০৬:০৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

এই বছর লাভ করতে ব্যর্থ কেন ‘বাটা সু কোম্পানি (বাংলাদেশ)’?

বাংলাদেশের খুচরা ও চামড়াজাত পণ্যের বাজারে দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রতিষ্ঠিত নাম ‘বাটা সুকোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড’। বহু দশক ধরে প্রতিষ্ঠানটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের পণ্য বিক্রি করে আসছে; বিশেষত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে জুতা, স্যান্ডেল ও আনুষঙ্গিক সামগ্রীর জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি লক্ষণীয়ভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই দীর্ঘস্থায়ী ও জনপ্রিয় কোম্পানিটি এ বছর লাভ করতে পারল না?

ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস: মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যয় সংকোচন

২০২৪ সালের শেষার্ধে বাংলাদেশে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি দেখা যায়, যার ফলে সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ বেড়ে যায় এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমতে থাকে। যেহেতু বাটা মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে লক্ষ্য করে পণ্য বাজারজাত করে, তাই এ শ্রেণির ভোক্তারা জুতা বা স্যান্ডেল কেনার পরিকল্পনা পিছিয়ে দেন বা সস্তা বিকল্প খোঁজেন। এতে বাটার বিক্রয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।

প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পিছিয়ে পড়া

বর্তমানে দেশের বাজারে অনেক নতুন দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ড এসেছে, যারা কম দামে আরও আধুনিক ডিজাইনের জুতা সরবরাহ করছে। যেমন—অ্যাপেক্স, এস্পারো, ওয়াকার্স, আর আন্তর্জাতিক অনলাইন মার্কেটপ্লেসে চাইনিজ ব্র্যান্ডের পণ্য মিলছে অতি সস্তায়। তুলনামূলকভাবে বাটার ডিজাইন ও ব্র্যান্ডিং কিছুটা সেকেলে হয়ে পড়েছে বলে অনেক ক্রেতা মনে করেন, যার ফলে প্রতিষ্ঠানটি বাজার হারাতে বসেছে।

উৎপাদন ও আমদানির ব্যয় বৃদ্ধি

২০২৪ সালে টাকার অবমূল্যায়ন, ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং কাঁচামাল আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাটার উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। এ ছাড়া সরকারের আমদানি-নিয়ন্ত্রণমূলক নীতির কারণে অনেক উপকরণ সময়মতো আনা যায়নি, ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে।

অব্যবস্থাপনা ও অলাভজনক দোকান বন্ধ

গত বছর বাটা বেশ কয়েকটি অলাভজনক আউটলেট বন্ধ করেছে, বিশেষত জেলা শহরগুলোয়। এতে তাৎক্ষণিক খরচ কমলেও দীর্ঘমেয়াদে ব্র্যান্ডের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি কিছু নতুন শোরুম পরিচালনায় ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি, লোকবল ছাঁটাই ও অভিজ্ঞ কর্মীদের অপসারণও ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।

ডিজিটাল মার্কেটিং ও ই-কমার্সে দুর্বলতা

অধিকাংশ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান যেখানে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে, সেখানে বাটার ডিজিটাল উপস্থিতি এখনও সীমিত ও পুরোনো ধাঁচের। অনলাইনে অর্ডার, হোম ডেলিভারি ও রিটার্ন নীতির ক্ষেত্রে কোম্পানিটি প্রতিযোগীদের তুলনায় পিছিয়ে।

কর ও পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি

২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার কর কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন আনে এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ায়, যা উৎপাদন খরচ ও দোকান পরিচালনার ব্যয় বাড়িয়ে তোলে। ফলে লাভের পরিমাণ কমে যায় বা ক্ষতি হয়।

মানিয়ে চলতে ব্যর্থ

বাটা সু কোম্পানি বাংলাদেশে এক সময়ের প্রতাপশালী ব্র্যান্ড হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজারের পরিবর্তন, ভোক্তা চাহিদা ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপের সঙ্গে মানিয়ে চলতে ব্যর্থ হয়েছে। নকশা উদ্ভাবন, ডিজিটালাইজেশন, প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নির্ধারণ ও সঠিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানটি আরও ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।

এখন সময় এসেছে বাটার জন্য নীতিগত পরিবর্তন, বিপণন কৌশলের আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল রূপান্তরের দিকে মনোযোগ দেওয়ার। অন্যথায়, শতবর্ষের এই প্রতিষ্ঠানকে টিকে থাকতে কঠিন লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

এই বছর লাভ করতে ব্যর্থ কেন ‘বাটা সু কোম্পানি (বাংলাদেশ)’?

