শৈশব ও বেড়ে ওঠা
১৯৪৭ সালের ১০ আগস্ট কুষ্টিয়ার এক সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্ম নেন তন্দ্রা মজুমদার, যিনি বাংলার রূপালি পর্দায় সুজাতা নামে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। বাবা গিরিজানাথ মজুমদার ও মা বীণা পানির কাছেই তাঁর শিল্প-অনুরাগের বীজ রোপিত হয়। শৈশবেই মায়ের সঙ্গে চলচ্চিত্র-দর্শনের অভ্যাস, নাচের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং সুচিত্রা সেন-প্রভাবিত অভিনয়ের অনুকরণ ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের ভিত্তি গড়ে দেয়।
রূপালি পর্দায় প্রথম পা
মঞ্চ-নাটকে স্বল্প সময় কাটিয়ে ১৯৬৩-তে ‘ধারাপাত’ ছবিতে সহ-শিল্পী হিসেবে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান। এরপর ১৯৬৫-এর ‘রূপবান’ তাঁকে জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আনে। রূপবানের ভূমিকায় তাঁর সপ্রাণ উপস্থিতি তৎকালীন লোককাহিনি-ভিত্তিক চলচ্চিত্রকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দেয়।
‘ফোক সম্রাজ্ঞী’ উপাধি
সুজাতা অভিনয় করেছেন প্রায় তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে; এর মধ্যে পঞ্চাশটিরও বেশি লোকজ ধারার ছবি, যা তাঁকে ‘ফোক সম্রাজ্ঞী’ উপাধি এনে দেয়। ‘কাঞ্চনমালা’, ‘গাজী কালু চম্পাবতী’, ‘বেদের মেয়ে’ ইত্যাদি ছবিতে গ্রামবাংলার কিংবদন্তি নারীর চরিত্রে তাঁর সাবলীল অভিনয় বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতিকে সেলুলয়েডে জীবন্ত করে তোলে।
সোনালি যুগের সাফল্য
ষাট ও সত্তরের দশকে ‘চেনা অচেনা’, ‘এতটুকু আশা’, ‘সূর্য ওঠার আগে’, ‘আয়না ও অবশিষ্ট’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’—নানা ঘরানার ছবিতে তিনি নায়িকা কিংবা চরিত্রাভিনেত্রীর ভূমিকায় পরম মুন্সিয়ানায় কাজ করেন। ভিন্নধর্মী চরিত্র বেছে নেওয়ার প্রবণতা তাঁকে সমসাময়িকদের থেকে আলাদা করেছে।
আজিম-সুজাতা—প্রেম ও দাম্পত্য
১৯৬৭ সালের ৩০ জুন সহ-অভিনেতা আজিমকে বিয়ে করে নামের সঙ্গে যুক্ত হয় ‘আজিম’। স্বামী-স্ত্রী জুটি একাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন; রূপালি পর্দায় যেমন, ব্যক্তিজীবনেও তাঁরা ছিলেন একে অপরের পরম সঙ্গী। ২০০৩ সালে আজিমের মৃত্যুর পরও সুজাতা শিল্পমনা পরিবারকে আগলে রেখেছেন।
বিরতি, প্রত্যাবর্তন ও ছোট পর্দা
১৯৭৮-এর পর কয়েক বছর বিরতি নিলেও নব্বইয়ের দশক থেকে ধারাবাহিকে অভিনয় শুরু করেন। এখনও তিনি টেলিভিশন নাটক ও অতিথি চরিত্রে কাজ করছেন—পেশাকে ‘প্যাশন’ বলেই সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন।
লেখালেখি ও স্মৃতিকথা
অভিনয়ের পাশাপাশি স্মৃতিচারণ ও উপন্যাস রচনায়ও তিনি সিদ্ধহস্ত। ‘শিমুলির একাত্তর’, ‘আমার আত্মকাহিনি’, ‘চলচ্চিত্রের ৫৫ বছর’সহ কয়েকটি বইয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, চলচ্চিত্র-জগতের অন্তর্গত গল্প ও ব্যক্তিজীবনের উত্থান-পতন তুলে ধরেছেন।
সম্মাননা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি
বাংলা চলচ্চিত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৭-তে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা এবং ২০২১-এ একুশে পদক পেয়েছেন সুজাতা। এই দুটি পুরস্কারই তাঁকে শিল্প-ঐতিহ্যের স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
উত্তরাধিকারের ইতি-নতুন শুরু
লোককাহিনি-নির্ভর চলচ্চিত্রকে ভরকেন্দ্রে রেখে গড়ে ওঠা সুজাতার অভিনয়মহিমা আজও নতুন নির্মাতা-অভিনেতাদের অনুপ্রেরণা জোগায়। গ্রামীণ নায়িকার প্রচলিত ক্লিশে তিনি ভেঙেছেন শক্তিমান, মানবিক রূপে; আবার সাহিত্য-সংলগ্ন চিত্রনাট্যে হাজির হয়েছেন পরিপক্ক অভিনেত্রী হয়ে। এ-কারণেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে তাঁর নাম নন্দিত ও প্রাসঙ্গিক—সময় যতই এগিয়ে যাক না কেন।
লোককথার গণ্ডি পেরিয়ে
লোককথার গণ্ডি পেরিয়ে বৈচিত্র্যময় চরিত্রে অভিনয়, সাহিত্যচর্চা এবং টেলিভিশন-ধারাবাহিকে অবিরত অংশগ্রহণ—সুজাতা আজিমের জীবন এক বহমান শিল্পযাত্রা। তিন শতাধিক ছবির এই নায়িকা এখনো নিজস্ব মেধা ও অভিজ্ঞতায় সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করছেন, প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিচ্ছেন রূপবান-স্নিগ্ধ স্বপ্নের আলো।