০৭:১৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৩ অগাস্ট ২০২৫
শান্তা পাল: ভুয়া ভারতীয় পরিচয়ে কলকাতায় গ্রেপ্তার বাংলাদেশি মডেল ও ফুড ভ্লগার লাতিন শিলালিপি উদ্ধার করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-২৫৪) সৌদি আরবে বন্যার সতর্কতা জারি পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে জাতীয় পার্টির সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল অশুভ বিশ্বাসে বিভীষিকাময় রাত: বিহারের টেটগামায় জাদুবিদ্যার অভিযোগে এক পরিবারে লিঞ্চিং ও হত্যাকাণ্ড সপ্তাহান্তের ছোটখাটো খুশি—ঢাকার হোটেলে একটি পরিবারের ডিনার পরিকল্পনা ট্রাম্প রাশিয়ার উত্তেজক বিবৃতির পর দুইটি পারমাণবিক সাবমেরিন স্থানান্তরের নির্দেশ দিলেন হিউএনচাঙ (পর্ব-১৬১) ড্রাগ বা ডায়েট ছাড়া কীভাবে চীনে এক ইনফ্লুয়েন্সার পাঁচ বছরে ৬০ কেজি ওজন কমিয়েছেন

লাতিন শিলালিপি উদ্ধার করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

ইতিহাসের হারানো লেখাগুলো ফিরে আসছে এআই-এর মাধ্যমে

ইতিহাস মূলত লেখা দলিলের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। কিন্তু যখন কোনো লেখার বয়স, উৎস কিংবা লেখকের পরিচয় জানা না যায়, বা লেখার অংশবিশেষ হারিয়ে যায়, তখন সেটি বিশ্লেষণ করা ইতিহাসবিদদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক বছর ধরেই গবেষকরা এই সমস্যার সমাধান খুঁজে আসছিলেন। এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই সেই কাজ সহজ করে দিচ্ছে।

প্রাচীন ভাষা উদ্ধারে এআই-এর ব্যবহার

গত কয়েক বছরে কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির মাধ্যমে অতীতের নানা নিদর্শন বিশ্লেষণের কাজ বেড়েছে। ব্যাবিলনের খণ্ডিত মাটির ফলক, প্রাচীন চীনা কচ্ছপের খোলায় খোদাই করা লেখা, এমনকি ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে পোড়া প্যাপিরাস স্ক্রলও ডিজিটালভাবে পড়ার কাজ করেছে এআই।

‘এইনিয়াস’: ইতিহাসের নতুন সহকারী

গুগল ডিপমাইন্ডের গবেষক ইয়ানিস আসায়েল এবং নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ থিয়া সামারশিল্ড মিলে তৈরি করেছেন একটি নতুন মডেল—‘এইনিয়াস’। রোমান পুরাণের একটি চরিত্রের নামে নাম রাখা এই মডেলটি লাতিন শিলালিপির ছবি ও পাঠ্য দুই-ই বিশ্লেষণ করতে পারে। এটি গ্রিক ভাষার ওপর তৈরি পূর্ববর্তী একটি মডেলের উন্নত সংস্করণ।

সাত শতকের শিলালিপির ওপর প্রশিক্ষণ

এইনিয়াস মডেলটি প্রশিক্ষিত হয়েছে প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার লাতিন শিলালিপির ডেটার ওপর, যেগুলো খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতক থেকে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতক পর্যন্ত বিস্তৃত। ব্রিটেন থেকে মেসোপটেমিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের শিলালিপির তথ্য এতে অন্তর্ভুক্ত।

অবিশ্বাস্য নির্ভুলতা

গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো অজানা লিপির সময়কাল নির্ধারণে এইনিয়াস মাত্র ১৩ বছরের পার্থকের মধ্যে সঠিক অনুমান দিতে পারে। আরও বড় সুবিধা হলো, এটি সম্পর্কিত অন্যান্য শিলালিপির সন্ধান দিতেও সক্ষম। প্রতিবছর প্রায় ১৫০০ নতুন লাতিন শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়, এবং এই বিপুল তথ্যের মধ্যে সম্পর্ক বের করা ইতিহাসবিদদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এআই সে কাজ সহজ করছে।

মানুষের চেয়ে কার্যকর

এইনিয়াস রোমান সাম্রাজ্যের সময়কার মানুষের বিশ্বাস, চিন্তাধারা ও সামাজিক অবস্থার চিত্র স্পষ্ট করতে পারছে। যেমন, তৃতীয় শতকে জার্মানীর মাইনজ শহরের একটি বেদির লেখা বিশ্লেষণ করে মডেলটি একই ধরনের লেখা খুঁজে পেয়েছে বন শহর থেকে শুরু করে বুলগেরিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায়। এভাবে নতুন ইতিহাস আবিষ্কারে সাহায্য করছে এটি।

