০৪:৩৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

গর্ভে সন্তানসহ মায়ের শেষ আর্তনাদ: জনতার বর্বরোচিত উন্মাদনার প্রতিচ্ছবি

প্রেক্ষাপট: অজ্ঞাত এক মায়ের নির্মম মৃত্যু

গুজবের আগুনে উত্তপ্ত জনতা ঘিরে ধরে আট মাসের গর্ভবতী এক নারীকে। কীসের অপবাদ, কীসের প্রমাণ—কাউকে কিছুই জানতে হয় না; রাগ, ভয় ও অনাহূত ‘বিচার’-এর তাড়নায় মুহূর্তেই নেমে আসে পাথর, লাঠি, ঘুষির বিধ্বংসী বৃষ্টি। গুজব মব সৃষ্টি করে এমন ঘটনা ঘটায় মাঝে মাঝে ।

মায়ের মনের আর্তনাদ

আঘাতের বন্যাতেও সেই নারী দু-হাত জড়িয়ে ধরেন নিজের উদর:

“দয়া করে থামুন… আমাকে নয়, অন্তত আমার গর্ভের শিশুটিকে বাঁচান!”

মনোরোগ-বিশেষজ্ঞ ডা. শামীমা হক বলেন, “শেষ মুহূর্তে গর্ভবতী নারীর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হলো নিজ শরীর দিয়ে বাচ্চাকে ঢেকে রাখা। মৃত্যু-ভয় যত প্রবলই হোক, মাতৃত্বের সহজাত রক্ষাকবচ সব কিছুর উপরে স্থান পায়।”

Resources - The Center for Psychology

ডুয়াল ট্রমা’: একসঙ্গে নিভে যাওয়া দুই প্রাণ

ডা. আরিফুর রহমান ব্যাখ্যা করেন, “এটি ‘ডুয়াল ট্রমা’—এক প্রাণ আরেক অনাগত প্রাণকে রক্ষা করতে গিয়ে একসঙ্গে নিভে যায়। সহিংস আঘাতে গর্ভবতী মা প্রথমেই ভাবেন গর্ভের শিশুটিকে; ফলে মানসিক অভিঘাত দ্বিগুণ হয়।”

নৃশংসতার মনস্তত্ত্ব: কীভাবে জেগে ওঠে মব

মনোবিজ্ঞানী ডা. ফারহানা করিম বলেন, “নামহীন জনতা সহজেই ‘মব’-এ পরিণত হয়, যখন—

  • • জনঘনত্বের আস্তরণ: ভিড় ব্যক্তিগত দায়বোধ মুছে দেয়।
  • • গুজব ও অসত্য: যাচাই না করে উত্তেজনায় ভেসে যায় মন।
  • • দৈনন্দিন হতাশার নির্গমন: জমে থাকা রাগ ঢালার উপলক্ষ খোঁজা হয়।

“এসবই মিলিয়ে জন্ম নেয় বর্বরোচিত মনোভাব, যেখানে অন্তঃসত্ত্বা নারীর মানুষত্বও হারিয়ে যায়,” যোগ করেন তিনি।

যে অভ্যাসগুলো বন্ধ্যাত্ব নিয়ে আসে

মাতৃত্বের স্বপ্ন ভাঙার শব্দ

একজন মা গর্ভে যেমন শোনেন শিশুর হৃদ্‌কম্প, তেমনি সহিংস আঘাতে চারপাশের বিভীষিকাও বহুগুণে তীব্র হয়। ডা. শামীমা জানান, “এ সময় শরীরে অ্যাড্রিনালিন বেড়ে যায়, হৃদস্পন্দন অনিয়ন্ত্রিত হয়, তবু মস্তিষ্ক বারবার একটাই কথা আর্তি করে—‘শিশুটিকে বাঁচাও’।”

শোকের স্বীকৃত ও অস্বীকৃত রূপ

সন্তান জন্মের আগেই মৃত্যু এলে সমাজ প্রায়ই বলে, ‘ও তো পৃথিবীতে আসেইনি।’ ডা. আরিফুর বলেন, “এ-ধরনের ঘটনাকে বলা হয় অস্বীকৃত শোক—কিন্তু মায়ের কাছে গর্ভের শিশু পূর্ণ মানুষ; তার মৃত্যু পূর্ণাঙ্গ শোকই ডেকে আনে।”

