০৪:৩৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

কারখানায় আগুন: নিঃস্ব হয়ে পড়া কয়েকজন মালিকের কাহিনি

পেছনের গল্প: আগুনে পুড়েছে শুধু ঘর নয়ভেঙেছে জীবনের স্বপ্ন

গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন জেলায় নাশকতামূলক আগুনে পুড়ে গেছে বহু ছোট-বড় কারখানা। এসব ঘটনায় যেমন আর্থিক ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকার, তেমনি ধ্বংস হয়েছে মালিকদের জীবনের শ্রম, শ্রমিকদের জীবিকা এবং হাজারো স্বপ্ন। এসব ঘটনায় কেউ কেউ আবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। সরকারি তদন্তে অনেক ক্ষেত্রেই নাশকতার প্রমাণ মিলেছে, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তরা আজও দাঁড়াতে পারেননি। এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো কয়েকজন কারখানা মালিকের বাস্তব অভিজ্ঞতা—যারা এক সময় উদ্যোক্তা ছিলেন, এখন কেবল বেঁচে থাকার লড়াই করছেন।

নারায়ণগঞ্জের আরমান হোসেন: এক রাতে শেষ স্বপ্নের সেলাই

৪২ বছর বয়সী আরমান হোসেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি ছোট গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক ছিলেন। ২০২৪ সালের অক্টোবরের এক রাতে তাঁর কারখানায় আগুন লাগে। তদন্তে উঠে আসে—বাইরের একটি রাজনৈতিক গ্রুপ এলাকায় দখল নিতে এই আগুন দেয়।

আরমান বলছিলেন,
“আমি ১৫ বছর ধরে কষ্ট করে এই কারখানাটা দাঁড় করাইছি। ছোট শুরু করেছিলাম, শেষদিকে ৬৫ জন কর্মচারী ছিল। সেই রাতে চোখের সামনে আগুনে সব ছাই হয়ে গেল। পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে বাইরের কিছু লোককে দেখা গেছে আগুন লাগানোর সময়, কিন্তু এখনো কাউকে ধরা হয়নি।”

তিনি এখন স্থানীয় একটি কাপড়ের দোকানে চাকরি করছেন, যেখানে মাসে ১২ হাজার টাকা বেতন পান। তাঁর স্ত্রী অসুস্থ, ছেলের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে।

গাজীপুরের রিনা বেগম: নারীর ঘামআগুনে গলে যাওয়া সমানাধিকারের স্বপ্ন

গাজীপুরের শ্রীপুরে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি ক্ষুদ্র হোসিয়ারি কারখানায় আগুন লাগে। মালিক ছিলেন রিনা বেগম, যিনি নিজে একজন নারীকর্মী থেকে ধীরে ধীরে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন। তাঁর কারখানায় মাত্র ২৫ জন নারী কাজ করতেন। আগুন লাগার কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি হুমকি পেয়েছিলেন এলাকার একটি চাঁদাবাজ চক্রের কাছ থেকে।

রিনা জানালেন,
“আমি ওদের টাকা দিতে চাইনি। বলেছিলাম, ছোট কারখানা, মুনাফা খুবই কম। ওরা বলেছিল, ‘চালিয়ে দেখতে পারো।’ রাতে আগুন লাগলো। ফায়ার সার্ভিস এসে যখন আগুন নেভালো, ততক্ষণে কিছুই অবশিষ্ট নেই।”

রিনার নিজস্ব বাড়ি নেই, এখন বোনের বাসায় আশ্রিত। তাঁর কণ্ঠে হতাশা, “নারী হয়ে ব্যবসা করাটাই যেন অপরাধ ছিল।”

ঋণ ও পরিশোধ: ইসলামের আলোকে নৈতিক দায়িত্ব ও করণীয়

চট্টগ্রামের সায়েম উদ্দিন: আগুনে শুধু কাঠ নয়পুড়েছে আত্মা

চট্টগ্রামের হালিশহরে একটি ছোট কাঠ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ছিল সায়েম উদ্দিনের। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আগুন লাগে মধ্যরাতে। তদন্তে উঠে আসে—আগে থেকেই দাহ্য পদার্থ ছড়িয়ে আগুন লাগানো হয়েছিল।

সায়েম বলেন,
“কারখানাটা আমার বাবার শুরু করা। আমি সেটাকে আধুনিক করেছিলাম। ৩৫ জন লোক কাজ করত। আমি নিজে কখনো কারও সঙ্গে শত্রুতা করি নাই। হঠাৎ করে সব শেষ হয়ে গেল।”

তিনি এখন হতাশায় ভুগছেন। ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে ব্যাংক মামলা দিয়েছে। তাঁর পরিবারের একজন সদস্য আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন চাপ সামলাতে না পেরে।

কী বলছে পরিসংখ্যান?

