জন্ম ও শৈশব
আমজাদ হোসেন জন্মগ্রহণ করেন জামালপুর জেলার সাহাবদী পাড়ায়, ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট। তাঁর পিতার নাম ছিল মুহাম্মদ আব্দুল হোসেন, যিনি স্থানীয়ভাবে একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই আমজাদ ছিলেন সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। তিনি জামালপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকেই সাহিত্য ও নাট্যচর্চার সূচনা হয়। গ্রামের মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই তাঁর অভিনয় জীবনের প্রথম পদক্ষেপ ঘটে।
চলচ্চিত্রে আগমন ও প্রথম কাজ
১৯৬১ সালে ঢাকায় এসে তিনি চলচ্চিত্র শিল্পে যোগ দেন। প্রথমে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করলেও পরবর্তীতে অভিনয়ের দিকেও মনোযোগ দেন। তাঁর প্রথম অভিনীত ছবি ছিল “তোমার আমার” (১৯৬৩)। এরপর “পাঁচফোড়ন”, “আলোর মিছিল”সহ আরও কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তবে তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারেন—অভিনয়ের চেয়ে পরিচালনাই তাঁর প্রকৃত জায়গা।
পরিচালনায় সাফল্যের শীর্ষে
অভিনয় জগতে সীমিত সাফল্যের পর আমজাদ হোসেন পরিচালনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৬৭ সালে তিনি পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন চলচ্চিত্র “আগুন নিয়ে খেলা” দিয়ে। এরপর থেকে শুরু হয় তাঁর দুর্দান্ত ক্যারিয়ার।
তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত ও সফল চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- • নয়নমণি (১৯৭৬)— গ্রামীণ সমাজ ও নারীর আত্মত্যাগ নিয়ে নির্মিত এ ছবি তৎকালীন বাংলাদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
- • গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮)— ট্রেনযাত্রার মাধ্যমে সমাজের অসাম্য, ভালোবাসা ও নারী সংগ্রামকে তুলে ধরেন।
- • ভাত দে (১৯৮৪)— দারিদ্র্য, ভিক্ষাবৃত্তি ও মানবিকতার মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরা হয়।
- • কসাই (১৯৮৮)— শহর ও গ্রামের অপরাধ, রাজনীতি ও শোষণের বিষয়ে নির্মিত একটি ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র।
- • গোলাপী এখন ঢাকায় (১৯৯৪)— “গোলাপী” চরিত্রের শহুরে রূপান্তর।
এই চলচ্চিত্রগুলোর মাধ্যমে তিনি বারবার জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন এবং সমাজের দর্পণ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
লেখালেখি ও নাট্যজগতে অবদান
চলচ্চিত্রের পাশাপাশি আমজাদ হোসেন একজন খ্যাতিমান গল্পকার ও নাট্যকারও ছিলেন। তাঁর লেখা ও পরিচালিত বহু জনপ্রিয় টেলিভিশন নাটক ও ধারাবাহিকও রয়েছে। “সুন্দর” ও “এই তো জীবন” তাঁর পরিচালিত প্রশংসিত নাটক। সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় তাঁর উপস্থিতি ছিল নিয়মিত ও আন্তরিক।
ব্যক্তিগত জীবন ও জীবনধারা
আমজাদ হোসেন ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তিনি জীবনভর ঢাকার পুরোনো ঢাকার কাছাকাছি এলাকায় অবস্থান করতেন। সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চায় নিবেদিতপ্রাণ এই মানুষটি রাজনীতি থেকেও দূরে থাকতেন এবং সিনেমাকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে দেখতেন।
তাঁর দুই সন্তান—সৈয়দ শাওন ও সৈয়দ হায়দার—দুজনেই মিডিয়া ও নির্মাণ পেশার সঙ্গে যুক্ত।আমজাদ হোসেনের স্ত্রী ছিলেন গৃহিণী, যিনি পরিবারের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ রক্ষায় ছিলেন শক্ত ভিত।
প্রাপ্ত পুরস্কার ও সম্মাননা
আমজাদ হোসেন জীবদ্দশায় বহু পুরস্কার অর্জন করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- • একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (সেরা পরিচালক, সেরা কাহিনি, সেরা চিত্রনাট্য)
- • একুশে পদক(১৯৯২)
- • বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার
- • বাচসাস পুরস্কার
- • স্বাধীনতা পদক ( ২০১৮)
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর, দীর্ঘদিন অসুস্থতার পর আমজাদ হোসেন ব্যাংককের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গন এক নিঃসঙ্গতায় নিমজ্জিত হয়। তাঁকে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
বহুমাত্রিক
আমজাদ হোসেন ছিলেন একজন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী—তিনি পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, লেখক এবং শিল্পচিন্তক। বাংলাদেশের সিনেমা ইতিহাসে তিনি এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর চলচ্চিত্র শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং সমাজের আয়না হয়ে থেকেছে—যেখানে দেখা যায় বঞ্চনা, সংগ্রাম, প্রেম ও প্রতিবাদ। তাঁর রেখে যাওয়া কর্ম ও চিন্তা ভবিষ্যতের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।