অমানবিকতার ফল: দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ক্ষয়

  • • উত্তরাধিকারী ট্রমা: পরিবার আজীবন অপরাধবোধে ভোগে।
  • • সামাজিক ভীতি: নতুন গুজবে মানুষ আরও দুর্ভয়ে গুটিয়ে থাকে, নড়বড়ে হয় পারস্পরিক আস্থা।
  • • সমবেদনার সংকট: সহমর্মিতা শেখানোর ব্যবস্থা না থাকলে সহিংসতার পুনরাবৃত্তি থামে না।

Psychological Counseling: A journey towards healing - BRAIN BEHAVIOUR RESEARCH FOUNDATION OF INDIA

উত্তরণের দিকনির্দেশ: মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শ

১. গুজব-সতর্কতা শিক্ষা: জনসমাগমে তথ্য যাচাইয়ের অভ্যাস গড়ে তোলা।
২. দর্শকের দায়িত্ব: ‘দেখে-থাকার অমানবিকতা’ নিয়ে সচেতনতা—দর্শকই যেন আগে বাধা দেয়।
৩. মাতৃত্ব-সংবেদনা কর্মসূচি: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিলেবাসে গর্ভাবস্থার মানবিকতা যুক্ত করা।
৪. গভীর মানসিক সহায়তা: নিহত মায়ের পরিবারের জন্য তাৎক্ষণিক কাউন্সেলিং ও দীর্ঘমেয়াদি থেরাপি।

শেষ আবেদনএক মায়ের কণ্ঠে

“মানুষ হয়েও যখন তোমরা পাথর তোলো, দেখেছ কি?—আমার হৃদয়ের সঙ্গে আরেকটি ক্ষুদ্র হৃদয়ও কাঁপছে এখানে। আমাকে মারলেও যে প্রাণটি আমার ভেতর, তার তো কোনো দোষ নেই; দয়া করে থামো…”

বর্বরোচিত এই মানসিকতার বৃত্ত ভাঙতে হলে এমন আর্তনাদ শোনার মতো সংবেদনশীল মন দরকার—আইন, প্রযুক্তি বা শক্তি নয়। সমাজ যতক্ষণ গর্ভের শিশুর জীবনের পূর্ণ সম্মান না দেবে, ততক্ষণ মায়েদের শেষ আর্তনাদও বাতাসে মিলিয়ে যাবে—আর নৃশংস জনতা একই চক্রে ঘুরে ফিরে বেড়াবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

গর্ভে সন্তানসহ মায়ের শেষ আর্তনাদ: জনতার বর্বরোচিত উন্মাদনার প্রতিচ্ছবি

০৪:১৮:২০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ অগাস্ট ২০২৫

প্রেক্ষাপট: অজ্ঞাত এক মায়ের নির্মম মৃত্যু

গুজবের আগুনে উত্তপ্ত জনতা ঘিরে ধরে আট মাসের গর্ভবতী এক নারীকে। কীসের অপবাদ, কীসের প্রমাণ—কাউকে কিছুই জানতে হয় না; রাগ, ভয় ও অনাহূত ‘বিচার’-এর তাড়নায় মুহূর্তেই নেমে আসে পাথর, লাঠি, ঘুষির বিধ্বংসী বৃষ্টি। গুজব মব সৃষ্টি করে এমন ঘটনা ঘটায় মাঝে মাঝে ।

মায়ের মনের আর্তনাদ

আঘাতের বন্যাতেও সেই নারী দু-হাত জড়িয়ে ধরেন নিজের উদর:

“দয়া করে থামুন… আমাকে নয়, অন্তত আমার গর্ভের শিশুটিকে বাঁচান!”

মনোরোগ-বিশেষজ্ঞ ডা. শামীমা হক বলেন, “শেষ মুহূর্তে গর্ভবতী নারীর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হলো নিজ শরীর দিয়ে বাচ্চাকে ঢেকে রাখা। মৃত্যু-ভয় যত প্রবলই হোক, মাতৃত্বের সহজাত রক্ষাকবচ সব কিছুর উপরে স্থান পায়।”

Resources - The Center for Psychology

ডুয়াল ট্রমা’: একসঙ্গে নিভে যাওয়া দুই প্রাণ

ডা. আরিফুর রহমান ব্যাখ্যা করেন, “এটি ‘ডুয়াল ট্রমা’—এক প্রাণ আরেক অনাগত প্রাণকে রক্ষা করতে গিয়ে একসঙ্গে নিভে যায়। সহিংস আঘাতে গর্ভবতী মা প্রথমেই ভাবেন গর্ভের শিশুটিকে; ফলে মানসিক অভিঘাত দ্বিগুণ হয়।”

