০৮:৫৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৯ অগাস্ট ২০২৫

জলবায়ু পরিবর্তনে দক্ষিণ এশিয়ায় সাপের বংশবৃদ্ধিঃ ঢাকায় রাসেল ভাইপার ও চার প্রকার ভারতীয় গোখরো

নতুন হুমকি: জলবায়ু পরিবর্তনে বাড়ছে সাপের প্রজনন

২০২৫ সালের শুরুতে বিবিসি ও সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যাচ্ছে,  একাধিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় সাপের সংখ্যা ভয়াবহভাবে বাড়তে পারে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানের মতো দেশে ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা, অনিয়মিত বর্ষা এবং বন্যা-খরার পালাবদলে সাপের প্রজননের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। গবেষকদের মতে, তাপমাত্রা বাড়লে সাপের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার হার যেমন বাড়ে, তেমনি সাপের বেঁচে থাকার হারও বেড়ে যায়। এর ফল হিসেবে মানববসতির কাছাকাছি সাপের চলাফেরা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সাপের কামড়ের ঝুঁকিও বাড়ছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় সাপের কামড়ের ভয়াবহতা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হন, যার মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ মারা যান। এসব মৃত্যুর বেশিরভাগই ঘটে ভারত ও বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে, যেখানে অ্যান্টিভেনম সহজলভ্য নয় এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাও দুর্বল। গবেষণায় আরও বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী দশকে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্যা বা খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সাপ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বসতবাড়ি, খামার বা শহরাঞ্চলে চলে আসে, যা সাধারণ মানুষের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশের বাস্তবতা: শহরেও ছড়িয়ে পড়ছে সাপের উপস্থিতি

বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৭৫ হাজারের বেশি মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন প্রায় ৬ হাজার জন। গ্রামীণ অঞ্চলে এই সংখ্যা বেশি হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রামের মতো শহরেও সাপের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ড্রেনেজ ব্যবস্থার দুর্বলতা, জলাবদ্ধতা, গৃহপালিত পশু ও ইঁদুরের আধিক্য এবং পরিত্যক্ত ভবনের কারণে শহরাঞ্চলে সাপের বসবাসের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এটি শহরের নিম্নবিত্ত ও বস্তিবাসীদের জন্য বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

ঢাকায় রাসেল ভাইপার ও ভারতীয় গোখরোর হুমকি

ঢাকা মহানগরীতে সাম্প্রতিক সময়ে রাসেল ভাইপার ও ভারতীয় চার ধরনের বিষাক্ত গোখরো সাপের উপস্থিতি ধরা পড়েছে। বন অধিদপ্তর এবং বন্যপ্রাণী গবেষকদের মতে, মিরপুর, ডেমরা, মোহাম্মদপুর ও খিলগাঁও এলাকায় পরিত্যক্ত জমি, নালার আশপাশ এবং জলাবদ্ধ জায়গাগুলোতে এই সাপগুলো আশ্রয় নিচ্ছে। রাসেল ভাইপার অত্যন্ত বিষাক্ত; এর কামড়ে মৃত্যু না হলেও পঙ্গুত্ব বা অঙ্গহানি প্রায় নিশ্চিত। ভারতীয় গোখরো এবং তার উপপ্রজাতিগুলো (Monocled, Spectacled, Andaman cobra) নগরের আশপাশে ছড়িয়ে পড়ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।

সাপের কামড় প্রতিরোধে করণীয়

সাপের কামড়ের ঝুঁকি কমাতে হলে গ্রাম ও শহর উভয় জায়গায়ই সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। প্রথমত, বসতবাড়ি ও আশপাশের এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা জরুরি, যাতে ঝোপঝাড় বা পরিত্যক্ত বস্তুতে সাপ আশ্রয় নিতে না পারে। ড্রেন ও নালা নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে এবং জলাবদ্ধতা ঠেকাতে উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সাপের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত ইঁদুর বা ব্যাঙের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, কারণ এসব প্রাণীর আধিক্য সাপকে আকর্ষণ করে। তৃতীয়ত, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি—রাতে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার, পায়ের নিচে কিছু না দেখে হাঁটাহাঁটি না করা, এবং সাপের উপস্থিতি দেখলে দ্রুত স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে জানানো উচিত। সরকারকে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম নিশ্চিত করতে হবে এবং চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সাপের কামড়ের প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রশিক্ষিত করতে হবে। এছাড়া সাপ শনাক্ত ও উদ্ধারকারী দল গঠন, প্রচারাভিযান এবং পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এখন শুধু সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বা তাপদাহেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি জীববৈচিত্র্য এবং মানুষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তাকেও গুরুতর হুমকির মুখে ফেলছে। সাপের প্রজনন বৃদ্ধি এবং মানুষের বসতিতে সেগুলোর প্রবেশ এক ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে, যা দক্ষিণ এশিয়া তথা বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতের বড় সংকট হয়ে উঠতে পারে। এখনই যদি প্রয়োজনীয় সতর্কতা ও প্রস্তুতি গ্রহণ না করা হয়, তাহলে এই নিঃশব্দ শত্রু মানুষের জীবন ও নিরাপত্তাকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তনে দক্ষিণ এশিয়ায় সাপের বংশবৃদ্ধিঃ ঢাকায় রাসেল ভাইপার ও চার প্রকার ভারতীয় গোখরো