খণ্ডিত লেখাও পূরণ করতে পারে

অনেক শিলালিপিই সময়ের ব্যবধানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এইনিয়াস এমন ফাঁকা জায়গাগুলো পূরণে সক্ষম। যখন শিলালিপির লেখার মোট দৈর্ঘ্য জানা থাকে, তখন মডেলটি ২০টি সম্ভাব্য অনুমানের মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ সময় সঠিক অংশ অনুমান করতে পারে। তবে দৈর্ঘ্য অজানা হলে সঠিকতার হার কিছুটা কমে ৩৩ শতাংশের মতো হয়। ভবিষ্যতে এটি আরও উন্নত হবে বলে আশা করা যায়।

অনুমানের পেছনের যুক্তিও ব্যাখ্যা করতে পারে

এইনিয়াস শুধু অনুমানই করে না, বরং কোন কোন শব্দ বা তথ্য তার সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছে, সেটাও ব্যাখ্যা করতে পারে। এর জন্য রয়েছে “saliency map” নামের একটি ভিজ্যুয়াল টুল, যা মডেলকে কীভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে তা দেখায়।

ইতিহাসবিদদের সঙ্গে যৌথ গবেষণার সুফল

এই মডেলের কার্যকারিতা যাচাই করতে ২৩ জন ইতিহাসবিদকে নিয়ে একটি পরীক্ষা চালানো হয়। তাদের দেওয়া পাঠ্য থেকে লেখার উৎস বা পরিচয় সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দেখা গেছে, মানুষ ও এআই একসঙ্গে কাজ করলে ফলাফল আরও নিখুঁত হয়। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে ইতিহাসবিদরা বলেছেন, এইনিয়াস যে প্রেক্ষাপট দিয়েছে, তা তাদের বিশ্লেষণে সহায়ক ছিল। অনেকে বলেছেন, এই মডেল এমন তথ্য সামনে এনেছে, যা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে দিয়েছে।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

গবেষকদের মতে, ভবিষ্যতে এই ধরনের মডেল চ্যাটবটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আরও কার্যকর হবে। ইতিহাসবিদরা তখন সাধারণ ভাষায় প্রশ্ন করে প্রাচীন তথ্য জানতে পারবেন। শুধু লাতিন নয়, অন্যান্য প্রাচীন ভাষার ক্ষেত্রেও এআই ব্যবহার করা যাবে। ড. আসায়েল মনে করেন, যত বেশি তথ্য হাতে থাকবে, তত সমৃদ্ধ হবে ইতিহাস।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন ইতিহাসচর্চায় নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। শুধু অনুসন্ধান নয়, বরং হারিয়ে যাওয়া বার্তা, বিস্মৃত সমাজ ও সংস্কৃতির গল্প খুঁজে পেতে এই প্রযুক্তি হয়ে উঠছে ইতিহাসবিদদের এক নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার।

জনপ্রিয় সংবাদ

শান্তা পাল: ভুয়া ভারতীয় পরিচয়ে কলকাতায় গ্রেপ্তার বাংলাদেশি মডেল ও ফুড ভ্লগার

লাতিন শিলালিপি উদ্ধার করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

০৪:০০:১৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩ অগাস্ট ২০২৫

ইতিহাসের হারানো লেখাগুলো ফিরে আসছে এআই-এর মাধ্যমে

ইতিহাস মূলত লেখা দলিলের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। কিন্তু যখন কোনো লেখার বয়স, উৎস কিংবা লেখকের পরিচয় জানা না যায়, বা লেখার অংশবিশেষ হারিয়ে যায়, তখন সেটি বিশ্লেষণ করা ইতিহাসবিদদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক বছর ধরেই গবেষকরা এই সমস্যার সমাধান খুঁজে আসছিলেন। এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই সেই কাজ সহজ করে দিচ্ছে।

প্রাচীন ভাষা উদ্ধারে এআই-এর ব্যবহার

গত কয়েক বছরে কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির মাধ্যমে অতীতের নানা নিদর্শন বিশ্লেষণের কাজ বেড়েছে। ব্যাবিলনের খণ্ডিত মাটির ফলক, প্রাচীন চীনা কচ্ছপের খোলায় খোদাই করা লেখা, এমনকি ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে পোড়া প্যাপিরাস স্ক্রলও ডিজিটালভাবে পড়ার কাজ করেছে এআই।

‘এইনিয়াস’: ইতিহাসের নতুন সহকারী

গুগল ডিপমাইন্ডের গবেষক ইয়ানিস আসায়েল এবং নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ থিয়া সামারশিল্ড মিলে তৈরি করেছেন একটি নতুন মডেল—‘এইনিয়াস’। রোমান পুরাণের একটি চরিত্রের নামে নাম রাখা এই মডেলটি লাতিন শিলালিপির ছবি ও পাঠ্য দুই-ই বিশ্লেষণ করতে পারে। এটি গ্রিক ভাষার ওপর তৈরি পূর্ববর্তী একটি মডেলের উন্নত সংস্করণ।

