উত্তরের দিনাজপুরে ছোট এক নদী হলেও ঢেপা তার ইতিহাস, বাস্তুতন্ত্র ও কৃষিজীবনের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠভাবে গাঁথা যে, তা শুধু পানি প্রবাহ নয়—এখনও এক জীবন্ত সামাজিক-অর্থনৈতিক ধারা। আজকের সময়ে নদীটি সংকটে; গত দুই শতকের পরিবর্তন, নদীর উপকারিতা ও সংকটের গল্পগুলো এখনো মানুষের জীবনে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করছে।
নদীর জন্ম, পথ ও প্রকৃত পরিচয়
স্থানীয়ভাবে ঢেপা নদীকে অনেকেই ছোট খাড়ি বা একটি আঞ্চলিক শাখা নদী হিসেবে জানেন, কিন্তু শুদ্ধ জলবিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যায় ঢেপা আত্রাই নদীর ডান তীর থেকে মোহনপুর এলাকায় পৃথক হয়ে সৃষ্টি হওয়া একটি প্রশাখা নদী। এটি করতোয়া-আত্রাই (বুড়ি তিস্তা) জলের শাখা হিসেবে উত্তরাঞ্চলের জলের জটিল নেটওয়ার্কের অংশ, এবং শেষে পুনর্ভবা নদীতে পতিত হয়। নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ কিলোমিটার এবং এটি জোয়ারের প্রভাবমুক্ত। বর্ষাকাল ব্যতীত নৌ চলাচল সাধারণত নিয়মিত হয় না; পুরো বছর জুড়ে পানি প্রবাহও হ্রাস পায়। এই জলপ্রবাহ দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে পুনর্ভবা নদীর সাথে মিলিত হওয়া পর্যন্ত আঁকাবাঁকা রূপ ধারণ করে।
প্রাচীনকালের ছাপ: বন-বনানী ও বৈচিত্র্যের যুগ
প্রায় দুই শত বছর আগে ঢেপা নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ বনভূমিতে শাল, গর্জন ও সেগুন গাছের আধিপত্য ছিল—এক সময় এই বনগুলো শুধু জৈববৈচিত্র্যের আধার নয়, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আবাদ ও জীবিকার মাধ্যম হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তখন এই অঞ্চলে হাতি, হরিণ, বনবিড়াল, শেয়াল এবং মাঝে মাঝে বুনো মহিষসহ নানা স্তন্যপায়ী প্রাণী বিচরণ করত। কৃষিজীবন ও বন্যপ্রাণীর সমন্বয়ে একটি সুসংহত প্রাকৃতিক পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। স্থানীয় ঐতিহাসিক স্মৃতিতে ঢেপাকে ‘প্রাচীনকালের সাক্ষী নদী’ বলা হয়ে থাকে, বিশেষ করে দিনাজপুরের কান্তজী মন্দিরের পাশে নদীর সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বের কারণে।
জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ
ঢেপা নদী ছিল উত্তর-পশ্চিম বাংলাদেশের অন্যতম মাছ প্রজনন ও আহরণ কেন্দ্র। ২০১৫ সালের এক বিস্তৃত জরিপে দেখা যায় নদীতে ৫৫ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ ছিল, যার মধ্যে ৪৮টি দেশীয় ও ৭টি বিদেশি উৎসের। সংরক্ষণ প্রকল্পের মাধ্যমে নদীর হুমকির মুখে থাকা প্রজাতিগুলোর পুনরুদ্ধারে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়।
২০১৩ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, নদীর শারীরিক ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতার জন্য উপযোগী ছিল, যা স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র ও অর্থনীতিতে প্রোটিন সরবরাহকারী হিসেবে বড় ভূমিকা পালন করত।
অন্যদিকে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, নদীর পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে দেশীয় মাছ প্রজাতি যেমন সেলমোফাসিয়া বাকাইলা-এর খাদ্যাভ্যাস ও শরীরের উপাদানগুলো মৌসুমভিত্তিক ভিন্নতা পাচ্ছে। পানি তাপমাত্রা, দ্রবীভূত অক্সিজেন ও পিএইচ মাত্রা স্থান ও ঋতু অনুসারে ওঠানামা করছে, যা মাছের স্বাস্থ্যে ও উৎপাদনে ঝুঁকি তৈরি করছে।
কৃষি ও মানুষের জীবিকা: নদীর ছোঁয়া