০৮:০০:১৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ অগাস্ট ২০২৫

বাংলাদেশের খুচরা ও চামড়াজাত পণ্যের বাজারে দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রতিষ্ঠিত নাম ‘বাটা সুকোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড’। বহু দশক ধরে প্রতিষ্ঠানটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের পণ্য বিক্রি করে আসছে; বিশেষত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে জুতা, স্যান্ডেল ও আনুষঙ্গিক সামগ্রীর জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি লক্ষণীয়ভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই দীর্ঘস্থায়ী ও জনপ্রিয় কোম্পানিটি এ বছর লাভ করতে পারল না?

ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস: মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যয় সংকোচন

২০২৪ সালের শেষার্ধে বাংলাদেশে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি দেখা যায়, যার ফলে সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ বেড়ে যায় এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমতে থাকে। যেহেতু বাটা মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে লক্ষ্য করে পণ্য বাজারজাত করে, তাই এ শ্রেণির ভোক্তারা জুতা বা স্যান্ডেল কেনার পরিকল্পনা পিছিয়ে দেন বা সস্তা বিকল্প খোঁজেন। এতে বাটার বিক্রয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।

প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পিছিয়ে পড়া

বর্তমানে দেশের বাজারে অনেক নতুন দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ড এসেছে, যারা কম দামে আরও আধুনিক ডিজাইনের জুতা সরবরাহ করছে। যেমন—অ্যাপেক্স, এস্পারো, ওয়াকার্স, আর আন্তর্জাতিক অনলাইন মার্কেটপ্লেসে চাইনিজ ব্র্যান্ডের পণ্য মিলছে অতি সস্তায়। তুলনামূলকভাবে বাটার ডিজাইন ও ব্র্যান্ডিং কিছুটা সেকেলে হয়ে পড়েছে বলে অনেক ক্রেতা মনে করেন, যার ফলে প্রতিষ্ঠানটি বাজার হারাতে বসেছে।

উৎপাদন ও আমদানির ব্যয় বৃদ্ধি

২০২৪ সালে টাকার অবমূল্যায়ন, ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং কাঁচামাল আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাটার উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। এ ছাড়া সরকারের আমদানি-নিয়ন্ত্রণমূলক নীতির কারণে অনেক উপকরণ সময়মতো আনা যায়নি, ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে।

অব্যবস্থাপনা ও অলাভজনক দোকান বন্ধ

গত বছর বাটা বেশ কয়েকটি অলাভজনক আউটলেট বন্ধ করেছে, বিশেষত জেলা শহরগুলোয়। এতে তাৎক্ষণিক খরচ কমলেও দীর্ঘমেয়াদে ব্র্যান্ডের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি কিছু নতুন শোরুম পরিচালনায় ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি, লোকবল ছাঁটাই ও অভিজ্ঞ কর্মীদের অপসারণও ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।

ডিজিটাল মার্কেটিং ও ই-কমার্সে দুর্বলতা

অধিকাংশ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান যেখানে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে, সেখানে বাটার ডিজিটাল উপস্থিতি এখনও সীমিত ও পুরোনো ধাঁচের। অনলাইনে অর্ডার, হোম ডেলিভারি ও রিটার্ন নীতির ক্ষেত্রে কোম্পানিটি প্রতিযোগীদের তুলনায় পিছিয়ে।

কর ও পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি

২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার কর কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন আনে এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ায়, যা উৎপাদন খরচ ও দোকান পরিচালনার ব্যয় বাড়িয়ে তোলে। ফলে লাভের পরিমাণ কমে যায় বা ক্ষতি হয়।

মানিয়ে চলতে ব্যর্থ

বাটা সু কোম্পানি বাংলাদেশে এক সময়ের প্রতাপশালী ব্র্যান্ড হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজারের পরিবর্তন, ভোক্তা চাহিদা ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপের সঙ্গে মানিয়ে চলতে ব্যর্থ হয়েছে। নকশা উদ্ভাবন, ডিজিটালাইজেশন, প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নির্ধারণ ও সঠিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানটি আরও ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।

এখন সময় এসেছে বাটার জন্য নীতিগত পরিবর্তন, বিপণন কৌশলের আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল রূপান্তরের দিকে মনোযোগ দেওয়ার। অন্যথায়, শতবর্ষের এই প্রতিষ্ঠানকে টিকে থাকতে কঠিন লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।