বয়স বাড়লেও বন্ধ হয় না যত্নের প্রয়োজন
মানবদেহের প্রতিটি বয়সেই যত্ন দরকার, তবে বয়স ৫০ পার হলে শরীর ও মনের জন্য আরও বেশি সচেতনতা জরুরি হয়ে পড়ে। নারীদের জন্য এই সময়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মেনোপজ-পরবর্তী হরমোনজনিত পরিবর্তন, হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া, পেশিশক্তি হ্রাস, এবং হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে ওষুধের পাশাপাশি জীবনধারাভিত্তিক পরিবর্তন—বিশেষ করে ব্যায়াম—একটি প্রমাণিত কার্যকর পন্থা।
অনেকে ধারণা করেন যে এই বয়সে ব্যায়াম ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই বয়স থেকেই নিয়মিত ব্যায়াম শুরু করলে শুধু অসুস্থতা প্রতিরোধই নয়, মানসিক প্রশান্তি, আত্মবিশ্বাস এবং কর্মক্ষমতা বহুগুণে বাড়ে।
কত সময় ব্যায়াম প্রয়োজন: বৈজ্ঞানিক নির্দেশনা অনুযায়ী সময় নির্ধারণ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC) যৌথভাবে ৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব নারীদের জন্য ব্যায়ামের সময়সীমা নির্ধারণ করেছে। তাদের মতে:
- • সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি মাত্রার অ্যারোবিক ব্যায়াম(যেমন দ্রুত হাঁটা, সাইক্লিং)
- • অথবা৭৫ মিনিট উচ্চমাত্রার অ্যারোবিক ব্যায়াম (যেমন সাঁতার কাটা, দৌড়ানো)
- • এর পাশাপাশিসপ্তাহে কমপক্ষে ২ দিন মাংসপেশি ও হাড় শক্তিশালী করার ব্যায়াম (যেমন ভারোত্তোলন, যোগব্যায়াম) প্রয়োজন।
অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করলে, সপ্তাহজুড়ে একটি বড়সড় স্বাস্থ্যসুরক্ষা গড়ে তোলা সম্ভব।
সাপ্তাহিক সময়সূচির নমুনা: ভারসাম্য বজায় রেখে পরিকল্পনা
যারা নতুন করে শুরু করতে চান, তাঁদের জন্য একটি সহজ সাপ্তাহিক পরিকল্পনা হতে পারে এমন:
- • সোম– বৃহস্পতিবার: প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে দ্রুত হাঁটা বা হালকা অ্যারোবিক ব্যায়াম
- • শুক্রবার ও রবিবার:হালকা ভারোত্তোলন, যোগব্যায়াম, রেজিস্ট্যান্স ব্যান্ড ব্যায়াম
- • শনিবার:স্ট্রেচিং-ভিত্তিক বিশ্রামমূলক রুটিন বা ধ্যানচর্চা
এই সময়সূচি অনুযায়ী শরীরের সব অংশে কার্যকর প্রভাব পড়ে—হৃদযন্ত্র, পেশি, হাড়, ফুসফুস এবং মন।
কোন ধরণের ব্যায়াম উপযোগী: প্রয়োজন অনুযায়ী বেছে নিন
১. কার্ডিওভাসকুলার ব্যায়াম – হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের বন্ধু
এই ধরণের ব্যায়াম হৃদযন্ত্র শক্তিশালী করে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে, কোলেস্টেরল কমায় এবং ওজন হ্রাসে সহায়ক।
উদাহরণ:
- • দ্রুত হাঁটা (যে কোনো পার্কে বা ট্রেডমিলে)
- • সাইকেল চালানো (ঘরের স্থির সাইকেল বা বাইরের রাস্তায়)
- • সাঁতার কাটা
- • কম-তীব্রতার অ্যারোবিক ক্লাস (গানের তালে সহজ ব্যায়াম)
