১২:০৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ০২ অগাস্ট ২০২৫

গিভার্নির মোনে উদ্যানে এক অনন্ত পাহারা

 জীবন্ত চিত্রকর্ম রক্ষার সংগ্রাম

ফরাসি চিত্রশিল্পী ক্লোদ মোনে নিজ হাতে গড়ে তোলা গিভার্নির বাগান আজও রঙ, আলো আর জলের অপরূপ মিলনে দর্শকদের মুগ্ধ করে। তবে সময়, আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই যেন কখনই থামে না। এই জীবন্ত শিল্পকর্মকে টিকিয়ে রাখতে এখন কাজ করছেন নিবেদিতপ্রাণ একদল তত্ত্বাবধায়ক, যাঁদের ভালোবাসা আর নিষ্ঠাই বাগানটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

ভোরের একমাত্র সঙ্গী: ক্লদেট লিন্ডসে

মোনে যেমন ভোরের আলো ফোটার আগেই ক্যানভাস হাতে বাগানে নামতেন, তেমনি আজও সেই সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে জেগে ওঠেন ক্লদেট লিন্ডসে। প্রায় ৪০ বছর ধরে বাগানের পূর্ব প্রান্তের গোলাপি রঙের ছোট্ট বাড়িতে বাস করছেন তিনি। গাছপালা, দৃষ্টিনন্দন গোলাপের খুঁটিনাটি বদল আর নরম কাঁকর-বালুর পথ—সবকিছুর নীরব পর্যবেক্ষক লিন্ডসে জানেন, প্রতিটি মৌসুমেই নতুন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করে। বজ্রঝড়ে ভেঙে পড়া উইলো গাছের ডালপালা তুলে ফেলতে গিয়ে তাঁর চোখে জল এসেছিল; কারণ তাঁর মতে, ‘এখানকার শিল্প তো জাদুঘরের মতো স্থির নয়—প্রতিনিয়ত বদলায়।’

জলবায়ু সংকট: শীতের তুষার কমে, রোগপোকা বাড়ে

গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে গিভার্নিতে এখন বরফ পড়ে কম, শীতের বৃষ্টিও বেশি। ভারী বৃষ্টি টপসয়েল ছুড়ে ফেলে, বাগান ভারী করে তোলে। গ্রীষ্মের শুরুতেই এফিডের হামলা আরও তীব্র—কীটনাশক নিষিদ্ধ হওয়ায় মোনে বাগানে জৈব ‘মার্সেনারি’ পোকাদের ভরসা করে এফিড দমন চলে, কখনও বা শক্ত জলের ধারা ব্যবহার করা হয়। তবু ঝড়ে উপড়ে যাওয়া গাছ, আগাম বসন্তের তাপ—সবই বাড়তি ঝুঁকি।

সমাধির রক্ষণাবেক্ষণ: গিলবেয়ার বহৈ’র নৈঃশব্দ্য

৭৭ বছর বয়সেও প্রাক্তন প্রধান মালী গিলবেয়ার বহৈ প্রতি সপ্তাহে মোনের সমাধিতে ফুল লাগান। সেন্ট রাডেগুন্ড গির্জার সিঁড়িতে ধীর পায়ে ওঠা বহৈ বলেন, ‘ফুঁসে ওঠা পর্যটকদের হাত থেকে কবরে লাগানো হায়াসিন্থ আর সাইক্লেমেনই রক্ষা করে।’ উত্তরাধিকারের দাবিনামা থাকলেও, বাস্তবে তাঁর হাতেই পড়েছে শিল্পীর শেষ শয্যা রক্ষা করার দায়।

রঙের তত্ত্ব: পশ্চিমে উষ্ণ, পূর্বে শীতল ছায়া

মোনে সামগ্রিক আলোকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিম অংশে লাল–কমলা–হলুদ ফুল লাগাতেন, যাতে বিকেলের রোদ্দুরে উজ্জ্বলতা বাড়ে। পূর্ব দিকে নীল–বেগুনি ফুল শীতল, মৃদু আলো ফেরত দেয়। আজও সেই নীতি মেনে বাগানে রোপণ হয় হাজার হাজার বাল্ব। উদ্ভিদবিদ ও মালী ক্লেয়ারের-হেলেন মারোঁর দায়িত্বে থাকা বাগানের একটি লম্বা ক্যাম্পাসে ১,৫০০ বাল্ব, আরেকটিতে ১,২০০—সাবধানে বাছাই করা রঙের ভারসাম্য যেন অক্ষুণ্ণ থাকে।