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) তথ্যমতে, গত এক বছরে (জুলাই ২০২৪-জুলাই ২০২৫) দেশে অন্তত ৩৯টি ছোট ও মাঝারি শিল্প কারখানায় অগ্নিকাণ্ড হয়েছে, যার মধ্যে ২৩টি ঘটনায় নাশকতার প্রমাণ মিলেছে। ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৪৫০ কোটি টাকা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, চাঁদাবাজি এবং দুর্বল আইন প্রয়োগের ফলে উদ্যোক্তারা আতঙ্কে আছেন।

কারা দিচ্ছে আগুন?

অনুসন্ধানী রিপোর্টে উঠে এসেছে—বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক দল বা প্রভাবশালী গোষ্ঠী নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা বা প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করতে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। আবার কিছু জায়গায় চাঁদাবাজ চক্র, ভুয়া শ্রমিক সংগঠন কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ী এই আগুন লাগানোর সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু বিচার হচ্ছে না বললেই চলে।

নারায়ণগঞ্জে পোশাক কারখানায় আগুন: দুই কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা

পুনর্গঠনের কোনো উদ্যোগ নেই?

সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে এই ভুক্তভোগীদের সহায়তায় তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিল বা এসএমই সহায়তা প্রকল্প থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা মিলছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিল না করে মামলা করছে।

পুড়েছে শুধু কারখানা নয়ধসে পড়েছে বিশ্বাস

একটি কারখানা কোনো ব্যক্তির শুধু ব্যবসা নয়, সেটি তাঁর শ্রম, স্বপ্ন, কর্মসংস্থান ও পরিবারের ভবিষ্যৎ। একের পর এক অগ্নিকাণ্ডে এসব মানুষের জীবনের ভিত নড়ে গেছে। অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন, কেউ কেউ দেশ ছাড়ার কথা ভাবছেন।

এই পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বিচারহীনতা ও রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের আগুন যেন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের শিল্পভিত্তিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে না দেয়—এটা নিশ্চিত করাও সময়ের দাবি।

জনপ্রিয় সংবাদ

কারখানায় আগুন: নিঃস্ব হয়ে পড়া কয়েকজন মালিকের কাহিনি

০৩:২০:০৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ অগাস্ট ২০২৫

পেছনের গল্প: আগুনে পুড়েছে শুধু ঘর নয়ভেঙেছে জীবনের স্বপ্ন

গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন জেলায় নাশকতামূলক আগুনে পুড়ে গেছে বহু ছোট-বড় কারখানা। এসব ঘটনায় যেমন আর্থিক ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকার, তেমনি ধ্বংস হয়েছে মালিকদের জীবনের শ্রম, শ্রমিকদের জীবিকা এবং হাজারো স্বপ্ন। এসব ঘটনায় কেউ কেউ আবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। সরকারি তদন্তে অনেক ক্ষেত্রেই নাশকতার প্রমাণ মিলেছে, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তরা আজও দাঁড়াতে পারেননি। এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো কয়েকজন কারখানা মালিকের বাস্তব অভিজ্ঞতা—যারা এক সময় উদ্যোক্তা ছিলেন, এখন কেবল বেঁচে থাকার লড়াই করছেন।

নারায়ণগঞ্জের আরমান হোসেন: এক রাতে শেষ স্বপ্নের সেলাই

৪২ বছর বয়সী আরমান হোসেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি ছোট গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক ছিলেন। ২০২৪ সালের অক্টোবরের এক রাতে তাঁর কারখানায় আগুন লাগে। তদন্তে উঠে আসে—বাইরের একটি রাজনৈতিক গ্রুপ এলাকায় দখল নিতে এই আগুন দেয়।

আরমান বলছিলেন,
“আমি ১৫ বছর ধরে কষ্ট করে এই কারখানাটা দাঁড় করাইছি। ছোট শুরু করেছিলাম, শেষদিকে ৬৫ জন কর্মচারী ছিল। সেই রাতে চোখের সামনে আগুনে সব ছাই হয়ে গেল। পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে বাইরের কিছু লোককে দেখা গেছে আগুন লাগানোর সময়, কিন্তু এখনো কাউকে ধরা হয়নি।”

তিনি এখন স্থানীয় একটি কাপড়ের দোকানে চাকরি করছেন, যেখানে মাসে ১২ হাজার টাকা বেতন পান। তাঁর স্ত্রী অসুস্থ, ছেলের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে।

