স্বল্প সময়ে মানসম্মত প্রবন্ধ বা বিশ্লেষণ লিখতে প্রবল মানসিক শক্তি লাগে। এখন জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সেই চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে হালকা করে দিচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েকটি গবেষণা ইঙ্গিত করছে—এই তাৎক্ষণিক সুবিধার আড়ালে সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তা ও গভীর মনোযোগের ওপর দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এখানে মূল গবেষণা ও পর্যবেক্ষণগুলোর সহজ ব্যাখ্যা, সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং ব্যবহার-কৌশল উপস্থাপন করা হলো।
প্রাথমিক গবেষণার ইঙ্গিত: মস্তিষ্কের সক্রিয়তা কোথায় কমছে
এমআইটির একটি ছোট পরিসরের পরীক্ষায় (মোট অংশগ্রহণকারী ৫৪ জন) দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা প্রবন্ধ রচনা করতে নিজে লেখার তুলনায় যখন চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে, তখন ইইজি যন্ত্রে সৃজনশীল চিন্তা ও মনোযোগের সঙ্গে সম্পর্কিত অংশের বৈদ্যুতিক তৎপরতা কিছুটা কমে যায়। আরও লক্ষ করা যায়, এআইয়ের সাহায্যে লেখা শেষ করার পরই তারা সদ্য তৈরি লেখার সুনির্দিষ্ট অংশ বা উদ্ধৃতি পুনরুৎপাদনে বেশি অসুবিধায় পড়ে। ফলে প্রশ্ন উঠছে—তাৎক্ষণিক ‘সহজতা’ কি ভবিষ্যতের দক্ষতা হ্রাসের জন্য এক ধরনের অদৃশ্য ঋণ তৈরি করছে?
জ্ঞানকর্মীদের ব্যবহার: কম মানসিক পরিশ্রমে বেশি কাজ
মাইক্রোসফট রিসার্চের এক জরিপে সপ্তাহে অন্তত একবার জেনারেটিভ এআই ব্যবহারকারী ৩১৯ জন জ্ঞানকর্মী ৯০০–এর বেশি কাজের ধরন উল্লেখ করেন—দীর্ঘ নথি সংক্ষেপ, বিপণন ধারণা তৈরি, পুনর্লিখন ইত্যাদি। তাঁদের স্ব-মূল্যায়নে দেখা যায় প্রায় অর্ধেকের সামান্য বেশি কাজ সত্যিকারের গভীর সমালোচনামূলক চিন্তা দাবি করেছে; বাকিগুলোকে তারা প্রায় ‘মানসিক পরিশ্রমহীন’ বা রুটিনজাত বলে মনে করেছেন। অধিকাংশই জানান—চ্যাটজিপিটি, গুগল জেমিনি বা কপাইলট সহায়তায় একই ফল পেতে তাঁদের মানসিক শ্রম কম লাগে।
সমালোচনামূলক চিন্তার স্কোর: বেশি নির্ভরতায় তুলনামূলক পতন
এসবিএস সুইস বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক মাইকেল গারলিখ ব্রিটেনে ৬৬৬ জনের সমালোচনামূলক চিন্তা মূল্যায়ন করেন। অংশগ্রহণকারীদের এআই ব্যবহারের ঘনত্ব ও আস্থার মাত্রা নথিবদ্ধ করে মানক প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নিয়ে দেখা যায়—যাঁরা বেশি এআই নির্ভর, তাঁদের স্কোর গড়ে কম। এই ফলাফল প্রকাশের পর কিছু শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত নির্ভরতা নিয়ে উদ্বেগ জানান।
কারণ না ফল? এখনো স্পষ্ট নয়
