পুরান ঢাকা: শুধু পুরনো নয়, স্বাদের রাজ্য
পুরান ঢাকা কেবল স্থাপত্য ও ঐতিহ্যের জন্য নয়, বরং এর অদ্বিতীয় খাবারের জন্যও বিখ্যাত। এই অঞ্চলের খাবারে রয়েছে মোগল, তুর্কি, আরবি ও স্থানীয় প্রভাবের এক অপূর্ব মিশ্রণ, যা কয়েক শতাব্দী ধরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। পরিবারভিত্তিক রেসিপি, কাঠের চুলায় রান্না আর হাতে গড়া মসলা—সবকিছু মিলিয়ে পুরান ঢাকার খাবারকে দিয়েছে অনন্য স্বাদ ও পরিচয়।
১. নাহার মসজিদের কাচ্চি ও কাবাব
পুরান ঢাকার অন্যতম জনপ্রিয় খাবার হলো কাচ্চি বিরিয়ানি। নাহার মসজিদ ও বাংলাবাজার এলাকায় ‘হাজীর কাচ্চি’ বা ‘সিদ্দিক কাচ্চি’ নামক হোটেলগুলোতে মাটন কাচ্চির সুগন্ধিতে ভরে ওঠে চারপাশ। এখানে ব্যবহার করা হয় দেশি খাসির মাংস, সরষের তেল, দই ও ঘরের তৈরি বিশেষ মসলা। মাটির হাঁড়িতে ধীরে ধীরে রান্না করা এই বিরিয়ানি সত্যিই মুখরোচক।
কাবাবের মধ্যে ‘শাহী গলি’র বিখ্যাত গরুর শিক কাবাব, বটি কাবাব এবং গরুর কলিজার কাবাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগুলো সাধারণত ঘি বা তেলে ভেজে পরিবেশন করা হয়, যা খিদের জোর বাড়িয়ে তোলে।
২. নাজিরাবাজারের নেহারি ও রুটি
নাজিরাবাজার এলাকায় রাত ২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত ‘নেহারি’ পাওয়া যায়। এটি মূলত মগজ, হাড়সহ গরুর পা, গলার মাংস ও ঝোল দিয়ে তৈরি এক বিশেষ খাবার, যা ভারী রুটি বা পরোটার সঙ্গে খাওয়া হয়। মূলত শীতকালে এই খাবারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে।
নেহারি তৈরি হয় রাতভর ধীরে ধীরে সিদ্ধ করার মাধ্যমে। এর ঝোলে লাল মরিচ, জিরা, আদা, রসুন এবং ঘি মিশে এক অসাধারণ স্বাদ সৃষ্টি করে, যা একবার খেলে ভোলার নয়।
৩. বিফ তেহারি ও ছোলা ডাল
পুরান ঢাকার বিখ্যাত বিফ তেহারির কথা না বললে এই তালিকা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সাধারণত এটি তৈরি হয় সরু চাল, গরুর মাংস, ঘি, দারুচিনি, এলাচ ও অন্যান্য মসলার সমন্বয়ে। লালবাগ, ইসলামবাগ বা বংশালের কিছু খাবারের দোকান এই তেহারির জন্য শত বছর ধরে বিখ্যাত।
বিফ তেহারির সঙ্গে পরিবেশন করা হয় ছোলা ডাল, ডিমের ঝুরি এবং আলুর চপ—পুরান ঢাকার নিজস্ব স্টাইল।
৪. বাকরখানি ও মোগলাই পরোটা
পুরান ঢাকার আরেকটি স্বতন্ত্র খাবার হলো বাকরখানি। মোটা, শক্ত ও মিষ্টি ধরনের এই রুটি ঘি ও দুধ দিয়ে তৈরি হয়। একে বলা হয় নবাবি খাবার, যা কোনো কালের আতিথেয়তার নিদর্শন। নওয়াবপুর, চকবাজার ও বুড়িগঙ্গার পাড়ে এখনও হাতে গড়া মূল বাকরখানির দোকান চালু রয়েছে।
মোগলাই পরোটা হলো ডিম, কিমা, পেঁয়াজ, মরিচ ও মসলা ভর্তি এক ধরনের ভাজা পরোটা, যা সন্ধ্যার সময় ক্ষুধা মেটানোর এক আদর্শ উপায়।
৫. চকবাজারের ইফতার বাজার
চকবাজারের ইফতার বাজার বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী। প্রতি রমজান মাসে হাজার হাজার মানুষ এখানে ভিড় করেন। এখানে পাওয়া যায় বেগুনি, পেঁয়াজু, জিলাপি, বুড়ির হালুয়া, রোস্ট, কোফতা, সেমাই ও মোরগ পোলাও।
একটি বিশেষ খাবার হলো ‘বড়বাটির বুট’—গরুর মাংস, ছোলা, মরিচ, ঘি ও মসলা দিয়ে তৈরি এক ভারী খাবার, যা ইফতারের সময় অনেকেই উপভোগ করেন।
৬. মিষ্টি ও শরবতের স্বর্গ
পুরান ঢাকার মিষ্টির দোকানগুলোর মধ্যে ‘শহীদ দই’ বিখ্যাত। এছাড়া রসগোল্লা, চমচম, দই ও সন্দেশের গুণগত মান ও স্বাদ এখানে অতুলনীয়। গরমকালে ইসবগুলের শরবত বা লেবুর শরবত পান করাও এখানকার একটি ঐতিহ্য।
৭. দই বড়া, হালিম ও ফালুদা
‘দই বড়া’ একটি ভারতীয় উপমহাদেশীয় খাবার হলেও পুরান ঢাকায় এর স্বাদ অতুলনীয়। নরম বড়া, মিষ্টি দই, চাট মসলা, তেঁতুল জল—সব মিলিয়ে এক অনন্য স্বাদের পরিবেশনা।
হালিম বরাবরের মতোই শীতকাল ও রমজানের একটি জনপ্রিয় খাবার। নানা রকম ডাল, মাংস, ঘি ও মসলা একত্রে পিষে তৈরি হয় এই খাবার, যা সাধারণত নরম রুটি কিংবা জিলাপির সঙ্গে খাওয়া হয়।
ফালুদা বা কুলফি ফালুদা এখানে ইরানি প্রভাবযুক্ত, যা তৈরি হয় নানা ধরনের নুডলস, দুধ, রুহ আফজা, বাদাম, বরফ ও কনডেন্সড মিল্ক দিয়ে।
পুরান ঢাকার প্রতিটি খাবারের পেছনে রয়েছে ইতিহাস, পারিবারিক ঐতিহ্য এবং শত বছরের অভিজ্ঞতা। এখানকার রান্নায় কেবল স্বাদই নয়, আছে আবেগ, আছে সংস্কৃতি। এই খাবারগুলো শুধু পেট ভরায় না, হৃদয়ও ছুঁয়ে যায়। বাংলাদেশের খাদ্য ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো পুরান ঢাকার খাবারসমূহ।