০৭:৫৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

উত্তরবাংলার হারাবতি নদীর শতবর্ষী যাত্রা ও বর্তমানের সংকট

রাজশাহী বিভাগের জয়পুরহাট জেলার বুক চিরে প্রবাহিত হারাবতি নদী একসময় ছিল উত্তরাঞ্চলের কৃষি, বাণিজ্য, নৌপথ ও জীববৈচিত্র্যের প্রাণকেন্দ্র। নদীর জলধারা আশেপাশের গ্রামীণ জনপদের জীবন, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করত। কিন্তু আজ এটি সিল্টেশনে ভরাট হয়ে শুষ্কতার দিকে ধাবিত—হারাচ্ছে তার প্রাণশক্তি।

একশ বছর আগেস্রোতের প্রাণ ও জীবনের স্পন্দন

১৯২০-এর দশকের জয়পুরহাট অঞ্চলের নদী নেটওয়ার্ক, যেখানে হারাবতি নদীর মূল প্রবাহ ও উপনদীগুলো স্পষ্ট দেখা যায়।

  • কৃষি ও সেচ: নদীর পানি দিয়ে ধান, পাট, আখ, শাকসবজির জমি সারা বছর সেচ পেত।
  • নৌপথ ও বাণিজ্য: বর্ষায় হারাবতি নৌযান চলাচলের উপযোগী ছিল। নৌকা দিয়ে ধান, গম, তেলবীজ, কাঠ ও পাট পরিবহন হতো।
  • জলজ জীববৈচিত্র্য: রুই, কাতলা, মৃগেল, শোল, টাকি, পুঁটি, গুঁই, বোয়াল—প্রচুর দেশি মাছ নদীকে সমৃদ্ধ করত।
  • সামাজিক জীবন: নদীর ঘাট ছিল আড্ডা, হাট, নৌকাবাইচের মঞ্চ, এবং মাছ ধরার উৎসবের কেন্দ্র।

বর্তমান চিত্রএক জীবন্ত নদীর অবক্ষয়

মানচিত্র ২: বর্তমান স্যাটেলাইট ভিউ, যেখানে সিল্ট জমে নদীর প্রবাহ সংকুচিত হয়ে গেছে।

  • সিল্টেশন ও শুষ্কতা: বহু বছরের সেডিমেন্ট জমে গভীরতা নষ্ট, প্রবাহ কমে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে নদী প্রায় শুকিয়ে যায়, বর্ষাতেও আগের মতো স্রোত নেই।
  • চার নদীর দুরবস্থা: হারাবতির পাশাপাশি চিরি, ছোট যমুনা, তুলসীগঙ্গা একই সংকটে।
  • জীবনযাত্রার বিপর্যয়: কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত, মাছ কমে গেছে, পানীয় জলের সংকট তীব্র।

তথ্য ও মাছের প্রজাতি

হারাবতি নদীর উল্লেখযোগ্য মাছের ছবি ও বাংলা-ইংরেজি নাম—

রুই (Labeo rohita)

কাতলা (Catla catla)

মৃগেল (Cirrhinus mrigala)

শোল (Channa striata)

বোয়াল (Wallago attu)

পুঁটি (Puntius sophore)

টাকি (Channa punctata)

গুঁই (Monopterus cuchia)

মানবকাহিনী

পুরনো ফটোগ্রাফ: ১৯৭০-এর দশকে হারাবতি নদীর ঘাটে মাছ ধরার উৎসবের ছবি।
স্থানীয় প্রবীণ কৃষক আবদুল করিম বলেন—

“যৌবনে হারাবতির পানি দিয়ে তিন ফসল তুলতাম। এখন নদী আছে, কিন্তু পানি নেই। মাছ নেই, নৌকা চলে না—সবই স্মৃতি হয়ে গেছে।”

সরকারি ও স্থানীয় উদ্যোগ

  • নদীখনন প্রকল্প: প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে ড্রেজিং পরিকল্পনা।
  • অবকাঠামো উন্নয়ন: বহু বছরের দাবি—নদীর উপর স্থায়ী সেতু নির্মাণ।
  • পরিবেশ সংরক্ষণ: নদীতীরবর্তী বনায়ন ও তীর রক্ষা বাঁধ।

পুনর্জীবনের সুপারিশ

নিয়মিত ড্রেজিং।

মাছের প্রজনন মৌসুমে সুরক্ষা জোন ঘোষণা।

নদীতীরবর্তী জনসচেতনতা কর্মসূচি।

কৃষি ও মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পে জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার সমন্বয়।

হারাবতি নদীর ইতিহাস শুধু অতীত নয়—এটি উত্তরাঞ্চলের জীবন ও সংস্কৃতির প্রতীক। পরিকল্পনা, সরকারি সহযোগিতা ও জনগণের অংশগ্রহণ থাকলে হারাবতি আবারও স্রোতস্বিনী হয়ে উঠতে পারে, ফিরিয়ে আনতে পারে কৃষির স্বচ্ছলতা, মাছের প্রাচুর্য ও নদীকেন্দ্রিক জীবনের উচ্ছ্বাস।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