যা দেখা যাচ্ছে তা থেকে সরাসরি বলা যায় না যে ‘এআই ব্যবহারের কারণেই’ দক্ষতা কমছে। উল্টো দিকও সম্ভব—যাঁদের সমালোচনামূলক সক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই বেশি, তাঁরা হয়তো কম এআই ব্যবহার করেন। উপরন্তু উল্লেখিত পরীক্ষাগুলো ছোট নমুনা বা নির্দিষ্ট কাজ (যেমন শুধু প্রবন্ধ লেখা) ভিত্তিক। তাই বিস্তৃত, দীর্ঘমেয়াদি ও বিভিন্ন ধরনের কাজের ওপর আরও গবেষণা জরুরি।
কগনিটিভ অফলোডিং: পুরোনো ধারণার নতুন রূপ
মানুষ বহু শতাব্দী ধরে বাহ্যিক সহায়তায় মানসিক চাপ হালকা করছে—লিখিত নোট, তালিকা, ক্যালকুলেটর ইত্যাদির মাধ্যমে। মনোবিজ্ঞানে একে বলা হয় ‘কগনিটিভ অফলোডিং’। সহজ হিসাব ক্যালকুলেটরে করলেও বুদ্ধি নষ্ট হয় না। এখন উদ্বেগের জায়গা হলো—জেনারেটিভ এআই শুধু খুঁটিনাটি নয়, বরং বিশ্লেষণ, লেখনী, সমস্যা-সমাধানের মতো উচ্চস্তরের চিন্তার বড় অংশই নিজের দিকে টেনে নিচ্ছে। এতে যদি মূল মানসিক পেশিগুলো চালু না থাকে, দীর্ঘমেয়াদে তা নিস্ক্রিয় হয়ে দুর্বল হতে পারে।
স্বল্প পরিশ্রমে ঝোঁক: সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া চক্র
মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সহজ পথ বেছে নিতে চায়—এককে বলা হয় ‘কগনিটিভ মাইজার’ আচরণ। যদি এআই বারবার কঠিন ধাপগুলো বাদ দেয়, দক্ষতা ধীরে ধীরে ভোঁতা হতে পারে এবং সেই ভোঁতা অবস্থা আবার আরও নির্ভরতার দিকে ঠেলে দিতে পারে—এক ধরনের প্রতিক্রিয়া চক্র। কিছু ভারী ব্যবহারকারী ইতিমধ্যে বলছেন, “এআই ছাড়া কিছু সমস্যার সমাধান কল্পনা করতে পারি না।”
সৃজনশীলতার প্রশ্ন: বৈচিত্র্য কমে যাওয়ার ঝুঁকি
এক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের দৈনন্দিন বস্তু দিয়ে নতুন ব্যবহার ভাবতে দেওয়া হয়। যারা আগে এআই-উৎস আইডিয়াগুলো দেখে নেয়, তাদের প্রস্তাব তুলনামূলক কম বৈচিত্র্যপূর্ণ ও কম সৃজনশীল হিসেবে মূল্যায়িত হয়। কারণ, পূর্বনির্ধারিত বা সাধারণ ধারণা দেখে নিলে ‘মানসিক অনুসন্ধানের পরিসর’ সংকুচিত হয়—মস্তিষ্ক দ্রুত সন্তুষ্ট হয়ে যায় এবং দূরের সম্ভাবনা কম ধরতে পারে।
কীভাবে ঝুঁকি কমাব: সহকারী, কর্তৃত্ব নয়
পরিচালন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ—এআইকে চূড়ান্ত উত্তরদাতা নয়, মাঝপথের সহকারী হিসেবে রাখুন। অর্থাৎ সমস্যা এক ধাপে পুরো সমাধান না চেয়ে ধাপে ভেঙে প্রতিটি পর্যায়ে পরামর্শ নিন। এতে আপনি নিজের কাঠামো নির্মাণের সক্ষমতা ধরে রাখবেন, আবার খসড়া, তথ্য সংগঠন বা ভাষাগত ঘষামাজায় সাহায্য পাবেন।
প্রশ্নমুখী ব্যবহার: চিন্তাকে উস্কে দিতে ডিজাইন
এআইকে কেবল ‘উত্তর জেনারেটর’ থেকে ‘প্রশ্ন তৈরি করে ভাবনা গভীর করা’র হাতিয়ারে রূপান্তর করা যায়। যেমন, আপনি সমাধান চাইবার আগে এআইকে বললেন: “সমস্যাটি আরেকভাবে চ্যালেঞ্জিং করে তিনটি অনুসন্ধানী প্রশ্ন বানাও।” এতে আপনার মেটাকগনিটিভ (নিজের চিন্তা নিয়ে ভাবা) অনুশীলন সক্রিয় থাকে।
সীমা কোথায়: অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