নৃশংসতার মনস্তত্ত্ব: কীভাবে জেগে ওঠে মব

মনোবিজ্ঞানী ডা. ফারহানা করিম বলেন, “নামহীন জনতা সহজেই ‘মব’-এ পরিণত হয়, যখন—

  • • জনঘনত্বের আস্তরণ: ভিড় ব্যক্তিগত দায়বোধ মুছে দেয়।
  • • গুজব ও অসত্য: যাচাই না করে উত্তেজনায় ভেসে যায় মন।
  • • দৈনন্দিন হতাশার নির্গমন: জমে থাকা রাগ ঢালার উপলক্ষ খোঁজা হয়।

“এসবই মিলিয়ে জন্ম নেয় বর্বরোচিত মনোভাব, যেখানে অন্তঃসত্ত্বা নারীর মানুষত্বও হারিয়ে যায়,” যোগ করেন তিনি।

যে অভ্যাসগুলো বন্ধ্যাত্ব নিয়ে আসে

মাতৃত্বের স্বপ্ন ভাঙার শব্দ

একজন মা গর্ভে যেমন শোনেন শিশুর হৃদ্‌কম্প, তেমনি সহিংস আঘাতে চারপাশের বিভীষিকাও বহুগুণে তীব্র হয়। ডা. শামীমা জানান, “এ সময় শরীরে অ্যাড্রিনালিন বেড়ে যায়, হৃদস্পন্দন অনিয়ন্ত্রিত হয়, তবু মস্তিষ্ক বারবার একটাই কথা আর্তি করে—‘শিশুটিকে বাঁচাও’।”

শোকের স্বীকৃত ও অস্বীকৃত রূপ

সন্তান জন্মের আগেই মৃত্যু এলে সমাজ প্রায়ই বলে, ‘ও তো পৃথিবীতে আসেইনি।’ ডা. আরিফুর বলেন, “এ-ধরনের ঘটনাকে বলা হয় অস্বীকৃত শোক—কিন্তু মায়ের কাছে গর্ভের শিশু পূর্ণ মানুষ; তার মৃত্যু পূর্ণাঙ্গ শোকই ডেকে আনে।”

অমানবিকতার ফল: দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ক্ষয়

  • • উত্তরাধিকারী ট্রমা: পরিবার আজীবন অপরাধবোধে ভোগে।
  • • সামাজিক ভীতি: নতুন গুজবে মানুষ আরও দুর্ভয়ে গুটিয়ে থাকে, নড়বড়ে হয় পারস্পরিক আস্থা।
  • • সমবেদনার সংকট: সহমর্মিতা শেখানোর ব্যবস্থা না থাকলে সহিংসতার পুনরাবৃত্তি থামে না।

Psychological Counseling: A journey towards healing - BRAIN BEHAVIOUR RESEARCH FOUNDATION OF INDIA

উত্তরণের দিকনির্দেশ: মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শ

১. গুজব-সতর্কতা শিক্ষা: জনসমাগমে তথ্য যাচাইয়ের অভ্যাস গড়ে তোলা।
২. দর্শকের দায়িত্ব: ‘দেখে-থাকার অমানবিকতা’ নিয়ে সচেতনতা—দর্শকই যেন আগে বাধা দেয়।
৩. মাতৃত্ব-সংবেদনা কর্মসূচি: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিলেবাসে গর্ভাবস্থার মানবিকতা যুক্ত করা।
৪. গভীর মানসিক সহায়তা: নিহত মায়ের পরিবারের জন্য তাৎক্ষণিক কাউন্সেলিং ও দীর্ঘমেয়াদি থেরাপি।

শেষ আবেদনএক মায়ের কণ্ঠে

“মানুষ হয়েও যখন তোমরা পাথর তোলো, দেখেছ কি?—আমার হৃদয়ের সঙ্গে আরেকটি ক্ষুদ্র হৃদয়ও কাঁপছে এখানে। আমাকে মারলেও যে প্রাণটি আমার ভেতর, তার তো কোনো দোষ নেই; দয়া করে থামো…”

বর্বরোচিত এই মানসিকতার বৃত্ত ভাঙতে হলে এমন আর্তনাদ শোনার মতো সংবেদনশীল মন দরকার—আইন, প্রযুক্তি বা শক্তি নয়। সমাজ যতক্ষণ গর্ভের শিশুর জীবনের পূর্ণ সম্মান না দেবে, ততক্ষণ মায়েদের শেষ আর্তনাদও বাতাসে মিলিয়ে যাবে—আর নৃশংস জনতা একই চক্রে ঘুরে ফিরে বেড়াবে।