০৯:৪১ অপরাহ্ন, শনিবার, ০২ অগাস্ট ২০২৫
হিউএনচাঙ (পর্ব-১৬১) ড্রাগ বা ডায়েট ছাড়া কীভাবে চীনে এক ইনফ্লুয়েন্সার পাঁচ বছরে ৬০ কেজি ওজন কমিয়েছেন ট্রাম্পের ট্যারিফে আফ্রিকা চীনের কোলে মাশরাফি বিন মর্তুজা: বাংলাদেশের এক মহান ক্রিকেটারের জীবনগাথা ট্রাম্পের শুল্ক ভারতের ৪০ বিলিয়ন ডলারের রফতানির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে ফেডারেল তহবিল কাটা যাওয়ায় পাবলিক ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন বন্ধ, স্থানীয় গণমাধ্যমে বড় ধাক্কা ট্রেড আলোচনা স্থবির, শুল্ক হুমকি বাড়ছে: যুক্তরাষ্ট্র–ভারত অংশীদারিত্বে টানাপোড়ন  বাংলাদেশে দুই কোটি হিন্দুর ও প্রগতিশীল মুসলিমদের ভবিষ্যত কি? জলঢাকা নদী: ইতিহাস, পথচলা ও বর্তমান বাস্তবতা বাংলাদেশে কার্প মাছ চাষ: দেশি মাছের বৈচিত্র্য ধ্বংসের হুমকি ও করণীয়

মাশরাফি বিন মর্তুজা: বাংলাদেশের এক মহান ক্রিকেটারের জীবনগাথা

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মাশরাফি বিন মর্তুজা। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮৩ সালের ৫ অক্টোবর, নড়াইল জেলার মহিষখোলা নামক গ্রামে (বর্তমানে এটি মাশরাফি-সদর রোড নামে পরিচিত)। ছোটবেলা থেকেই মাশরাফি ছিলেন দুরন্ত ও প্রাণচঞ্চল। তিনি বেড়ে উঠেছেন নড়াইল শহরের সাধারণ একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে। তার বাবা গোলাম মর্তুজা এবং মা হামিদা মর্তুজার আদর-ভালোবাসায় গড়ে উঠেছিল মাশরাফির শৈশব। স্কুলজীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি ছিল প্রবল ঝোঁক, বিশেষ করে ফুটবল ও ক্রিকেট।

তার পরিবারে খেলাধুলাকে উৎসাহ দেওয়া হতো না, তবুও মাশরাফি ফুটবল ও ক্রিকেটে দারুণ মনোযোগী ছিলেন। গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই কিশোর পড়াশোনার ফাঁকে সুযোগ পেলেই খেলাধুলায় মেতে উঠতেন। শুরুতে বন্ধুদের সঙ্গে গলি ক্রিকেট খেলেই তার প্রতিভার প্রকাশ ঘটে। স্থানীয় খেলাধুলার ময়দানে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে কিশোর বয়সেই।

ক্রিকেটে প্রথম পদচারণা

মাশরাফি শুরুতে ছিলেন একজন দ্রুতগতির বোলার। ২০০১ সালে তিনি টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক করেন। তার টেস্ট অভিষেক ঘটে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, আর ওয়ানডে অভিষেক ঘটে ভারতের বিপক্ষে। সেই সময় তার দুরন্ত বোলিং গতি ও আগ্রাসী মনোভাব ক্রিকেট বোদ্ধাদের নজর কাড়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মাশরাফি তার ক্যারিয়ারে বারবার চোটের সম্মুখীন হন — বিশেষ করে হাঁটুতে। মোট সাতবার বড় ধরনের অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছিল তাকে। তবুও দমে যাননি। চোট কাটিয়ে ফিরে এসেছেন প্রতিবারই আরও শক্তিশালী হয়ে।