বারবার বাধা বা ‘প্রোভোকেশন’ সব কাজে উপকারী নয়। সহজ স্তরের প্রোগ্রামিং বা রুটিন কাজের মাঝে ঘন ঘন প্রশ্নচিহ্ন ঢুকলে গতি কমে, বিরক্তি বাড়ে, কর্মদক্ষতাও নামতে পারে। তাই কাজের জটিলতা অনুযায়ী হস্তক্ষেপের মাত্রা সামঞ্জস্য করা দরকার।
কগনিটিভ ফোর্সিং কৌশল
একটি সরল পদ্ধতি হলো—এআই ব্যবহার করার আগে নিজে ন্যূনতম কয়েক মিনিট ধরে কাঠামো বা প্রাথমিক উত্তর লিখে নেওয়া। পরে এআইকে দিয়ে তুলনা, উন্নতি বা বিকল্প চাইলে আপনি ‘প্রথম চিন্তা’র অনুশীলনটি হারাবেন না। ইচ্ছাকৃত এই বিলম্ব মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে, যদিও ব্যবহারকারীর ধৈর্যের পরীক্ষা নেয় বলে জনপ্রিয়তা কম হতে পারে।
স্ব-মূল্যায়ন ও ভবিষ্যৎ প্রস্তুতি
এআই এখনো নবীন এবং বহু প্রাসঙ্গিক, বিচারনির্ভর, খোলা-প্রশ্নমূলক কাজে মানুষের অন্তর্দৃষ্টি অপরিহার্য। তবু ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও নীতিনির্ধারকদের পর্যায়ক্রমে যাচাই করতে হবে—তাৎক্ষণিক দক্ষতা বৃদ্ধির বিনিময়ে সম্ভাব্য জ্ঞানীয় ক্ষতি হচ্ছে কি না। যদি ভবিষ্যতে দৃঢ় প্রমাণ আসে যে অতিরিক্ত নির্ভরতা সমালোচনামূলক সক্ষমতা কমাচ্ছে, তবে আগেভাগে প্রতিরোধের অভ্যাস গুরুত্বপূর্ণ হবে।
সংক্ষিপ্ত ব্যবহার-কৌশল (কার্যকর পরামর্শ)
১. ধাপে ভাঙুন: সমস্যাকে উপ-প্রশ্নে ভাগ করে প্রতিটি ধাপে সহায়তা নিন।
২. প্রথমে নিজে লিখুন: অন্তত কাঠামো বা মূল পয়েন্ট কাগজে নোট করুন।
৩. প্রশ্ন তৈরি করান: সরাসরি উত্তর নয়—উদ্দীপক, বিকল্প দৃষ্টিকোণ বা পাল্টা যুক্তির তালিকা চান।
৪. তুলনা চেয়ে উন্নত করুন: নিজের খসড়া ও এআই সংস্করণ তুলনা করে সমন্বিত সংস্করণ তৈরি করুন।
৫. বৈচিত্র্য বাধ্য করুন: একটিমাত্র উত্তর না নিয়ে একাধিক ভিন্ন শৈলীর আউটপুট চান, পরে মিলিয়ে নিন।
৬. শব্দবাহুল্য ছাঁটাই: এআইকে অতিরিক্ত অলঙ্কার বাদ দিয়ে স্পষ্টতা বাড়াতে বলুন—কিন্তু মূল যুক্তির কাঠামো নিজে নির্ণয় করুন।
৭. পর্যায়ক্রমিক বিলম্ব: তাৎক্ষণিক ব্যবহার এড়াতে নিজস্ব ‘দুই মিনিট নিয়ম’ বা নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করুন।
৮. ব্যবহারের লগ রাখুন: কোন অংশ এআইকে দিলেন আর কোনটি নিজে করলেন লিখে রাখলে নির্ভরতার ধরণ স্পষ্ট হবে।
মস্তিষ্কের দক্ষতার ক্ষয়
এআই আমাদের ‘অধিক উৎপাদন—কম পরিশ্রম’-এর প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু একই সঙ্গে কিছু মানসিক অনুশীলন অদৃশ্য ছুটিতে পাঠানোর ঝুঁকিও রাখে। সচেতন নকশা, ধাপভিত্তিক ব্যবহার, প্রথমে নিজস্ব চিন্তা লিপিবদ্ধ করা, প্রশ্নমুখী প্রম্পট এবং নিয়মিত সমালোচনার অনুশীলনের মাধ্যমে মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখা সম্ভব। স্বাচ্ছন্দ্যকে নিয়ন্ত্রিত রেখে এআইকে এমনভাবে কাজে লাগানোই লক্ষ্য হওয়া উচিত যাতে তা দক্ষতার ক্ষয় নয়, বরং বিস্তার ঘটায়। এই ভারসাম্য রক্ষা করাই আগামী দিনের প্রধান কৌশলগত চ্যালেঞ্জ।