রাজকীয় প্রসব ও গ্লোরিয়াস রেভল্যুশনের বীজ
১০ জুন ১৬৮৮ সালের সকালে সেন্ট জেমস প্যালেসে রানি মারিয়া অব মডেনা প্রসববেদনায় কাতর হলেন। গুজব ছড়িয়েছিল—এই গর্ভধারণ নাকি ভুয়া, ভবিষ্যৎ নবজাতককে নাকি গোপনে এনে শয্যার নিচে রাখা হবে। তাই স্বামী রাজা জেমস দ্বিতীয় প্রায় ৭০ জন সভাসদকে ডেকে নিলেন, যাতে সন্তানসম্ভবা রানিকে সবার চোখের সামনে রাখা যায়। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মারিয়া চিৎকার করলেও রাজা তার মুখের ওপর উইগ চাপিয়ে দিলেও শরীর ঢেকে রাখেননি; প্রত্যেকে জন্মের মুহূর্ত প্রত্যক্ষ করল। লন্ডন গ্যাজেট সে দিনই খবর দিল—ক্যাথলিক উত্তরাধিকারের জন্ম হয়েছে। কিন্তু একটি সাধারণ উনুন ভর্তি বেডপ্যান গুজবকে উসকে দিল—শিশুটিকে নাকি ওই পাত্রে লুকিয়ে আনা হয়েছিল। ঠিক এখান থেকেই সাত ইংরেজ অভিজাত উইলিয়াম অব অরেঞ্জকে আমন্ত্রণ জানালেন; ‘গ্লোরিয়াস রেভল্যুশন’-এর শুরু হলো।
মডেনার ছোট্ট রাজকন্যা
মারিয়া বেট্রিচে দ’এস্তে জন্ম নেন ৫ অক্টোবর ১৬৫৮ সালে, উত্তর ইতালির মডেনায়। প্রাচীন কিন্তু অবনমিত এস্তেন্সি রাজবংশে পিতা অকালমৃত্যুতে মাত্র চার বছরেই তিনি পিতৃহারা হন। প্রকাণ্ড প্রাসাদের সন্নিহিত কনভেন্টেই চলতে থাকে তার শিক্ষা-দীক্ষা—ধর্ম, সঙ্গীত, পাণ্ডিত্য ও বন্ধুত্বের সন্নিবেশে। ছোটবেলাতেই নন হওয়ার ইচ্ছা জন্মায়, কিন্তু ইংল্যান্ডের রাজনীতির ঢেউ অচিরেই সেই সাধনা বদলে দিল।

বৈধব্যে নিমগ্ন যুবরাজ ও পোপের চাপ
রাজা চার্লস দ্বিতীয়ের ভাই ইয়র্কের ডিউক জেমসের স্ত্রী অ্যান হাইড ১৬৭১ সালে মারা যান। উত্তরাধিকার সুরক্ষায় জেমসকে আরেকটি রাজকীয় বিয়ে করতেই হতো। দূত হয়ে এলেন লর্ড পিটারব্যারো। তিনি মডেনায় মারিয়ার প্রতিকৃতি দেখে মুগ্ধ হয়ে ইংল্যান্ডে বার্তা পাঠালেন—“ইংল্যান্ডের সৌভাগ্য খুঁজে পেয়েছি।” মারিয়া কেঁদে উঠে বললেন, “আমি আগুনে ঝাঁপ দেব, তবু এই বিয়ে করব না।” কিন্তু পোপ ক্লেমেন্ট দশম পর্যন্ত লিখে জানালেন—এই বিয়ে ক্যাথলিক গির্জার জন্য ‘মহতী সেবা’। চাপে পড়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে মারিয়া রাজি হলেন।
‘মেরি মনার্ক’-এর দরবারে বিপরীত হাওয়া
১৬৭৩ সালে তিনি লন্ডনে পৌঁছেই বুঝলেন—প্রোটেস্টান্ট ইংল্যান্ডে ‘পোপীয় ষড়যন্ত্র’ ভয়ই সবার বড় আতঙ্ক। ষড়যন্ত্রমুখর প্রচারপত্রে লেখা হচ্ছিল, “সে যেন গুটি বসন্তে মরুক।” তবু কিশোরী রানী ধীরেসুস্থে পরিস্থিতি সামলালেন—ইংরেজি শেখা, কবি জন ড্রাইডেনকে দিয়ে কবিতা রচনা, চিত্রশিল্পী পিটার লেলির পোর্ট্রেট, আর ইতালীয় অপেরার ঢেউ। সৎকন্যা মেরি ও অ্যানকে নিয়ে ‘দ্য মাস্ক অব ক্যালিস্টো’ নামে অপূর্ব অপেরা-নাটকে অভিনয় করালেন; পর্দার আড়ালে অন্যতম তারকা ছিলেন মোহিনী সারা জেনিংস—ভবিষ্যতের ক্ষমতাধর সারাহ চার্চিল।
মাতৃত্বের আনন্দ-বেদনা
প্রথম সন্তান কাথরিন লরা জন্মের পরই মারিয়া বুঝলেন—রাজপরিবারের শিশুর ওপর তার অধিকার নেই। ক্যাথলিক রীতিতে গোপনে সন্তানের বাপ্তিস্ম করালেও রাজা চার্লস দ্বিতীয় বললেন, আবার প্রোটেস্টান্ট রীতিতে করতে হবে। মোট বারো বার তিনি গর্ভবতী হলেও কেবল জেমস ফ্রান্সিস এডওয়ার্ড ও লুইজা মারিয়া টেরেসা প্রাপ্তবয়স্ক হন।

