রাজনীতির ছায়ায় বড় হওয়া এক ‘মিছিলবালক’
পুরান ঢাকার গলিপথের একটি স্যাঁতসেঁতে, একতলা, ভাঙাচোরা বাড়ির পেছনের ছোট্ট ঘরে থাকে শাকিল (ছদ্মনাম)। বয়স মাত্র ১৪। বয়স অনুযায়ী সে একজন শিশুশ্রমিক, তবে তার পেশাটা একটু আলাদা—রাজনৈতিক মিছিলে অংশগ্রহণ করে টাকা উপার্জন করা। আজ একটি দলের স্লোগান দিচ্ছে, কাল অন্য দলের পতাকা হাতে লম্বা লাইনে হাঁটছে। মিছিলই তার আয়ের উৎস; সেই টাকায় চলে তার ও ছোট ভাইয়ের খাবার।
পথচলা: মিছিল জীবনের শুরু
শাকিল জানায়, সে প্রথম মিছিলে যায় ১১ বছর বয়সে। তার বন্ধু রুবেল একদিন বলেছিল, “চল, একটা জায়গায় গেলে ২০০ টাকা পাওয়া যায়, শুধু একটু হাঁটতে হবে আর ‘জিন্দাবাদ’ চিৎকার করতে হবে।” তখন তিনদিন অভুক্ত ছিল। সেই ক্ষুধাই তাকে ঠেলে দেয় সেই রাজনৈতিক স্লোগানে মুখর অচেনা ভিড়ে।
“প্রথমে ভয় লাগছিল। কিছুই বুঝিনি। লাল-সবুজ-নীল রঙের কাপড়, মুখে গর্জন, মাঝেমধ্যে পুলিশের গাড়ি, কিছু লোক আমাদের তাড়া করে। কিন্তু শেষে ২০০ টাকা হাতে পেয়ে মনে হলো, এটির চেয়ে সহজ আয় আর হয় না।”

রাজনীতি নয়, আয়টাই মুখ্য
শাকিলের কাছে দল কোনো বিষয় নয়। সে জানে না দলের নাম, চিনে না নেতাদের। তার জানা কেবল এই—কে টাকা দেবে, কখন মিছিল হবে, কোথায় জমায়েত হবে। মিছিলে যাওয়ার আগে এক দালাল এসে বলে দেয়, “আজ অমুক নেতা আসবেন, অমুক স্লোগান দিতে হবে। টাকা পরে পাওয়া যাবে।”
প্রতি মিছিলে সে পায় ২০০ থেকে ৫০০ টাকা, কখনো এক বেলা খাবারও জোটে। কিছু বড় বড় র্যালিতে ৮০০ টাকাও পেয়েছে। কিন্তু সে জানে না কেন বা কী নিয়ে মিছিল হচ্ছে। তার কাজ শুধু গলা ফাটানো আর ভিড় বাড়ানো।
একটা দিন: কেমন কাটে এক ‘মিছিলের দিন’?
ভোর ৭টার দিকে ঘুম থেকে উঠে সে চলে যায় সদরঘাট, পল্টন বা গুলিস্তানের দিকে—যেখানে রাজনৈতিক জমায়েত বেশি হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে অন্য ‘মিছিলবালক’দের সঙ্গে। কেউ এসে ডাকলেই ছুটে যায় নির্ধারিত স্থানে। সেখানে স্লোগান শেখানো হয়, ব্যানার ধরতে হয়, মাঝে মাঝে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতেও হয়।
“অনেক সময় মিছিলে মারামারিও হয়। তখন ভয়ে পালিয়ে যাই। পুলিশ ধাওয়া করলে যারা বড় ভাই তারা পালায়, আমাদের ফেলে দেয়। অনেকবার ধরা পড়ার ভয় পেয়েছি,” বলল শাকিল।

পরিবার জানে?
শাকিলের মা একজন গৃহকর্মী। বাবা কয়েক বছর আগে ছেড়ে গেছে। মা জানেন ছেলে কখনো দোকানে কাজ করে, কখনো বোঝা বইয়ে দেয়। কিন্তু মিছিলের বিষয়টি তিনি পুরোপুরি জানেন না। “জানলে বকবে,” বলে হেসে নেয় ছেলেটি। “কিন্তু সংসার তো চলতেই হবে। আমি না গেলে ছোট ভাই না খেয়ে থাকবে।”
এই জীবন কবে থামবে?
শাকিল চায় একটি স্থায়ী কাজ। সে বলে, “কোনো গ্যারেজে কাজ পেলে ভালো হতো। মিছিলে গেলে মাঝে মাঝে বিপদ হয়। কেউ টাকা দেয় না, কেউ মারধর করে।” তবুও পেটের দায়ে এই কাজ ছাড়তে পারে না।
সে স্কুলে যায় না। গণতন্ত্র মানে কী, বা “সংবিধান” শব্দের মানে জানে না। কিন্তু জানে কোন দলের মিছিলে গেলে কত টাকা পাওয়া যায়, কোন ব্যানারে বেশি ভিড় হয়, কোথায় মিডিয়া বেশি আসে। তার রাজনীতি কেবল অর্থনৈতিক—টাকার বদলে স্লোগান।
রাজনীতি কি তাকে দেখছে?
রাজনীতিকদের কাছে শাকিল কেবল একদিনের মুখ। মিছিল শেষ হলে আর কেউ তার খোঁজ রাখে না। তাদের বক্তব্যে শিশু অধিকার আর শিক্ষার কথা থাকলেও—প্রতিদিনই এমন হাজার শাকিল ঢুকে পড়ে রাজনীতির ব্যানারে, নিজের অজান্তেই।

শেষকথা: মিছিলই জীবনের মানে?
শাকিলের মতো শিশুদের এই অদৃশ্য শ্রমিকজীবন রাষ্ট্র ও সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। শিশু শ্রমের প্রচলিত সংজ্ঞায় তারা পড়ে না সরাসরি, কারণ তারা কারখানায় নয়—রাস্তায় গলা ফাটায়, ভিড় বানায়; কখনো হাতে মোমবাতি, কখনো পোস্টার ধরে।
এ এক নতুন ধরনের শোষণ, যেখানে রাজনীতির ব্যানারে ‘অর্থনীতি’ চালায় এক ক্ষুধার্ত পেট। মিছিল তার কাছে কোনো প্রতিবাদের ভাষা নয়—এটা কেবল আরেক দিনের খাদ্যের নিশ্চয়তা।
রাজনীতি যাবে, আসবে। কিন্তু শাকিলের মতো শিশুদের জীবন কি বদলাবে? নাকি তারা রয়ে যাবে মিছিলের গা-ঢাকা ভিড়েই—অদৃশ্য, অনুচ্চারিত, অনাহারী?
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















