উপকূলের জীবনযুদ্ধ
সাতক্ষীরা জেলার উপকূলবর্তী উপজেলা শ্যামনগর—বাংলাদেশের অন্যতম জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ জনপদ। সুন্দরবনের কোলঘেঁষা এই অঞ্চল এক সময় ছিল সবুজে ঘেরা, নদী-বেষ্টিত, কৃষি ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই জনপদে নেমে এসেছে এক নীরব দুর্যোগ—লবণাক্ততা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীর পানিপ্রবাহের পরিবর্তন, অতিমাত্রায় চিংড়ি চাষ এবং অব্যবস্থাপনার কারণে শ্যামনগরের পানি ও মাটি হয়ে উঠেছে লবণাক্ত। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এখানকার মানুষের জীবনযাপন, কৃষি, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ।
পানযোগ্য পানির সংকট: প্রতিদিনের এক মানবিক লড়াই
শ্যামনগরে মিষ্টি পানির জন্য এখন প্রতিটি পরিবারকে নানাভাবে সংগ্রাম করতে হয়। অধিকাংশ গ্রামে নলকূপের পানি খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এতটাই নিচে নেমে গেছে যে, সেখান থেকে পানি উত্তোলন কঠিন এবং ব্যয়বহুল। অনেক গ্রামবাসী ২-৩ কিলোমিটার দূরে গিয়ে কলসি বা গ্যালন কাঁধে করে পানি নিয়ে আসেন। মেয়েরা সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে বা ছোট ছেলেমেয়েরা সন্ধ্যার সময় এই কাজ করে থাকে।
একজন নারী বাসিন্দা হামিদা খাতুন জানান, “আমার মেয়ে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে পানি আনতে যায়। বালতিতে পানি তুলতে তুলতে হাতে ফোসকা পড়ে গেছে। কিন্তু কী করব? পানি তো আনতেই হবে।”

কৃষিতে লবণাক্ততার থাবা: ধানক্ষেত এখন চিংড়িঘের
এক সময় শ্যামনগর ছিল ধান, পাট, তিল, পাটশাক ও মৌসুমি সবজির জন্য পরিচিত। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ জমিতে চাষ করা যায় না। মাটির লবণাক্ততা এতটাই বেড়েছে যে, সেখানে এখন আর ধান হয় না। অনেক কৃষক বাধ্য হয়ে জমি চিংড়ি চাষে দিয়ে দিচ্ছেন, কারণ এতে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু আয় হলেও পরিবেশ এবং মাটির স্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে।
স্থানীয় কৃষক মহিউদ্দিন শেখ বলেন, “আগে আমি বছরে দুইবার ধান করতাম, এখন একটাও হয় না। বাধ্য হয়ে ঘের দিয়েছি। কিন্তু এই ঘের সবার পোষায় না। মাটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।”
নারীদের কষ্টের আলাদা দিক: গৃহস্থালি থেকে পানির সংগ্রাম
শ্যামনগরের নারীদের জীবন আরও কঠিন। পুরুষেরা যেখানেই থাকুক, নারীদের ঘরের পানির প্রয়োজন মেটাতে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় পানির উৎস খুঁজে বের করতে হয়। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের জন্য নিরাপদ পানি পাওয়া হয়ে উঠেছে বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকেই প্রসবকালীন জটিলতায় পড়ছেন, কারণ তারা সময়মতো বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারছেন না।
স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব: পানি নয়, বিষ খাচ্ছে মানুষ
লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে মানুষের শরীরে দেখা দিচ্ছে নানা রোগ। উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি সমস্যা, ত্বকের চুলকানি, গ্যাস্ট্রিক সমস্যা ও হেপাটাইটিস এখন সাধারণ রোগে পরিণত হয়েছে। শিশুরা জন্ম থেকেই দূষিত পানি এবং আবহাওয়ার মাঝে বেড়ে উঠছে, যার ফলে তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ছে।

শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন চিকিৎসক জানান, “প্রতি সপ্তাহে অন্তত ২০-৩০ জন রোগী আসেন, যারা কিডনি, উচ্চ রক্তচাপ বা ত্বকের সমস্যায় ভুগছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমস্যার মূল কারণ লবণাক্ত পানি।”
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সংকট: হারিয়ে যাচ্ছে মাছ, শুকিয়ে যাচ্ছে নদী
শ্যামনগরের আশেপাশের এলাকা একসময় ছিল মাছ ও জলজ জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। সুন্দরবনের কাছাকাছি হওয়ার কারণে এখানকার নদ-নদী, খাল-বিল ছিল জীবনের প্রাণ। কিন্তু এখন নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে গেছে, পুকুর শুকিয়ে যাচ্ছে, নদীর প্রবাহ কমে গেছে। ফলে মাছের প্রজাতি হ্রাস পাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে কাঁকড়া ও অন্যান্য জলজ প্রাণী। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
চলমান পদক্ষেপ ও কাঙ্ক্ষিত উদ্যোগ
সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে কিছু উদ্যোগ থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি সীমিত। কিছু এলাকায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য রেইনওয়াটার হারভেস্টিং ট্যাংক বসানো হয়েছে। কোথাও কোথাও গভীর নলকূপ বসানো হলেও অনেক জায়গায় তা এখনও পৌঁছায়নি। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা ও বিকল্প চাষাবাদ প্রযুক্তি স্থানীয়ভাবে এখনও পুরোপুরি গৃহীত হয়নি।

এই সংকট কাটাতে যে পদক্ষেপগুলো জরুরি:
- অধিকসংখ্যক গভীর নলকূপ স্থাপন ও পানি ফিল্টার প্রযুক্তির ব্যবহার
- নারীদের জন্য নিরাপদ পানি সংগ্রহের সহজ মাধ্যম নিশ্চিত করা
- লবণ-সহিষ্ণু ধান ও শাকসবজির জাত উদ্ভাবন ও বিতরণ
- স্বাস্থ্যসেবার প্রসার ও সচেতনতা বৃদ্ধি
- স্থানীয় পুকুর সংরক্ষণ ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ
লবণাক্ততার বিরুদ্ধে শ্যামনগরের বেঁচে থাকার লড়াই
শ্যামনগর এখন শুধু একটি জনপদের নাম নয়—এটি লবণাক্ততার বিরুদ্ধে প্রতিদিন যুদ্ধ করে টিকে থাকা লাখো মানুষের প্রতীক। এখানকার মানুষ বাঁচতে চায়, উন্নয়ন চায়, নিরাপদ পানি চায়, চায় টেকসই জীবিকার ব্যবস্থা। এই অঞ্চলের সংকট শুধু স্থানীয় নয়, এটি বাংলাদেশের সামগ্রিক জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি।
এই কারণে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় শ্যামনগরের মানুষের কণ্ঠস্বর ও সমস্যাকে অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। শ্যামনগর এখন কেবল সুপেয় পানির জন্য নয়, সম্মানজনক জীবনের জন্যও লড়ছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