০৮:০০:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩ অগাস্ট ২০২৫

নতুন হুমকি: জলবায়ু পরিবর্তনে বাড়ছে সাপের প্রজনন

২০২৫ সালের শুরুতে বিবিসি ও সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যাচ্ছে,  একাধিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় সাপের সংখ্যা ভয়াবহভাবে বাড়তে পারে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানের মতো দেশে ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা, অনিয়মিত বর্ষা এবং বন্যা-খরার পালাবদলে সাপের প্রজননের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। গবেষকদের মতে, তাপমাত্রা বাড়লে সাপের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার হার যেমন বাড়ে, তেমনি সাপের বেঁচে থাকার হারও বেড়ে যায়। এর ফল হিসেবে মানববসতির কাছাকাছি সাপের চলাফেরা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সাপের কামড়ের ঝুঁকিও বাড়ছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় সাপের কামড়ের ভয়াবহতা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হন, যার মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ মারা যান। এসব মৃত্যুর বেশিরভাগই ঘটে ভারত ও বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে, যেখানে অ্যান্টিভেনম সহজলভ্য নয় এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাও দুর্বল। গবেষণায় আরও বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী দশকে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্যা বা খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সাপ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বসতবাড়ি, খামার বা শহরাঞ্চলে চলে আসে, যা সাধারণ মানুষের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশের বাস্তবতা: শহরেও ছড়িয়ে পড়ছে সাপের উপস্থিতি

বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৭৫ হাজারের বেশি মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন প্রায় ৬ হাজার জন। গ্রামীণ অঞ্চলে এই সংখ্যা বেশি হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রামের মতো শহরেও সাপের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ড্রেনেজ ব্যবস্থার দুর্বলতা, জলাবদ্ধতা, গৃহপালিত পশু ও ইঁদুরের আধিক্য এবং পরিত্যক্ত ভবনের কারণে শহরাঞ্চলে সাপের বসবাসের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এটি শহরের নিম্নবিত্ত ও বস্তিবাসীদের জন্য বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

ঢাকায় রাসেল ভাইপার ও ভারতীয় গোখরোর হুমকি

ঢাকা মহানগরীতে সাম্প্রতিক সময়ে রাসেল ভাইপার ও ভারতীয় চার ধরনের বিষাক্ত গোখরো সাপের উপস্থিতি ধরা পড়েছে। বন অধিদপ্তর এবং বন্যপ্রাণী গবেষকদের মতে, মিরপুর, ডেমরা, মোহাম্মদপুর ও খিলগাঁও এলাকায় পরিত্যক্ত জমি, নালার আশপাশ এবং জলাবদ্ধ জায়গাগুলোতে এই সাপগুলো আশ্রয় নিচ্ছে। রাসেল ভাইপার অত্যন্ত বিষাক্ত; এর কামড়ে মৃত্যু না হলেও পঙ্গুত্ব বা অঙ্গহানি প্রায় নিশ্চিত। ভারতীয় গোখরো এবং তার উপপ্রজাতিগুলো (Monocled, Spectacled, Andaman cobra) নগরের আশপাশে ছড়িয়ে পড়ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।

সাপের কামড় প্রতিরোধে করণীয়

সাপের কামড়ের ঝুঁকি কমাতে হলে গ্রাম ও শহর উভয় জায়গায়ই সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। প্রথমত, বসতবাড়ি ও আশপাশের এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা জরুরি, যাতে ঝোপঝাড় বা পরিত্যক্ত বস্তুতে সাপ আশ্রয় নিতে না পারে। ড্রেন ও নালা নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে এবং জলাবদ্ধতা ঠেকাতে উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সাপের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত ইঁদুর বা ব্যাঙের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, কারণ এসব প্রাণীর আধিক্য সাপকে আকর্ষণ করে। তৃতীয়ত, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি—রাতে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার, পায়ের নিচে কিছু না দেখে হাঁটাহাঁটি না করা, এবং সাপের উপস্থিতি দেখলে দ্রুত স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে জানানো উচিত। সরকারকে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম নিশ্চিত করতে হবে এবং চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সাপের কামড়ের প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রশিক্ষিত করতে হবে। এছাড়া সাপ শনাক্ত ও উদ্ধারকারী দল গঠন, প্রচারাভিযান এবং পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এখন শুধু সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বা তাপদাহেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি জীববৈচিত্র্য এবং মানুষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তাকেও গুরুতর হুমকির মুখে ফেলছে। সাপের প্রজনন বৃদ্ধি এবং মানুষের বসতিতে সেগুলোর প্রবেশ এক ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে, যা দক্ষিণ এশিয়া তথা বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতের বড় সংকট হয়ে উঠতে পারে। এখনই যদি প্রয়োজনীয় সতর্কতা ও প্রস্তুতি গ্রহণ না করা হয়, তাহলে এই নিঃশব্দ শত্রু মানুষের জীবন ও নিরাপত্তাকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।