গাজীপুরের রিনা বেগম: নারীর ঘামআগুনে গলে যাওয়া সমানাধিকারের স্বপ্ন

গাজীপুরের শ্রীপুরে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি ক্ষুদ্র হোসিয়ারি কারখানায় আগুন লাগে। মালিক ছিলেন রিনা বেগম, যিনি নিজে একজন নারীকর্মী থেকে ধীরে ধীরে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন। তাঁর কারখানায় মাত্র ২৫ জন নারী কাজ করতেন। আগুন লাগার কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি হুমকি পেয়েছিলেন এলাকার একটি চাঁদাবাজ চক্রের কাছ থেকে।

রিনা জানালেন,
“আমি ওদের টাকা দিতে চাইনি। বলেছিলাম, ছোট কারখানা, মুনাফা খুবই কম। ওরা বলেছিল, ‘চালিয়ে দেখতে পারো।’ রাতে আগুন লাগলো। ফায়ার সার্ভিস এসে যখন আগুন নেভালো, ততক্ষণে কিছুই অবশিষ্ট নেই।”

রিনার নিজস্ব বাড়ি নেই, এখন বোনের বাসায় আশ্রিত। তাঁর কণ্ঠে হতাশা, “নারী হয়ে ব্যবসা করাটাই যেন অপরাধ ছিল।”

ঋণ ও পরিশোধ: ইসলামের আলোকে নৈতিক দায়িত্ব ও করণীয়

চট্টগ্রামের সায়েম উদ্দিন: আগুনে শুধু কাঠ নয়পুড়েছে আত্মা

চট্টগ্রামের হালিশহরে একটি ছোট কাঠ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ছিল সায়েম উদ্দিনের। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আগুন লাগে মধ্যরাতে। তদন্তে উঠে আসে—আগে থেকেই দাহ্য পদার্থ ছড়িয়ে আগুন লাগানো হয়েছিল।

সায়েম বলেন,
“কারখানাটা আমার বাবার শুরু করা। আমি সেটাকে আধুনিক করেছিলাম। ৩৫ জন লোক কাজ করত। আমি নিজে কখনো কারও সঙ্গে শত্রুতা করি নাই। হঠাৎ করে সব শেষ হয়ে গেল।”

তিনি এখন হতাশায় ভুগছেন। ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে ব্যাংক মামলা দিয়েছে। তাঁর পরিবারের একজন সদস্য আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন চাপ সামলাতে না পেরে।

কী বলছে পরিসংখ্যান?

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) তথ্যমতে, গত এক বছরে (জুলাই ২০২৪-জুলাই ২০২৫) দেশে অন্তত ৩৯টি ছোট ও মাঝারি শিল্প কারখানায় অগ্নিকাণ্ড হয়েছে, যার মধ্যে ২৩টি ঘটনায় নাশকতার প্রমাণ মিলেছে। ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৪৫০ কোটি টাকা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, চাঁদাবাজি এবং দুর্বল আইন প্রয়োগের ফলে উদ্যোক্তারা আতঙ্কে আছেন।

কারা দিচ্ছে আগুন?

অনুসন্ধানী রিপোর্টে উঠে এসেছে—বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক দল বা প্রভাবশালী গোষ্ঠী নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা বা প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করতে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। আবার কিছু জায়গায় চাঁদাবাজ চক্র, ভুয়া শ্রমিক সংগঠন কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ী এই আগুন লাগানোর সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু বিচার হচ্ছে না বললেই চলে।

নারায়ণগঞ্জে পোশাক কারখানায় আগুন: দুই কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা

পুনর্গঠনের কোনো উদ্যোগ নেই?

সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে এই ভুক্তভোগীদের সহায়তায় তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিল বা এসএমই সহায়তা প্রকল্প থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা মিলছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিল না করে মামলা করছে।

পুড়েছে শুধু কারখানা নয়ধসে পড়েছে বিশ্বাস

একটি কারখানা কোনো ব্যক্তির শুধু ব্যবসা নয়, সেটি তাঁর শ্রম, স্বপ্ন, কর্মসংস্থান ও পরিবারের ভবিষ্যৎ। একের পর এক অগ্নিকাণ্ডে এসব মানুষের জীবনের ভিত নড়ে গেছে। অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন, কেউ কেউ দেশ ছাড়ার কথা ভাবছেন।

এই পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বিচারহীনতা ও রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের আগুন যেন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের শিল্পভিত্তিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে না দেয়—এটা নিশ্চিত করাও সময়ের দাবি।