০৪:৪০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

জলন্ত ছাই থেকে ফিরে আসা: এক ক্ষুদ্র কাপড় ব্যবসায়ীর সংগ্রামের গল্প

আগুনের রাতে সব কিছু হারানো

গত বছরের আগস্টের এক গভীর রাতে আগুনের লেলিহান শিখা গিলে খেয়েছিল জেলা শহরের পুরোনো বাজারে থাকা সালাউদ্দিনের ছোট কাপড়ের দোকানটি। ঘুম থেকে হঠাৎ উঠে চিৎকার শুনে বাজারে গিয়ে তিনি দেখেন, তার বহু বছরের গড়ে তোলা দোকানটা নিঃশেষ হয়ে গেছে। মাটিতে পড়ে থাকা ছাইয়ের স্তূপে তখনও জ্বলছিল কিছু কাপড়ের ছেঁড়া টুকরো। চোখের সামনে এক মুহূর্তে সব শেষ হয়ে গেল—স্টক, আসবাব, আলমারি, হিসাবের খাতা—সব।

সালাউদ্দিন তখন হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিলেন ধ্বংসস্তূপের পাশে।

১৫ বছরের পরিশ্রমের অবসান

সালাউদ্দিনের বয়স এখন ৪৫। তিনি স্কুলের গণ্ডি না পেরোতেই বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে শুরু করেছিলেন এই দোকান। প্রথমে ছিল রুমাল, গামছা, নেটের পাঞ্জাবি। ধীরে ধীরে দোকান বড় হয়—জামা, থ্রি-পিস, শাড়ি, পাঞ্জাবি, শিশুদের পোশাক—সবই রাখতেন। ঈদ-পূজার সময় ভালো বিক্রি হতো। তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়েকে স্কুলে পড়াচ্ছিলেন। স্ত্রীকেও মাঝে মাঝে দোকানে বসতে দেখত বাজারের মানুষ।

কিন্তু গত আগস্টের সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ১৫ বছরের স্বপ্ন।

আগুনের পর কীভাবে চলেছে জীবন?

আগুনের ঘটনার পর সালাউদ্দিন প্রথম কয়েকদিন কিছুই বুঝতে পারেননি। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। কয়েকদিন বাজারেও যাননি, ঘরে চুপচাপ বসে থাকতেন। তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম বলেন, “সে সময় স্বামী যেন মানুষ ছিলেন না। খাবারেও রুচি ছিল না, ঘুমও আসত না।”

কিছুটা সামলে উঠে তিনি স্থানীয় একটি এনজিওর মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ নেওয়ার চেষ্টা করেন। শুরুতে কেউ দিতে রাজি হননি, কারণ আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা ছিল অনেক। পরে স্থানীয় এক বড় ভাই তাকে এক লাখ টাকা সুদে দিতে রাজী হয়।

নতুন করে শুরু

ঋণের টাকায় সালাউদ্দিন এবার আর বাজারের বড় দোকানে ফিরে যাননি। তার সাহস ছিল না আবার এত ভাড়া দিয়ে নতুন করে দোকান নেওয়ার। তাই তিনি জেলা শহরের রেলস্টেশনের কাছে একটি টিনের ছাউনি তোলেন। সেখানে টেবিল বসিয়ে সীমিত পরিসরে কাপড়ের দোকান চালু করেন। এখন আর আগের মতো বড় স্টক আনতে পারেন না। ধারে কাপড় এনে বিক্রি করে আবার টাকা দিয়ে দেন।

তিনি বলেন, “আগে যে ব্র্যান্ডের জামদানি শাড়ি বিক্রি করতাম, এখন সেইটা দেখতেও ভয় পাই। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না।”

টাকা ধার নিয়ে ফেরত না দিলে যা করবেন

সংসার চালানো এখন প্রতিদিনের যুদ্ধ

ব্যক্তিগত ওই ঋনের টাকা তিনি মাসে মাসে কিস্তিতে শোধ করছেন।সন্তানদের স্কুল ফি দিতে কষ্ট হয়। বড় ছেলেটা ক্লাস নাইনে পড়ে, ছোটটা চতুর্থ শ্রেণিতে। মেয়েটা এখনও কেজিতে। বাজারের নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় সংসার চালানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। স্ত্রী মাঝে মাঝে নিজের বানানো নারকেলের নাড়ু বা পাপড় বিক্রি করেন।

তিনি বলেন, “সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দোকানে থাকি, কিন্তু একেক দিন ৫০০ টাকার বিক্রি হয়, একেক দিন ১৫০০। সবসময় লাভ হয় না, কিন্তু চলতে তো হবে।”

আগামীর স্বপ্ন এখনও রয়ে গেছে

সালাউদ্দিনের চোখে এখনও কিছু স্বপ্ন রয়ে গেছে। তিনি চান, আবার একটা পাকাপোক্ত দোকান করবেন। ছেলে-মেয়েদের ভালোভাবে লেখাপড়া শেখাবেন। তিনি বলেন, “ঈদের আগে ভিড় বাড়ে, তখন একটু লাভ হয়। আমি সেদিকেই তাকিয়ে থাকি।”