নিত্য নজরদারি: প্রধান মালী জ্যঁ-মারি আভিজারের পদচারণা

বাগানের প্রধান মালী জ্যঁ-মারি আভিজার দিনে কয়েকবার পুরো বাগান হেঁটে ঘুরে দেখেন। শুকনো ড্যাফোডিলের মাথা ছিঁড়ে ফেলা, বিবর্ণ সেজ গাছ সমূলে তুলে ফেলা—সব কাজই তিনি নিজেই করেন। তাঁর মতে, ‘এখানে আমরা যা সুন্দর নয়—সেই দিকেই সবার আগে নজর দিই।’ যতক্ষণ না দর্শনার্থীরা ভিড় জমায়, ততক্ষণেই তাঁদের নিঃশব্দ দৌড়ঝাঁপ।

জীবন্ত উত্তরাধিকারের অমোঘ ডাক

মোনের বাগান, তাঁর রঙ-ধারণার সুস্পষ্ট প্রয়োগ আর প্রকৃতির অপরূপ জৌলুস—সব মিলিয়ে গিভার্নি এক চলমান ক্যানভাস। জলবায়ু পরিবর্তন হোক কিংবা পর্যটকের ভিড়, প্রতিটি মৌসুমই নতুন লড়াই বয়ে আনে। তবু ক্লদেট লিন্ডসে থেকে জ্যঁ-মারি আভিজার—সবার হাতে হাত, চোখে অভিনিবেশ, আর মনে অগাধ শ্রদ্ধা নিয়ে এই বাগান আগামীর দিকে এগিয়ে চলেছে। কারণ তাঁদের বিশ্বাস, শিল্পীর বীজ থেকে জন্ম নেওয়া এই প্রাণবন্ত সৌন্দর্য কখনও মুছে যেতে দেওয়া যাবে না।

জনপ্রিয় সংবাদ

গিভার্নির মোনে উদ্যানে এক অনন্ত পাহারা

১১:০০:৫৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ অগাস্ট ২০২৫

 জীবন্ত চিত্রকর্ম রক্ষার সংগ্রাম

ফরাসি চিত্রশিল্পী ক্লোদ মোনে নিজ হাতে গড়ে তোলা গিভার্নির বাগান আজও রঙ, আলো আর জলের অপরূপ মিলনে দর্শকদের মুগ্ধ করে। তবে সময়, আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই যেন কখনই থামে না। এই জীবন্ত শিল্পকর্মকে টিকিয়ে রাখতে এখন কাজ করছেন নিবেদিতপ্রাণ একদল তত্ত্বাবধায়ক, যাঁদের ভালোবাসা আর নিষ্ঠাই বাগানটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

ভোরের একমাত্র সঙ্গী: ক্লদেট লিন্ডসে

মোনে যেমন ভোরের আলো ফোটার আগেই ক্যানভাস হাতে বাগানে নামতেন, তেমনি আজও সেই সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে জেগে ওঠেন ক্লদেট লিন্ডসে। প্রায় ৪০ বছর ধরে বাগানের পূর্ব প্রান্তের গোলাপি রঙের ছোট্ট বাড়িতে বাস করছেন তিনি। গাছপালা, দৃষ্টিনন্দন গোলাপের খুঁটিনাটি বদল আর নরম কাঁকর-বালুর পথ—সবকিছুর নীরব পর্যবেক্ষক লিন্ডসে জানেন, প্রতিটি মৌসুমেই নতুন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করে। বজ্রঝড়ে ভেঙে পড়া উইলো গাছের ডালপালা তুলে ফেলতে গিয়ে তাঁর চোখে জল এসেছিল; কারণ তাঁর মতে, ‘এখানকার শিল্প তো জাদুঘরের মতো স্থির নয়—প্রতিনিয়ত বদলায়।’