২. শক্তিবর্ধক ব্যায়াম – পেশি ও হাড়ে বল ফেরায়
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পেশিশক্তি ও হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়। এই ক্ষয় ঠেকাতে দরকার শক্তি বাড়ানো অনুশীলন।
উদাহরণ:
- • হালকা ওজনের ডাম্বেল ব্যবহার
- • প্রতিরোধ ব্যান্ড দিয়ে স্কোয়াট বা পুশ-আপ
- • ওয়াল পুশ-আপস,লান্জেস
- • পানি-ভিত্তিক ব্যায়াম (যেমন অ্যাকুয়া স্ট্রেংথ এক্সারসাইজ)
৩. নমনীয়তা ও ভারসাম্য বৃদ্ধির ব্যায়াম
বয়স বাড়লে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে, তাই শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখা খুব জরুরি।
উদাহরণ:
- • যোগব্যায়াম (স্নিগ্ধ যোগ,পুনরুদ্ধারমূলক যোগ)
- • পিলেটস
- • তাই চি (চীনা ধীরগতির অনুশীলন)
- • স্ট্রেচিং– প্রতিদিন সকাল ও রাতে ১০ মিনিট করে সময় দিন
৪. মানসিক প্রশান্তির ব্যায়াম – দেহ-মনের সমন্বয়
চাপ, উদ্বেগ ও ঘুমের সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে সহায়ক কিছু ব্যায়াম:
- • ধ্যান (guided meditation)
- • নিঃশ্বাসের ব্যায়াম– অনুলোম-বিলোম, ডায়াফ্রাগম্যাটিক নিঃশ্বাস
- • প্রকৃতির মাঝে হাঁটা (forest bathing)
ব্যায়ামের সময় ও নিরাপত্তা নিয়ে পরামর্শ
- • ছোট করে শুরু করুন:দিনে ১০–১৫ মিনিট করেই শুরু করা যায়
- • ব্যথা বা ক্লান্তি হলে বিরতি দিন:শরীরের বার্তা শুনুন
- • বিশেষ শারীরিক সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:যেমন উচ্চ রক্তচাপ, হাড়ের ক্ষয়
- • ব্যায়ামের আগে ও পরে পর্যাপ্ত পানি পান করুন এবং হালকা স্ট্রেচিং করুন
- • পরিবার বা বন্ধুর সঙ্গে ব্যায়াম করুন:এতে অভ্যাস গড়তে সুবিধা হয়
বাস্তব জীবনের অনুপ্রেরণা: ঢাকার সাবিনা রহমান
ঢাকার উত্তরার ৫৭ বছর বয়সী সাবিনা রহমান একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার। মেনোপজের পর তাঁর ওজন বেড়ে গিয়েছিল, ঘুম কমে গিয়েছিল এবং প্রায়ই মন খারাপ থাকত। তখন চিকিৎসকের পরামর্শে প্রতিদিন ৪৫ মিনিট হাঁটা ও সপ্তাহে দু’দিন অ্যাকুয়া যোগা শুরু করেন।
তিনি বলেন,
“শরীর চাঙা না থাকলে মনও ভালো থাকে না। আমি আবার বই পড়া, রান্না, বাগান—এসব করতে আগ্রহ পাচ্ছি। ব্যায়াম আমাকে জীবনের স্বাদ ফিরিয়ে দিয়েছে।”
এই বয়সেও আপনি পারবেন
৫০ পেরিয়ে গেলে জীবন থেমে যায় না—বরং একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ব্যায়াম এই অধ্যায়ের অন্যতম প্রধান সহযাত্রী। এটি শুধু রোগ প্রতিরোধ নয়, আত্মবিশ্বাস, মানসিক শক্তি ও জীবনের আনন্দ ফিরিয়ে আনে। তাই ভয় নয়, নিয়মিত অনুশীলন শুরু করুন। ধীরে ধীরে শুরু করুন, নিজের পছন্দের ব্যায়াম বেছে নিন, এবং নিজের জন্যও সময় রাখুন।
এই বয়সেও আপনি পারবেন—শুধু চর্চা, ধৈর্য আর সদিচ্ছা থাকলেই যথেষ্ট।