পাঠ্যসূচির পরিবর্তন: কী ঘটেছে?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যসূচিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। এই পরিবর্তনের আওতায় বাদ পড়েছে বহু প্রগতিশীল কবিতা, প্রবন্ধ ও গদ্য রচনা — যেগুলো দেশের মুক্তচিন্তা, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চায় মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল। এই বাদ দেওয়া রচনাগুলোর মধ্যে ছিলেন জীবনানন্দ দাশ, হুমায়ূন আজাদ, আহমদ ছফা, সেলিনা হোসেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের লেখাও। এদের অনেকেই সমাজের প্রচলিত রক্ষণশীল মূল্যবোধের বাইরে দাঁড়িয়ে চিন্তা করেছেন, যেটা মৌলবাদী গোষ্ঠীর চোখে “বিতর্কিত” বলে বিবেচিত।
ধর্মীয় গোষ্ঠীর চাপ এবং সরকারের সাড়া
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো — এই পরিবর্তনগুলো হয়েছে প্রধানত কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠীর দাবি ও চাপে। বিশেষ করে হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন, তাদের নেতাদের একটি শ্রেণি বহুদিন ধরেই স্কুলপাঠ্য বইয়ে “ধর্ম উপাদান” থাকার অভিযোগ করে আসছিল। শেখ হাসিনা সরকার বহুক্ষেত্রেই এই দাবির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাঠ্যসূচি পরিবর্তন করেছে। এমনকি ২০২৩ সালের পাঠ্যপুস্তক সংস্কারে “ধর্মনিরপেক্ষতা” শব্দটি পর্যন্ত অনেক জায়গা থেকে বাদ পড়ে গেছে, কিংবা সেটি কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।

প্রগতিশীলতার সংকোচন ও বিকল্প বার্তার উত্থান
যেসব লেখা পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো অধিকাংশই মানবতা, সামাজিক সমতা, মুক্তচিন্তা, নারীর অধিকার, পরিবেশচেতনা বা গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সেই জায়গায় যুক্ত হয়েছে ইসলামি ইতিহাস, আরবি শব্দসংবলিত উপস্থাপনা, নির্দিষ্ট আচারভিত্তিক ধর্মীয় গল্প বা অনুরূপ বিষয়বস্তু। এই পরিবর্তনের ফলে পাঠ্যপুস্তকে যে বার্তাটি বড় হয়ে উঠছে, তা হলো — রাষ্ট্রের একটি স্বীকৃত ধর্মীয় পরিচয় আছে এবং অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গি বা ধর্মনিরপেক্ষতা যেন গৌণ বিষয়।
শিশু ও কিশোরদের মনে মৌলবাদী বীজ?
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মানসগঠনে পাঠ্যপুস্তক একটি বড় ভূমিকা রাখে। যখন একটি প্রজন্ম তাদের পড়াশোনায় বারবার এক ধরনের ধর্মীয় চিন্তা ও একমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পায়, তখন তাদের মধ্যে বহুমাত্রিকতা বা সমালোচনার ক্ষমতার জায়গা সংকুচিত হয়ে যায়। ফলে তারা হয় একপেশে ধর্মীয় বিশ্বাসে আচ্ছন্ন হয়, নয়তো অন্য চিন্তাকে বিপদজনক মনে করে। এর ফলাফল দীর্ঘমেয়াদে একটি মৌলবাদী ও অসহিষ্ণু সমাজব্যবস্থা।
শেখ হাসিনার ভূমিকা: কৌশল না সমঝোতা?
শেখ হাসিনার সরকার ইতিহাসে বহুবার নিজেদের “অসাম্প্রদায়িকতার” পক্ষের দল হিসেবে তুলে ধরেছে। এক সময় এই সরকারই হেফাজতকে “মৌলবাদী” ও “জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক” বলে সমালোচনা করেছিল। কিন্তু পরে রাজনৈতিক সমঝোতার অংশ হিসেবে হেফাজতের সঙ্গে যোগাযোগ, আলাপ ও দাবি মেনে নেওয়ার ধারা শুরু হয়। প্রশ্ন উঠছে — এই ধারা কি ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার কৌশল, না কি দীর্ঘমেয়াদে মৌলবাদের সঙ্গে আত্মসমর্পণ?

ভবিষ্যৎ ফলাফল: সমাজ কোথায় যাচ্ছে?
এই পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন শুধু শিক্ষাব্যবস্থার একটি আংশিক পরিবর্তন নয়; এটি আসলে একটি বৃহৎ সামাজিক প্রবণতার প্রতিফলন। যখন একটি রাষ্ট্র বারবার ধর্মীয় চাপের সামনে আত্মসমর্পণ করে, তখন মৌলবাদের উত্থান শুধু সময়ের ব্যাপার। বাংলাদেশের মত একটি জনবহুল, রাজনৈতিকভাবে অস্থির এবং আর্থসামাজিক বৈষম্যে পূর্ণ দেশে এর পরিণতি হতে পারে মারাত্মক — সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, নারীর অধিকার হ্রাস, বাকস্বাধীনতার দমন এবং চরমপন্থার বিস্তার।
মৌলবাদের উৎস তৈরি হচ্ছে ভিতর থেকেই
সুতরাং শেখ হাসিনা সরকারের পাঠ্যসূচি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিছক শিক্ষা সংশোধন নয় — এটি মৌলবাদকে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার একটি নরম বা কৌশলগত পথ। যদি এখনই সমাজের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, অভিভাবক ও প্রগতিশীল শক্তিগুলো একত্রিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে না তোলে, তাহলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশে মৌলবাদই হবে মূলধারা। পাঠ্যপুস্তক থেকে মুক্তচিন্তা বাদ দেওয়া মানে একটি জাতির ভবিষ্যৎ থেকে স্বপ্ন কেড়ে নেওয়া।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