উত্তরবাংলার হারাবতি নদীর শতবর্ষী যাত্রা ও বর্তমানের সংকট

০২:০০:৫৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ অগাস্ট ২০২৫

রাজশাহী বিভাগের জয়পুরহাট জেলার বুক চিরে প্রবাহিত হারাবতি নদী একসময় ছিল উত্তরাঞ্চলের কৃষি, বাণিজ্য, নৌপথ ও জীববৈচিত্র্যের প্রাণকেন্দ্র। নদীর জলধারা আশেপাশের গ্রামীণ জনপদের জীবন, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করত। কিন্তু আজ এটি সিল্টেশনে ভরাট হয়ে শুষ্কতার দিকে ধাবিত—হারাচ্ছে তার প্রাণশক্তি।

একশ বছর আগেস্রোতের প্রাণ ও জীবনের স্পন্দন

১৯২০-এর দশকের জয়পুরহাট অঞ্চলের নদী নেটওয়ার্ক, যেখানে হারাবতি নদীর মূল প্রবাহ ও উপনদীগুলো স্পষ্ট দেখা যায়।

  • কৃষি ও সেচ: নদীর পানি দিয়ে ধান, পাট, আখ, শাকসবজির জমি সারা বছর সেচ পেত।
  • নৌপথ ও বাণিজ্য: বর্ষায় হারাবতি নৌযান চলাচলের উপযোগী ছিল। নৌকা দিয়ে ধান, গম, তেলবীজ, কাঠ ও পাট পরিবহন হতো।
  • জলজ জীববৈচিত্র্য: রুই, কাতলা, মৃগেল, শোল, টাকি, পুঁটি, গুঁই, বোয়াল—প্রচুর দেশি মাছ নদীকে সমৃদ্ধ করত।
  • সামাজিক জীবন: নদীর ঘাট ছিল আড্ডা, হাট, নৌকাবাইচের মঞ্চ, এবং মাছ ধরার উৎসবের কেন্দ্র।

বর্তমান চিত্রএক জীবন্ত নদীর অবক্ষয়

মানচিত্র ২: বর্তমান স্যাটেলাইট ভিউ, যেখানে সিল্ট জমে নদীর প্রবাহ সংকুচিত হয়ে গেছে।

  • সিল্টেশন ও শুষ্কতা: বহু বছরের সেডিমেন্ট জমে গভীরতা নষ্ট, প্রবাহ কমে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে নদী প্রায় শুকিয়ে যায়, বর্ষাতেও আগের মতো স্রোত নেই।
  • চার নদীর দুরবস্থা: হারাবতির পাশাপাশি চিরি, ছোট যমুনা, তুলসীগঙ্গা একই সংকটে।
  • জীবনযাত্রার বিপর্যয়: কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত, মাছ কমে গেছে, পানীয় জলের সংকট তীব্র।

তথ্য ও মাছের প্রজাতি

হারাবতি নদীর উল্লেখযোগ্য মাছের ছবি ও বাংলা-ইংরেজি নাম—

রুই (Labeo rohita)

কাতলা (Catla catla)

মৃগেল (Cirrhinus mrigala)

শোল (Channa striata)

বোয়াল (Wallago attu)

পুঁটি (Puntius sophore)

টাকি (Channa punctata)

গুঁই (Monopterus cuchia)

মানবকাহিনী

পুরনো ফটোগ্রাফ: ১৯৭০-এর দশকে হারাবতি নদীর ঘাটে মাছ ধরার উৎসবের ছবি।
স্থানীয় প্রবীণ কৃষক আবদুল করিম বলেন—

“যৌবনে হারাবতির পানি দিয়ে তিন ফসল তুলতাম। এখন নদী আছে, কিন্তু পানি নেই। মাছ নেই, নৌকা চলে না—সবই স্মৃতি হয়ে গেছে।”

সরকারি ও স্থানীয় উদ্যোগ

  • নদীখনন প্রকল্প: প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে ড্রেজিং পরিকল্পনা।
  • অবকাঠামো উন্নয়ন: বহু বছরের দাবি—নদীর উপর স্থায়ী সেতু নির্মাণ।
  • পরিবেশ সংরক্ষণ: নদীতীরবর্তী বনায়ন ও তীর রক্ষা বাঁধ।

পুনর্জীবনের সুপারিশ

নিয়মিত ড্রেজিং।

মাছের প্রজনন মৌসুমে সুরক্ষা জোন ঘোষণা।

নদীতীরবর্তী জনসচেতনতা কর্মসূচি।

কৃষি ও মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পে জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার সমন্বয়।

হারাবতি নদীর ইতিহাস শুধু অতীত নয়—এটি উত্তরাঞ্চলের জীবন ও সংস্কৃতির প্রতীক। পরিকল্পনা, সরকারি সহযোগিতা ও জনগণের অংশগ্রহণ থাকলে হারাবতি আবারও স্রোতস্বিনী হয়ে উঠতে পারে, ফিরিয়ে আনতে পারে কৃষির স্বচ্ছলতা, মাছের প্রাচুর্য ও নদীকেন্দ্রিক জীবনের উচ্ছ্বাস।