খৃস্টাব্দের প্রথম শতাব্দীতে উত্তরভারতের রাজা কণিষ্ক, প্রধানত উত্তরভারতের বৌদ্ধদেরই এক সংগিতি আহ্বান করেছিলেন।
ক. মহাযান, ও হীনযান
বৌদ্ধধর্মের শাখাগুলি সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন। খুব সংক্ষেপে কিছু বলিব।কথিত আছে, বুদ্ধের মৃত্যুর অল্পদিন পরে তাঁর শিষ্যেরা রাজগৃহে এক সমিতিতে মিলিত হয়ে তাঁর উপদেশাবলী লিপিবদ্ধ করেন।
প্রধানতঃ সঙ্ঘারামের নিয়মগুলি সম্বন্ধে মতভেদ হওয়ায় খৃস্টপূর্ব ৩৭৭অব্দে বৈশানীতে দ্বিতীয় এক সভার অধিষ্ঠান হয়। আবার খৃস্টপূর্ব ২৪১ অব্দে অশোক পাটলিপুত্রে তৃতীয় এক সভার আহ্বান করেন।
এসমস্ত সমিতিতে বুদ্ধের প্রচারিত উপদেশাবলী ত্রিপিটক নাযে সংগৃহীত হয়।
এসব গ্রন্থ পালিভাষায় লেখা। এর থেকে দেখা যায় যে, বুদ্ধ নিজে জন্মান্তরে বিশ্বাস করতেন আর মানুষ কী উপায়ে দুঃখময় সংসারচক্র (জন্ম, মৃত্যু, আবার জন্ম, আবার মৃত্যু ইত্যাদি) থেকে উদ্ধার পেতে পারে এই সম্বন্ধে উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ভগবান আছেন কি না, জীবাত্মা, পরমাত্মা, মানুষ মরবার পরে কোন স্বর্গে যায় ইত্যাদি সম্বন্ধে তিনি কিছু বলেন নি।
খৃস্টাব্দের প্রথম শতাব্দীতে উত্তরভারতের রাজা কণিষ্ক, প্রধানত উত্তরভারতের বৌদ্ধদেরই এক সংগিতি আহ্বান করেছিলেন। এ সভায় কতকগুলি সূত্র ও ভাষ্য লিপিবদ্ধ হয় ও অনেক নতুন কথা বৌদ্ধধর্মের শামিল করা হয় যা ত্রিপিটকে নেই। অবশ্য সব বৌদ্ধরা এ মত গ্রহণ করলেন না। এই নতুন মতের স্থাপয়িতাদের মধ্যে অশ্বঘোষ, নাগার্জুন, আর্যদেব বা মৈত্রের নাথ, বসুমিত্র ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য।
এই মতাবলম্বীরা নিজেদের ‘মহাবানী’ বলে উল্লেখ করেন ও পুরাতন ‘স্থবিরশাখার’ লোকদের ‘হীনযানী’ বলেন। এঁদের শাস্ত্রগুলি সংস্কৃত ভাষায় লেখা। এই ভাবে মহাযানবৌদ্ধধর্ম ত্রিপিটকের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভাবপ্রবণ হয়ে গেল।
মহাবানীরা বলেন যে, তাঁদের শাস্ত্রে যা আছে তা বুদ্ধ নিজ মুখে বলেন নি বটে, কিন্তু এসবই তাঁর মনের মধ্যে ছিল। খৃস্টীয় প্রথম শতাব্দীর আগে ভারতবর্ষের আর্যদের মধ্যে মূর্তিপূজা ছিল না। বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারতে মূর্তিপূজার উল্লেখ নেই। মৌর্যযুগের বৌদ্ধ ভাস্কর্যে (সারনাথ, সাঁচী, ভারহুত ইত্যাদি স্থানে) বুদ্ধের মূর্তি পর্যন্ত গঠিত হত না, পূজা তো দূরের কথা।
মহাযানীরা বুদ্ধের মূর্তি গঠন করতে আরম্ভ করলেন। তাছাড়া তাঁরা অসংখ্য দেবদেবীর কল্পনা ও পূজা আরম্ভ করলেন। এই অসংখ্য দেবতাদের মধ্যে প্রধান হচ্ছেন আদিবুদ্ধ ও আদি প্রজ্ঞাপারমিতা। এঁদের থেকে পাঁচ জন ধ্যানীবুদ্ধ উদ্ভুত হয়েছেন-বৈরোচন, অক্ষোভ্য, রত্নসম্ভব, অমিতাভ, অমোঘসিদ্ধি।
(এদের প্রত্যেকেরই স্ত্রীদেবতা আছেন।) ধ্যানীবুদ্ধরা স্বয়ং সাংসারিক কাজে হস্তক্ষেপ করেন না। এই কাজের জন্যে প্রত্যেকেরই একজন বোধিসত্ত্ব আছেন। তাঁদের নাম যথাক্রমে সামন্তভদ্র, বজ্রপাণি, রত্নপাণি, অবলোকিতেশ্বর ও বিশ্বপাণি।
এ ছাড়া পাঁচজন মানুষী বুদ্ধ আছেন, যাঁরা পর্যায়ক্রমে যুগে যুগে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। তাঁদের নাম ক্রকুচন্দ্র, কনকমুনি, কাশ্যপ, গৌতম ও মৈত্রেয়।
(চলবে)
সত্যেন্দ্রকুমার বসু 



