জলবায়ু সংকট: শীতের তুষার কমে, রোগপোকা বাড়ে

গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে গিভার্নিতে এখন বরফ পড়ে কম, শীতের বৃষ্টিও বেশি। ভারী বৃষ্টি টপসয়েল ছুড়ে ফেলে, বাগান ভারী করে তোলে। গ্রীষ্মের শুরুতেই এফিডের হামলা আরও তীব্র—কীটনাশক নিষিদ্ধ হওয়ায় মোনে বাগানে জৈব ‘মার্সেনারি’ পোকাদের ভরসা করে এফিড দমন চলে, কখনও বা শক্ত জলের ধারা ব্যবহার করা হয়। তবু ঝড়ে উপড়ে যাওয়া গাছ, আগাম বসন্তের তাপ—সবই বাড়তি ঝুঁকি।

সমাধির রক্ষণাবেক্ষণ: গিলবেয়ার বহৈ’র নৈঃশব্দ্য

৭৭ বছর বয়সেও প্রাক্তন প্রধান মালী গিলবেয়ার বহৈ প্রতি সপ্তাহে মোনের সমাধিতে ফুল লাগান। সেন্ট রাডেগুন্ড গির্জার সিঁড়িতে ধীর পায়ে ওঠা বহৈ বলেন, ‘ফুঁসে ওঠা পর্যটকদের হাত থেকে কবরে লাগানো হায়াসিন্থ আর সাইক্লেমেনই রক্ষা করে।’ উত্তরাধিকারের দাবিনামা থাকলেও, বাস্তবে তাঁর হাতেই পড়েছে শিল্পীর শেষ শয্যা রক্ষা করার দায়।

রঙের তত্ত্ব: পশ্চিমে উষ্ণ, পূর্বে শীতল ছায়া

মোনে সামগ্রিক আলোকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিম অংশে লাল–কমলা–হলুদ ফুল লাগাতেন, যাতে বিকেলের রোদ্দুরে উজ্জ্বলতা বাড়ে। পূর্ব দিকে নীল–বেগুনি ফুল শীতল, মৃদু আলো ফেরত দেয়। আজও সেই নীতি মেনে বাগানে রোপণ হয় হাজার হাজার বাল্ব। উদ্ভিদবিদ ও মালী ক্লেয়ারের-হেলেন মারোঁর দায়িত্বে থাকা বাগানের একটি লম্বা ক্যাম্পাসে ১,৫০০ বাল্ব, আরেকটিতে ১,২০০—সাবধানে বাছাই করা রঙের ভারসাম্য যেন অক্ষুণ্ণ থাকে।

নিত্য নজরদারি: প্রধান মালী জ্যঁ-মারি আভিজারের পদচারণা

বাগানের প্রধান মালী জ্যঁ-মারি আভিজার দিনে কয়েকবার পুরো বাগান হেঁটে ঘুরে দেখেন। শুকনো ড্যাফোডিলের মাথা ছিঁড়ে ফেলা, বিবর্ণ সেজ গাছ সমূলে তুলে ফেলা—সব কাজই তিনি নিজেই করেন। তাঁর মতে, ‘এখানে আমরা যা সুন্দর নয়—সেই দিকেই সবার আগে নজর দিই।’ যতক্ষণ না দর্শনার্থীরা ভিড় জমায়, ততক্ষণেই তাঁদের নিঃশব্দ দৌড়ঝাঁপ।

জীবন্ত উত্তরাধিকারের অমোঘ ডাক

মোনের বাগান, তাঁর রঙ-ধারণার সুস্পষ্ট প্রয়োগ আর প্রকৃতির অপরূপ জৌলুস—সব মিলিয়ে গিভার্নি এক চলমান ক্যানভাস। জলবায়ু পরিবর্তন হোক কিংবা পর্যটকের ভিড়, প্রতিটি মৌসুমই নতুন লড়াই বয়ে আনে। তবু ক্লদেট লিন্ডসে থেকে জ্যঁ-মারি আভিজার—সবার হাতে হাত, চোখে অভিনিবেশ, আর মনে অগাধ শ্রদ্ধা নিয়ে এই বাগান আগামীর দিকে এগিয়ে চলেছে। কারণ তাঁদের বিশ্বাস, শিল্পীর বীজ থেকে জন্ম নেওয়া এই প্রাণবন্ত সৌন্দর্য কখনও মুছে যেতে দেওয়া যাবে না।