ষড়যন্ত্র, নির্বাসন ও আতঙ্ক
ষোলোশ আটাত্তরের ভুয়া ‘পোপিশ প্লট’-এ ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে পাগলাটে অভিযোগ ওঠে; মারিয়ার বন্ধুদের ফাঁসি হয়, নিজে যেতে হয় ব্রাসেলস ও পরে স্কটল্যান্ডে নির্বাসনে। ১৬৮৩ সালের ‘রাই হাউস প্লট’-এ চার্লস আর জেমসকে হত্যা করে ডিউক অব মনমাউথকে রাজা বানানোর ছক ফাঁস হয়; সেই উত্তাল পরিবেশে মারিয়া আবার লন্ডনে ফেরেন।
নারীবন্ধন ও সৃজনশীল অঙ্গন
সেই দুঃসময়েই কনভেন্ট জীবনের মতো এক বুদ্ধিবৃত্তিক বৃত্ত গড়েন—কবি অ্যান কিংসমিল ও অ্যান কিলিগ্রু, দুজনেই তার ‘মেইড অব অনার’। ‘ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডোনিস’ নামে নারীদৃষ্টি-সম্পন্ন মাস্ক ও ‘ভেনাস অ্যাটায়ার্ড বাই দ্য গ্রেইসেস’ ছবিতে রানীকে ভেনাস রূপে অঙ্কিত করেন তাঁরা। মনে হচ্ছিল, নারীদের শিল্প-সাহিত্যচর্চায় নতুন ভোর ফুটছে।
রাজমুকুট, শোকে ছায়া

১৬৮৫ সালে চার্লস দ্বিতীয় প্রয়াত হতেই জেমস দ্বিতীয় সিংহাসনে, মারিয়া ক্যাথলিক রানি। কবি আফরা বিন মুকুট ধারণ উৎসবে গান লিখলেন, কিলিগ্রু অঙ্কন করলেন ঐতিহাসিক প্রতিকৃতি। কিন্তু ওই বছরেই কিলিগ্রুর স্নলপক্সে মৃত্যু; রাজা জেমস স্বৈরাচারী মনোভাব নিলেন—সংসদকেই শত্রু ভাবলেন।
রাজপুত্রের জন্ম ও শাসনব্যবস্থার ভাঙন
১৬৮৮ সালের সেই বহুচর্চিত প্রসবের পর সদ্যোজাত জেমস ফ্রান্সিস এডওয়ার্ডকে প্রোটেস্টান্ট অপবাদ দিল—তিনি নাকি ‘বেডপ্যান-শিশু’, আসল সন্তানের বদলে আনা কৌটার ভিতর লুকিয়ে। এই গল্পের হাত ধরেই উইলিয়াম অব অরেঞ্জ সেনাবাহিনী নিয়ে ইংল্যান্ডে হাজির; গোলমালহীন অভ্যুত্থান ‘গ্লোরিয়াস রেভল্যুশন’ জেমসকে সিংহাসনচ্যুত করল। মারিয়া ও পরিবার পালিয়ে গেল ফ্রান্সে।
উত্তরাধিকার ও মূল্যায়ন
ইতালির এক কিশোরী কনভেন্ট-সন্ন্যাসীর স্বপ্নে বেড়ে ওঠা মেয়েকে ব্যস্ত, বৈরী ইংল্যান্ডে এনে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু বানানো হয়েছিল একটিই কারণে—ক্যাথলিক উত্তরাধিকার। কিন্তু মারিয়া অব মডেনা ছিলেন শুধু ‘ক্যাথলিক গর্ভ’ নন; তিনি ছিলেন শিক্ষিত, সাহসী, সংস্কৃতিমান এবং নারীবন্ধনের পৃষ্ঠপোষক। তার জীবনের নানা বিজয় ও বেদনা সাম্রাজ্যের গতিপথই বদলে দিয়েছিল—এবং ইতিহাসে অমোচনীয় দাগ রেখে গেছে এক তরুণ ইতালীয় রানীর নাম।

সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