সাত শতকের শিলালিপির ওপর প্রশিক্ষণ

এইনিয়াস মডেলটি প্রশিক্ষিত হয়েছে প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার লাতিন শিলালিপির ডেটার ওপর, যেগুলো খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতক থেকে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতক পর্যন্ত বিস্তৃত। ব্রিটেন থেকে মেসোপটেমিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের শিলালিপির তথ্য এতে অন্তর্ভুক্ত।

অবিশ্বাস্য নির্ভুলতা

গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো অজানা লিপির সময়কাল নির্ধারণে এইনিয়াস মাত্র ১৩ বছরের পার্থকের মধ্যে সঠিক অনুমান দিতে পারে। আরও বড় সুবিধা হলো, এটি সম্পর্কিত অন্যান্য শিলালিপির সন্ধান দিতেও সক্ষম। প্রতিবছর প্রায় ১৫০০ নতুন লাতিন শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়, এবং এই বিপুল তথ্যের মধ্যে সম্পর্ক বের করা ইতিহাসবিদদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এআই সে কাজ সহজ করছে।

মানুষের চেয়ে কার্যকর

এইনিয়াস রোমান সাম্রাজ্যের সময়কার মানুষের বিশ্বাস, চিন্তাধারা ও সামাজিক অবস্থার চিত্র স্পষ্ট করতে পারছে। যেমন, তৃতীয় শতকে জার্মানীর মাইনজ শহরের একটি বেদির লেখা বিশ্লেষণ করে মডেলটি একই ধরনের লেখা খুঁজে পেয়েছে বন শহর থেকে শুরু করে বুলগেরিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায়। এভাবে নতুন ইতিহাস আবিষ্কারে সাহায্য করছে এটি।

খণ্ডিত লেখাও পূরণ করতে পারে

অনেক শিলালিপিই সময়ের ব্যবধানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এইনিয়াস এমন ফাঁকা জায়গাগুলো পূরণে সক্ষম। যখন শিলালিপির লেখার মোট দৈর্ঘ্য জানা থাকে, তখন মডেলটি ২০টি সম্ভাব্য অনুমানের মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ সময় সঠিক অংশ অনুমান করতে পারে। তবে দৈর্ঘ্য অজানা হলে সঠিকতার হার কিছুটা কমে ৩৩ শতাংশের মতো হয়। ভবিষ্যতে এটি আরও উন্নত হবে বলে আশা করা যায়।

অনুমানের পেছনের যুক্তিও ব্যাখ্যা করতে পারে

এইনিয়াস শুধু অনুমানই করে না, বরং কোন কোন শব্দ বা তথ্য তার সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছে, সেটাও ব্যাখ্যা করতে পারে। এর জন্য রয়েছে “saliency map” নামের একটি ভিজ্যুয়াল টুল, যা মডেলকে কীভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে তা দেখায়।

ইতিহাসবিদদের সঙ্গে যৌথ গবেষণার সুফল

এই মডেলের কার্যকারিতা যাচাই করতে ২৩ জন ইতিহাসবিদকে নিয়ে একটি পরীক্ষা চালানো হয়। তাদের দেওয়া পাঠ্য থেকে লেখার উৎস বা পরিচয় সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দেখা গেছে, মানুষ ও এআই একসঙ্গে কাজ করলে ফলাফল আরও নিখুঁত হয়। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে ইতিহাসবিদরা বলেছেন, এইনিয়াস যে প্রেক্ষাপট দিয়েছে, তা তাদের বিশ্লেষণে সহায়ক ছিল। অনেকে বলেছেন, এই মডেল এমন তথ্য সামনে এনেছে, যা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে দিয়েছে।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

গবেষকদের মতে, ভবিষ্যতে এই ধরনের মডেল চ্যাটবটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আরও কার্যকর হবে। ইতিহাসবিদরা তখন সাধারণ ভাষায় প্রশ্ন করে প্রাচীন তথ্য জানতে পারবেন। শুধু লাতিন নয়, অন্যান্য প্রাচীন ভাষার ক্ষেত্রেও এআই ব্যবহার করা যাবে। ড. আসায়েল মনে করেন, যত বেশি তথ্য হাতে থাকবে, তত সমৃদ্ধ হবে ইতিহাস।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন ইতিহাসচর্চায় নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। শুধু অনুসন্ধান নয়, বরং হারিয়ে যাওয়া বার্তা, বিস্মৃত সমাজ ও সংস্কৃতির গল্প খুঁজে পেতে এই প্রযুক্তি হয়ে উঠছে ইতিহাসবিদদের এক নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার।