কোথায় কমছে বিক্রি?
গত ছয় মাসে বাংলাদেশের কম্পিউটার বাজারে এক উল্লেখযোগ্য মন্দা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ডেস্কটপ ও ল্যাপটপ বিক্রি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোতেও। বাজারে ক্রেতার সংখ্যা কমে যাওয়ায় শীর্ষ ডিস্ট্রিবিউটররা স্টক ধরে রাখছে, নতুন পণ্য আনছে না, এমনকি কিছু খুচরা দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা অনলাইন বেচা-কেনায় ঝুঁকছে।
প্রধান কারণ: মধ্যবিত্তের ব্যয় সংকোচন ও ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস
বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীদের মতে, কম্পিউটার বিক্রির পতনের মূল কারণ দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি। গত এক বছরে মূল্যস্ফীতি, টাকার অবমূল্যায়ন এবং আমদানি ব্যয়ের চাপের কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আয়ের উপর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। শিক্ষা বা অফিসিয়াল ব্যবহারের জন্য যারা আগে নতুন ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কিনতেন, তারা এখন পুরনো মেশিন চালাচ্ছেন।
ঢাকার এক নামি কম্পিউটার মার্কেটের বিক্রেতা বলেন, “আগে দিনে ১০–১২টা ল্যাপটপ বিক্রি হতো, এখন সেটা ২–৩টায় নেমে এসেছে। লোকজন দাম শুনেই পিছিয়ে যাচ্ছে।”

ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া
বিগত ছয় মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি নির্ভর কম্পিউটারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশের দাম বাংলাদেশের বাজারেও বেড়েছে। যে ল্যাপটপ আগে ৫০–৬০ হাজার টাকায় পাওয়া যেত, সেটি এখন ৭০–৮০ হাজার টাকা, এমনকি তার চেয়েও বেশি। বিশেষ করে ইন্টেল বা এএমডি প্রসেসরযুক্ত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ল্যাপটপ ও ডেস্কটপের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থী, ফ্রিল্যান্সার বা উদ্যোক্তারা ঝুঁকছেন পুরনো বা দ্বিতীয়হাত পণ্যের দিকে।
সরকারি প্রকল্প স্থগিত ও করপোরেট অর্ডার হ্রাস
সরকারি বিভিন্ন অফিস বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার কেনার বরাদ্দ সাম্প্রতিক সময়ে হ্রাস পেয়েছে। অডিট, ব্যয় সংকোচন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক টেন্ডার স্থগিত হয়ে আছে। এ ছাড়া বড় করপোরেট কোম্পানিগুলোও লোকসানের আশঙ্কায় কম্পিউটার আপগ্রেড বা নতুন কেনাকাটায় খরচ কমিয়ে দিয়েছে।
একজন ডিস্ট্রিবিউটর বলেন, “বেসরকারি ব্যাংক, মোবাইল কোম্পানি বা এনজিওগুলো আগে এক সঙ্গে কয়েকশ ইউনিট অর্ডার দিত, এখন তারা এক্সটেনশন নিচ্ছে বা পুরনো মেশিন রিনিউ করছে।”
সেকেন্ডহ্যান্ড পণ্যের বাজারে চাপ
নতুন কম্পিউটারের বিক্রি কমার পেছনে আরেকটি বড় কারণ হলো সেকেন্ডহ্যান্ড বা রিফারবিশড (refurbished) কম্পিউটারের বাজার সম্প্রসারিত হওয়া। ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে আমদানি হওয়া কমদামি হলেও কার্যকর কম্পিউটার ও ল্যাপটপ এখন দেশে বেশ সহজলভ্য। এসব পণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় শিক্ষার্থী ও ফ্রিল্যান্সাররা নতুনের চেয়ে সেকেন্ডহ্যান্ড পণ্যের দিকেই ঝুঁকছেন।

প্রযুক্তি পরিবর্তন ও মোবাইলভিত্তিক ব্যবহারের প্রতি ঝোঁক
অনেক সাধারণ ব্যবহারকারী আগে কম্পিউটার ব্যবহারের জন্য যে কাজ করতেন, এখন তা মোবাইল বা ট্যাবলেটেই করছেন। স্মার্টফোনে অনলাইন ক্লাস, গুগল ড্রাইভ, ভিডিও সম্পাদনার অ্যাপ, এমনকি লাইট অফিসিয়াল কাজও সম্ভব হয়ে গেছে। ফলে অনেকেই আর আলাদা করে কম্পিউটার কিনতে আগ্রহী নন।
ব্যবসায়ীদের করণীয় ও সম্ভাব্য সমাধান
কম্পিউটার বিক্রেতা ও ডিস্ট্রিবিউটরদের মতে, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও উদ্যোক্তাদের জন্য কম সুদে কিস্তিতে কম্পিউটার কেনার সুযোগ চালু করা যেতে পারে। এ ছাড়া ডলার রেট নিয়ন্ত্রণ, করপোরেট অর্ডারে ছাড় দেওয়া এবং সরকারি প্রকল্পে প্রযুক্তি বরাদ্দ বাড়ানোর মতো নীতিমালাও দরকার।
চাহিদা আছে সমর্থ কমে গেছে
বাংলাদেশে প্রযুক্তির চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তবে অর্থনৈতিক সংকট ও বৈদেশিক মুদ্রার চাপের কারণে সাধারণ মানুষ প্রয়োজন থাকলেও কম্পিউটার কেনার মতো বিনিয়োগ করতে পারছে না। সরকার ও বেসরকারি খাত যদি যৌথভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তাহলে আগামী দিনের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের অন্যতম স্তম্ভ, অর্থাৎ কম্পিউটার বাজার, পুনরায় সচল হতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