ঢেপা নদীর পানি এক সময় ছিল স্থানীয় কৃষকের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। নদীর সেচ সুবিধার কারণে ধান, গম, পাট, শাকসবজি ও তিলের মতো ফসল চাষ হতো; বহু পরিবার সেচ, গৃহস্থালি কাজ, হাঁস-মুরগি পালন ও মৎস্যজীবিকার মাধ্যমে নির্ভর করত এই নদীর ওপর। এক কৃষক বললেন, “ঢেপার পানি ছাড়া আমাদের ধানের অর্ধেক কাজও হতো না; এখন পানি কমে যাওয়ায় ফসলের ওপর চাপ বেড়েছে।” এক মৎস্যজীবী জানান, বর্ষার সময় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত এবং সেটাই তাদের পরিবারের প্রধান আয়ের উৎস ছিল। এই নদী এখানকার মানুষের সঙ্গে জীবন্ত সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, যা প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল।
পরিবর্তিত বাস্তবতা: সংকট ও পতন
বর্তমানে ঢেপা নদী তার পুরানো গতি ও রূপ হারাতে বসেছে। পানিপ্রবাহ অনেক কমে গেছে, অনেক স্থানে তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে, শিলা ও বালু জমে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে পড়েছে। অপরিকল্পিত বাঁধ, খনন না হওয়া, এবং বালু উত্তোলন নদীর গতি ব্যাহত করছে। শহর ও গ্রাম থেকে বর্জ্য পড়ে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে; জলজ জীববৈচিত্র্য ও মাছের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি প্রবাহ প্লাবনের ঝুঁকি বাড়ায়, আর শুকনো মৌসুমে মানুষ খরার মতো পরিস্থিতিতে পড়ে। স্থানীয়রা বলছেন, “আগে নদী ছিল যেন সরস্বতীর মতো—এখন অনেকটাই নিস্তেজ, পানি মিলছে না, মাছও কমে গেছে।”
সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক সংযোগ
ঢেপা নদী শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, এটি উত্তরাঞ্চলের লোকজ সংস্কৃতি ও ধর্মীয় স্থানগুলোর সঙ্গেও নিবিড়ভাবে যুক্ত। বিশেষ করে কান্তজী মন্দির এলাকার পরিবেশ ও নদীর সৌন্দর্য স্থানীয়দের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়ের অংশ। নদীকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত মাছ ধরার উৎসব, কৃষিজ ঐতিহ্য ও জীবনযাত্রা একে সাংস্কৃতিক প্রতীকে পরিণত করেছে।
সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের প্রস্তাবনা
ঢেপা নদীকে কেবল একটি ছোট নদী হিসেবে দেখলে তার বহুমাত্রিক গুরুত্ব উপেক্ষিত হয়। টেকসই ব্যবস্থাপনা ও পুনর্জীবনের জন্য কিছু উদ্যোগ প্রস্তাব করা যায়: নদীর নিয়মিত খনন ও ভরাট অপসারণ, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, পানি দূষণ রোধে কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মাছ প্রজনন ক্ষেত্র উন্নয়ন, এবং ফ্লো মডেল অনুসারে বাঁধ ও সেচ ব্যবস্থা চালু করা। পাশাপাশি স্থানীয় জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, সচেতনতা কর্মসূচি ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রকল্প। এই উদ্যোগগুলো প্রশাসনের সহযোগিতায় বাস্তবায়িত হলে ঢেপা আবার তার প্রাণ ফিরে পেতে পারে।
পরিসংখ্যানীয় সারাংশ
২০১৫ সালে নদীতে ৫৫টি মিঠা পানির মাছের প্রজাতি শনাক্ত হয়, যার বেশিরভাগই দেশীয়। ২০১৩ সালের গবেষণায় নদীটি প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদনক্ষম ও পরিবেশগতভাবে স্থিতিশীল বলে দেখা যায়। কিন্তু ২০২৫ সালের পরিস্থিতি সেই সক্ষমতা ও প্রজাতির স্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এই পরিবর্তন শুধু পরিবেশগত নয়, মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও জীবনব্যবস্থাতেও গভীর প্রভাব ফেলছে।
শেষ কথা
ঢেপা নদী, তার উৎস থেকে পতিত স্থান পর্যন্ত, শুধুমাত্র একটি জলপথ নয়—উত্তরবাংলার ইতিহাস, জীবিকা ও সংস্কৃতির অংশ। দুই শতকে নদীটি বদলে গেছে, প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে, তবে এখনো সময় আছে স্থানীয় অংশগ্রহণ, বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা ও সরকারি সহায়তার মাধ্যমে একে বাঁচিয়ে তোলার। এখন সময় ঢেপার গতি সচল করার, তার পাড়ের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই নদীকে টিকিয়ে রাখার।