জাতীয় দলের হয়ে প্রথমবার মাঠে নামার পর থেকেই মাশরাফি পরিচিত হন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ নামে। তার বোলিং ছিল আগ্রাসী, গতি ছিল দুর্ধর্ষ। ১৪০ কিমি/ঘণ্টা গতিতে বল করতে পারতেন তিনি, যা বাংলাদেশের জন্য সেই সময়ে বিরল প্রতিভা ছিল। চোটের কারণে মাঝে মাঝে দীর্ঘ সময় দলের বাইরে থাকলেও প্রত্যাবর্তনের পর তার পারফরম্যান্স আরও দৃঢ় ও পরিপক্ব হয়ে ওঠে।

অধিনায়কত্ব ও স্বর্ণযুগ

২০০৯ সালে তিনি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হন। পরে ২০১৪ সালে পুনরায় অধিনায়কত্ব পান ওয়ানডে দলে। তার অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ, ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয়, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয়—সবই ঘটেছে তার নেতৃত্বে। মাঠে তার নেতৃত্বের দক্ষতা, সাহস, এবং সতীর্থদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার ক্ষমতা তাকে একজন কিংবদন্তি নেতায় পরিণত করে।

তার নেতৃত্বেই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ওয়ানডে র‍্যাংকিংয়ে সেরা ছয়ে পৌঁছে যায়। তিনি ক্রিকেটারদের মাঝে একটি দলগত চেতনা ও বিজয়ের মানসিকতা তৈরি করেন। তরুণ খেলোয়াড়দের পেছনে থেকে গাইড করা, চাপের মুহূর্তে সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব নেওয়া—এসব গুণে তিনি এক অনন্য অধিনায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

ব্যক্তিগত জীবন ও সংসার

মাশরাফি ২০০৬ সালে সুমনা হক সুমিকে বিয়ে করেন। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে—ছেলের নাম সাহেল এবং মেয়ের নাম হুমায়রা। পরিবারকেন্দ্রিক জীবনযাপন করেন মাশরাফি। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের পাশাপাশি তিনি সবসময় পরিবারের প্রতি দারুণ যত্নবান ছিলেন। ক্রিকেট মাঠে যেমন তিনি ছিলেন সাহসী, পরিবারেও তিনি একজন দায়িত্বশীল স্বামী ও পিতা।

বিয়ের পর তিনি সবসময় চেষ্টা করেছেন খেলার বাইরেও পরিবারকে যথাসম্ভব সময় দিতে। আন্তর্জাতিক সফরের ফাঁকেও সন্তানদের খোঁজ-খবর রাখা এবং তাদের সঙ্গে সময় কাটানো মাশরাফির জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তার জীবনসঙ্গিনী সবসময় তার পাশে ছিলেন এবং চোটের কঠিন সময়গুলোতে সুমির সমর্থনই ছিল তার মানসিক শক্তির বড় উৎস।

রাজনীতিতে পদার্পণ

ক্রিকেটের পাশাপাশি মাশরাফি ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নড়াইল-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একজন জনপ্রিয় ক্রীড়াবিদ হিসেবে তিনি রাজনীতিতেও মানুষেরও আস্থা অর্জন করেন। তিনি তার নির্বাচনী এলাকায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও খেলাধুলা উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।

নির্বাচনের আগে তিনি বলেছিলেন, “আমি রাজনীতি করতে আসিনি, আমি কাজ করতে এসেছি।” এই মনোভাব থেকেই তিনি এলাকায় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেন। হাসপাতাল আধুনিকীকরণ, স্কুল-কলেজগুলোর উন্নয়ন, রাস্তাঘাট মেরামত এবং তরুণদের জন্য খেলাধুলার সুযোগ বাড়ানোসহ নানা কাজের মাধ্যমে তিনি নিজেকে একজন সচেতন ও কর্মঠ সংসদ সদস্য হিসেবে প্রমাণ করেছেন।

জীবনধারা ও মানবিকতা

মাশরাফির জীবনধারা অত্যন্ত সাধারণ ও সহজ-সরল। তিনি বিলাসবহুল জীবনের অনুসারী নন, বরং সাধারণ পোশাক-পরিচ্ছদ ও সহজ-সরল আচরণে মানুষকে আপন করে তোলেন। তার মানবিক কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে প্রশংসিত। করোনাকালে এবং অন্যান্য দুর্যোগে তিনি নড়াইলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ত্রাণ বিতরণ করেন। এছাড়া ‘নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশন’ গঠন করে তিনি স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ক্রীড়াক্ষেত্রে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

তার এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বহু দরিদ্র মানুষ চিকিৎসা পেয়েছে, শিক্ষার্থীরা পেয়েছে সহায়তা, এবং অসচ্ছল ক্রীড়াবিদরা পেয়েছে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা। এমনকি নিজের ম্যাচ ফি বা পুরস্কারের অর্থ দিয়েও তিনি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এসব মানবিক কাজই তার ব্যক্তিত্বকে করে তুলেছে আরও উজ্জ্বল।

অবসর ও উত্তরাধিকার

২০২০ সালে মাশরাফি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে আনুষ্ঠানিক অবসরের ঘোষণা দেন। তবে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন একজন কিংবদন্তি ক্রিকেটার ও নেতা হিসেবে। তার নেতৃত্ব, সংগ্রাম, সংকল্প ও মানবিকতাই তাকে মহান করে তুলেছে।

তার অবসর গ্রহণের পর অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষক বলেছেন, “মাশরাফি শুধু একজন খেলোয়াড় ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের মূল চালিকাশক্তি।” তার ক্রিকেটীয় মেধা, মানসিক দৃঢ়তা এবং সততার জন্য তিনি অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে থাকবেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে।

মানুষের ভালোবাসার মানুষ

মাশরাফি বিন মর্তুজা কেবল একজন ক্রিকেটার নন, তিনি বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে এক অনন্য অনুপ্রেরণা। সাহস, সংকল্প, মানবিকতা ও নেতৃত্ব—এই চারটি গুণে তিনি হয়ে উঠেছেন কোটি মানুষের ভালোবাসার মানুষ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তিনি রইবেন এক উদাহরণ, এক জীবন্ত কিংবদন্তি।

মাশরাফির জীবন কেবল খেলার মাঠে সীমাবদ্ধ নয়—তিনি একজন আদর্শ সন্তান, দায়িত্বশীল স্বামী, নিবেদিত পিতা, সফল নেতা ও মানবিক সমাজকর্মী। এই বহুমাত্রিক পরিচয়ই তাকে করে তুলেছে সত্যিকার অর্থে মহান।

জনপ্রিয় সংবাদ

হিউএনচাঙ (পর্ব-১৬১)

মাশরাফি বিন মর্তুজা: বাংলাদেশের এক মহান ক্রিকেটারের জীবনগাথা

০৭:০০:৫৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ অগাস্ট ২০২৫

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মাশরাফি বিন মর্তুজা। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮৩ সালের ৫ অক্টোবর, নড়াইল জেলার মহিষখোলা নামক গ্রামে (বর্তমানে এটি মাশরাফি-সদর রোড নামে পরিচিত)। ছোটবেলা থেকেই মাশরাফি ছিলেন দুরন্ত ও প্রাণচঞ্চল। তিনি বেড়ে উঠেছেন নড়াইল শহরের সাধারণ একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে। তার বাবা গোলাম মর্তুজা এবং মা হামিদা মর্তুজার আদর-ভালোবাসায় গড়ে উঠেছিল মাশরাফির শৈশব। স্কুলজীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি ছিল প্রবল ঝোঁক, বিশেষ করে ফুটবল ও ক্রিকেট।

তার পরিবারে খেলাধুলাকে উৎসাহ দেওয়া হতো না, তবুও মাশরাফি ফুটবল ও ক্রিকেটে দারুণ মনোযোগী ছিলেন। গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই কিশোর পড়াশোনার ফাঁকে সুযোগ পেলেই খেলাধুলায় মেতে উঠতেন। শুরুতে বন্ধুদের সঙ্গে গলি ক্রিকেট খেলেই তার প্রতিভার প্রকাশ ঘটে। স্থানীয় খেলাধুলার ময়দানে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে কিশোর বয়সেই।

ক্রিকেটে প্রথম পদচারণা

মাশরাফি শুরুতে ছিলেন একজন দ্রুতগতির বোলার। ২০০১ সালে তিনি টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক করেন। তার টেস্ট অভিষেক ঘটে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, আর ওয়ানডে অভিষেক ঘটে ভারতের বিপক্ষে। সেই সময় তার দুরন্ত বোলিং গতি ও আগ্রাসী মনোভাব ক্রিকেট বোদ্ধাদের নজর কাড়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মাশরাফি তার ক্যারিয়ারে বারবার চোটের সম্মুখীন হন — বিশেষ করে হাঁটুতে। মোট সাতবার বড় ধরনের অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছিল তাকে। তবুও দমে যাননি। চোট কাটিয়ে ফিরে এসেছেন প্রতিবারই আরও শক্তিশালী হয়ে।

জাতীয় দলের হয়ে প্রথমবার মাঠে নামার পর থেকেই মাশরাফি পরিচিত হন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ নামে। তার বোলিং ছিল আগ্রাসী, গতি ছিল দুর্ধর্ষ। ১৪০ কিমি/ঘণ্টা গতিতে বল করতে পারতেন তিনি, যা বাংলাদেশের জন্য সেই সময়ে বিরল প্রতিভা ছিল। চোটের কারণে মাঝে মাঝে দীর্ঘ সময় দলের বাইরে থাকলেও প্রত্যাবর্তনের পর তার পারফরম্যান্স আরও দৃঢ় ও পরিপক্ব হয়ে ওঠে।

অধিনায়কত্ব ও স্বর্ণযুগ

২০০৯ সালে তিনি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হন। পরে ২০১৪ সালে পুনরায় অধিনায়কত্ব পান ওয়ানডে দলে। তার অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ, ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয়, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয়—সবই ঘটেছে তার নেতৃত্বে। মাঠে তার নেতৃত্বের দক্ষতা, সাহস, এবং সতীর্থদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার ক্ষমতা তাকে একজন কিংবদন্তি নেতায় পরিণত করে।

তার নেতৃত্বেই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ওয়ানডে র‍্যাংকিংয়ে সেরা ছয়ে পৌঁছে যায়। তিনি ক্রিকেটারদের মাঝে একটি দলগত চেতনা ও বিজয়ের মানসিকতা তৈরি করেন। তরুণ খেলোয়াড়দের পেছনে থেকে গাইড করা, চাপের মুহূর্তে সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব নেওয়া—এসব গুণে তিনি এক অনন্য অধিনায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

ব্যক্তিগত জীবন ও সংসার

মাশরাফি ২০০৬ সালে সুমনা হক সুমিকে বিয়ে করেন। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে—ছেলের নাম সাহেল এবং মেয়ের নাম হুমায়রা। পরিবারকেন্দ্রিক জীবনযাপন করেন মাশরাফি। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের পাশাপাশি তিনি সবসময় পরিবারের প্রতি দারুণ যত্নবান ছিলেন। ক্রিকেট মাঠে যেমন তিনি ছিলেন সাহসী, পরিবারেও তিনি একজন দায়িত্বশীল স্বামী ও পিতা।

বিয়ের পর তিনি সবসময় চেষ্টা করেছেন খেলার বাইরেও পরিবারকে যথাসম্ভব সময় দিতে। আন্তর্জাতিক সফরের ফাঁকেও সন্তানদের খোঁজ-খবর রাখা এবং তাদের সঙ্গে সময় কাটানো মাশরাফির জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তার জীবনসঙ্গিনী সবসময় তার পাশে ছিলেন এবং চোটের কঠিন সময়গুলোতে সুমির সমর্থনই ছিল তার মানসিক শক্তির বড় উৎস।

রাজনীতিতে পদার্পণ

ক্রিকেটের পাশাপাশি মাশরাফি ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নড়াইল-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একজন জনপ্রিয় ক্রীড়াবিদ হিসেবে তিনি রাজনীতিতেও মানুষেরও আস্থা অর্জন করেন। তিনি তার নির্বাচনী এলাকায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও খেলাধুলা উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।

নির্বাচনের আগে তিনি বলেছিলেন, “আমি রাজনীতি করতে আসিনি, আমি কাজ করতে এসেছি।” এই মনোভাব থেকেই তিনি এলাকায় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেন। হাসপাতাল আধুনিকীকরণ, স্কুল-কলেজগুলোর উন্নয়ন, রাস্তাঘাট মেরামত এবং তরুণদের জন্য খেলাধুলার সুযোগ বাড়ানোসহ নানা কাজের মাধ্যমে তিনি নিজেকে একজন সচেতন ও কর্মঠ সংসদ সদস্য হিসেবে প্রমাণ করেছেন।

জীবনধারা ও মানবিকতা

মাশরাফির জীবনধারা অত্যন্ত সাধারণ ও সহজ-সরল। তিনি বিলাসবহুল জীবনের অনুসারী নন, বরং সাধারণ পোশাক-পরিচ্ছদ ও সহজ-সরল আচরণে মানুষকে আপন করে তোলেন। তার মানবিক কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে প্রশংসিত। করোনাকালে এবং অন্যান্য দুর্যোগে তিনি নড়াইলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ত্রাণ বিতরণ করেন। এছাড়া ‘নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশন’ গঠন করে তিনি স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ক্রীড়াক্ষেত্রে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

তার এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বহু দরিদ্র মানুষ চিকিৎসা পেয়েছে, শিক্ষার্থীরা পেয়েছে সহায়তা, এবং অসচ্ছল ক্রীড়াবিদরা পেয়েছে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা। এমনকি নিজের ম্যাচ ফি বা পুরস্কারের অর্থ দিয়েও তিনি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এসব মানবিক কাজই তার ব্যক্তিত্বকে করে তুলেছে আরও উজ্জ্বল।

অবসর ও উত্তরাধিকার

২০২০ সালে মাশরাফি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে আনুষ্ঠানিক অবসরের ঘোষণা দেন। তবে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন একজন কিংবদন্তি ক্রিকেটার ও নেতা হিসেবে। তার নেতৃত্ব, সংগ্রাম, সংকল্প ও মানবিকতাই তাকে মহান করে তুলেছে।

তার অবসর গ্রহণের পর অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষক বলেছেন, “মাশরাফি শুধু একজন খেলোয়াড় ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের মূল চালিকাশক্তি।” তার ক্রিকেটীয় মেধা, মানসিক দৃঢ়তা এবং সততার জন্য তিনি অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে থাকবেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে।

মানুষের ভালোবাসার মানুষ

মাশরাফি বিন মর্তুজা কেবল একজন ক্রিকেটার নন, তিনি বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে এক অনন্য অনুপ্রেরণা। সাহস, সংকল্প, মানবিকতা ও নেতৃত্ব—এই চারটি গুণে তিনি হয়ে উঠেছেন কোটি মানুষের ভালোবাসার মানুষ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তিনি রইবেন এক উদাহরণ, এক জীবন্ত কিংবদন্তি।

মাশরাফির জীবন কেবল খেলার মাঠে সীমাবদ্ধ নয়—তিনি একজন আদর্শ সন্তান, দায়িত্বশীল স্বামী, নিবেদিত পিতা, সফল নেতা ও মানবিক সমাজকর্মী। এই বহুমাত্রিক পরিচয়ই তাকে করে তুলেছে সত্যিকার অর্থে মহান।