গ্রামীণ ঝোপের আড়ালে এক শিকারি
বাংলাদেশের অনেক গ্রামে আপনি মাঝেমধ্যে এমন এক বিড়াল দেখতে পাবেন, যা গৃহপালিত বিড়ালের চেয়ে বড়, পাতলা গড়ন, তীক্ষ্ণ কান এবং সজাগ চোখ। স্থানীয়ভাবে একে কেউ ডাকে ‘বনবিড়াল’, কেউ ‘ওয়াব’, কেউবা ‘বন্য বিড়াল’ নামে।
এই রহস্যময় প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Felis chaus, এবং এটি বাংলাদেশের অন্যতম বিস্তৃত বন্য বিড়াল প্রজাতি।
আবাসভূমি: গ্রামের সীমানায়
বন বিড়ালের বাস মূলত নিম্নভূমি, আদ্রভূমি, ধানক্ষেত, পুকুরপাড়, ঝোপঝাড় কিংবা আংশিক বনের ধার ঘেঁষে। বন বা পাহাড়ের গভীরে খুব বেশি দেখা না গেলেও, প্রান্তিক জনপদের নিকটবর্তী এলাকায় সহজেই টিকে থাকে।
এই বিড়াল প্রজাতির অভিযোজন ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি। মানুষের কাছাকাছি থেকেও নিজের মতো করে শিকার করে টিকে থাকে। একে শহরের প্রান্তে বা পরিত্যক্ত জমিতে দেখা যায়, যা একটি বড় পরিবেশগত ভূমিকা পালন করে।
চেহারায় পার্থক্য
বন বিড়াল সাধারণত গৃহপালিত বিড়ালের তুলনায় একটু বড় আকারের হয়। এদের গায়ের রং বাদামি-ছাই, কান লম্বা এবং তাতে কালো আঁচিলের মতো দাগ থাকে। লেজের ডগায় থাকে কালো দাগের একাধিক রিং—যা সহজেই শনাক্তযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
খাদ্যাভ্যাস: পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী
এই বিড়াল মূলত নিশাচর এবং মাংসাশী। এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে—
- ইঁদুর ও অন্যান্য ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী
- টিকটিকি, ব্যাঙ, পাখির ছানা
- মাঝে মাঝে পাখির ডিম, এমনকি ছোট সাপও
ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে এই বিড়াল একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশবান্ধব উপায়। অথচ অনেকেই না জেনে একে পোষা বিড়াল ভেবে হত্যা করে।
মানুষ ও বন বিড়াল: ভুল বোঝাবুঝির পরিণতি
গৃহপালিত বিড়ালের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকায় অনেক মানুষ ভুল করে বন বিড়ালকে ক্ষতিকর প্রাণী ভাবে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, শিশু বা হাঁস-মুরগির ক্ষয়ক্ষতির জন্য একে দায়ী করা হয়। এতে ভুল বিচার-বিশ্লেষণ ঘটে এবং প্রাণহানি ঘটে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, “বন বিড়াল কখনোই মানুষের ওপর আক্রমণ করে না, বরং এটি মানুষের আশপাশে থাকা ক্ষতিকর প্রাণীদের শিকার করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।”
সংরক্ষণের বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে IUCN-এর হিসেবে বন বিড়াল Least Concern তালিকায় আছে। তবে বাংলাদেশে কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই। বন উজাড়, রাস্তা নির্মাণ, জমি দখল, এবং খাদ্য সংকটের কারণে এদের টিকে থাকা এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও বরিশাল অঞ্চলে এখনো মাঝে মাঝে এই বিড়ালের দেখা মেলে। তবে সংখ্যার দিক থেকে তা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।
জরুরি করণীয়
- সচেতনতা বৃদ্ধি: বন বিড়াল আর গৃহপালিত বিড়ালের পার্থক্য বোঝাতে গ্রামীণ শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তি জরুরি।
- বনাঞ্চল রক্ষা: ঝোপঝাড় বা পরিত্যক্ত খালভূমি কেটে বসত গড়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।
- স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে হবে, যেখানে বন বিড়াল সংরক্ষণে সাধারণ মানুষ অংশ নিতে পারে।
বন বিড়াল আমাদের অজান্তেই একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ রক্ষাকারী হিসেবে কাজ করে চলেছে। এর নিঃশব্দ উপস্থিতি ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ করে কৃষিকে সুরক্ষা দেয়, বন-জলাভূমির জীববৈচিত্র্য বজায় রাখে।