারি শুরু হয়েছে। কিশোরীটি জানায়, “ক্লাসে ঢুকলে কয়েকজন শিক্ষক তিরস্কারমূলক ভঙ্গিতে তাকান। কেউ কেউ বলেন, ‘এখন এসব করলেই সমাজ বদলায় না।’ কিন্তু আমি তো শুধু স্বপ্ন দেখেছিলাম।”
ভবিষ্যতের দুঃচিন্তা
এই কিশোরীর স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করার। কিন্তু এখন তার মনে হয় ভবিষ্যৎ অন্ধকার। “আমি কি স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারব? এই সমাজ আমাকে ক্ষমা করবে কী?”