জনপ্রিয় সংবাদ

জলন্ত ছাই থেকে ফিরে আসা: এক ক্ষুদ্র কাপড় ব্যবসায়ীর সংগ্রামের গল্প

০৪:৫০:৪৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ অগাস্ট ২০২৫

আগুনের রাতে সব কিছু হারানো

গত বছরের আগস্টের এক গভীর রাতে আগুনের লেলিহান শিখা গিলে খেয়েছিল জেলা শহরের পুরোনো বাজারে থাকা সালাউদ্দিনের ছোট কাপড়ের দোকানটি। ঘুম থেকে হঠাৎ উঠে চিৎকার শুনে বাজারে গিয়ে তিনি দেখেন, তার বহু বছরের গড়ে তোলা দোকানটা নিঃশেষ হয়ে গেছে। মাটিতে পড়ে থাকা ছাইয়ের স্তূপে তখনও জ্বলছিল কিছু কাপড়ের ছেঁড়া টুকরো। চোখের সামনে এক মুহূর্তে সব শেষ হয়ে গেল—স্টক, আসবাব, আলমারি, হিসাবের খাতা—সব।

সালাউদ্দিন তখন হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিলেন ধ্বংসস্তূপের পাশে।

১৫ বছরের পরিশ্রমের অবসান

সালাউদ্দিনের বয়স এখন ৪৫। তিনি স্কুলের গণ্ডি না পেরোতেই বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে শুরু করেছিলেন এই দোকান। প্রথমে ছিল রুমাল, গামছা, নেটের পাঞ্জাবি। ধীরে ধীরে দোকান বড় হয়—জামা, থ্রি-পিস, শাড়ি, পাঞ্জাবি, শিশুদের পোশাক—সবই রাখতেন। ঈদ-পূজার সময় ভালো বিক্রি হতো। তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়েকে স্কুলে পড়াচ্ছিলেন। স্ত্রীকেও মাঝে মাঝে দোকানে বসতে দেখত বাজারের মানুষ।

কিন্তু গত আগস্টের সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ১৫ বছরের স্বপ্ন।

আগুনের পর কীভাবে চলেছে জীবন?

আগুনের ঘটনার পর সালাউদ্দিন প্রথম কয়েকদিন কিছুই বুঝতে পারেননি। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। কয়েকদিন বাজারেও যাননি, ঘরে চুপচাপ বসে থাকতেন। তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম বলেন, “সে সময় স্বামী যেন মানুষ ছিলেন না। খাবারেও রুচি ছিল না, ঘুমও আসত না।”

কিছুটা সামলে উঠে তিনি স্থানীয় একটি এনজিওর মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ নেওয়ার চেষ্টা করেন। শুরুতে কেউ দিতে রাজি হননি, কারণ আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা ছিল অনেক। পরে স্থানীয় এক বড় ভাই তাকে এক লাখ টাকা সুদে দিতে রাজী হয়।

নতুন করে শুরু

ঋণের টাকায় সালাউদ্দিন এবার আর বাজারের বড় দোকানে ফিরে যাননি। তার সাহস ছিল না আবার এত ভাড়া দিয়ে নতুন করে দোকান নেওয়ার। তাই তিনি জেলা শহরের রেলস্টেশনের কাছে একটি টিনের ছাউনি তোলেন। সেখানে টেবিল বসিয়ে সীমিত পরিসরে কাপড়ের দোকান চালু করেন। এখন আর আগের মতো বড় স্টক আনতে পারেন না। ধারে কাপড় এনে বিক্রি করে আবার টাকা দিয়ে দেন।

তিনি বলেন, “আগে যে ব্র্যান্ডের জামদানি শাড়ি বিক্রি করতাম, এখন সেইটা দেখতেও ভয় পাই। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না।”

টাকা ধার নিয়ে ফেরত না দিলে যা করবেন

সংসার চালানো এখন প্রতিদিনের যুদ্ধ

ব্যক্তিগত ওই ঋনের টাকা তিনি মাসে মাসে কিস্তিতে শোধ করছেন।সন্তানদের স্কুল ফি দিতে কষ্ট হয়। বড় ছেলেটা ক্লাস নাইনে পড়ে, ছোটটা চতুর্থ শ্রেণিতে। মেয়েটা এখনও কেজিতে। বাজারের নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় সংসার চালানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। স্ত্রী মাঝে মাঝে নিজের বানানো নারকেলের নাড়ু বা পাপড় বিক্রি করেন।

তিনি বলেন, “সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দোকানে থাকি, কিন্তু একেক দিন ৫০০ টাকার বিক্রি হয়, একেক দিন ১৫০০। সবসময় লাভ হয় না, কিন্তু চলতে তো হবে।”

আগামীর স্বপ্ন এখনও রয়ে গেছে

সালাউদ্দিনের চোখে এখনও কিছু স্বপ্ন রয়ে গেছে। তিনি চান, আবার একটা পাকাপোক্ত দোকান করবেন। ছেলে-মেয়েদের ভালোভাবে লেখাপড়া শেখাবেন। তিনি বলেন, “ঈদের আগে ভিড় বাড়ে, তখন একটু লাভ হয়। আমি সেদিকেই তাকিয়ে থাকি।”