জন্ম ও শৈশব
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী নায়িকা মৌসুমীর জন্ম ৩ নভেম্বর ১৯৭৩ সালে খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা জেলায়। তাঁর পূর্ণ নাম পারভিন সুলতানা মৌসুমী, তবে তিনি সবার কাছে মৌসুমী নামেই পরিচিত। তিন বোনের মধ্যে তিনি বড়, ছোট বোনদের মধ্যে একজন ইরিন জামানও বিনোদন জগতে যুক্ত ছিলেন। শৈশবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল, এবং পরিবার থেকেও তিনি সাংস্কৃতিক চর্চায় উৎসাহ পেতেন।
প্রারম্ভিক পথচলা ও বিনোদন জগতে প্রবেশ
মৌসুমীর বিনোদন জগতে প্রবেশ ঘটে ১৯৯০ সালে ‘আনন্দ বিচিত্রা ফটো বিউটি কনটেস্ট’-এ বিজয়ের মাধ্যমে। এই সাফল্যের পর তিনি টেলিভিশনের বিভিন্ন বিজ্ঞাপন ও নাটকে অভিনয় শুরু করেন। তাঁর সৌন্দর্য, আত্মবিশ্বাস এবং অভিনয়গুণ দ্রুতই নির্মাতাদের নজর কাড়ে, যা তাঁকে চলচ্চিত্রে সুযোগ এনে দেয়।
চলচ্চিত্রে অভিষেক
১৯৯৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ চলচ্চিত্রে সালমান শাহর বিপরীতে অভিনয়ের মাধ্যমে মৌসুমীর চলচ্চিত্র যাত্রা শুরু হয়। ছবিটি ছিল ব্যাপক জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল, যা তাঁকে রাতারাতি তারকা করে তোলে। পরবর্তীতে তিনি ‘অনন্তরে অনন্তরে’, ‘দোলা’, ‘স্নেহ’, ‘বিশ্ব প্রেমিক’, ‘গরীবের রানী’সহ অসংখ্য হিট ছবিতে অভিনয় করেন।
পরিচালনা ও প্রযোজনায় পদচারণা
২০০৩ সালে ‘কখনো মেঘ কখনো বর্ষা’ চলচ্চিত্র পরিচালনার মাধ্যমে মৌসুমী নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। পরবর্তীতে ‘মেহের নগর’ (২০০৬) ও ‘শূন্য হৃদয়’ (২০১৪) চলচ্চিত্রও পরিচালনা করেন। অভিনয়ের পাশাপাশি প্রযোজনা ও পরিচালনায় তাঁর অংশগ্রহণ তাঁকে বহুমাত্রিক শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
পুরস্কার ও সম্মাননা
মৌসুমী তাঁর দীর্ঘ অভিনয়জীবনে তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন—‘মেঘলা আকাশ’ (২০০১), ‘দেবদাস’ (২০১৩) এবং ‘তারকাটা’ (২০১৪) ছবিতে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে। এছাড়া তিনি মেরিল–প্রথম আলো পুরস্কারসহ অসংখ্য বেসরকারি সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
পরিবার ও ব্যক্তিজীবন
১৯৯৬ সালে মৌসুমী জনপ্রিয় অভিনেতা ওমর সানীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দুই সন্তান—ছেলে ফারদিন এহসান সাদীন এবং মেয়ে ফাইজা। বিবাহের পর কিছু সময় অভিনয় থেকে বিরতি নিলেও পরে তিনি আবারও চলচ্চিত্রে ফিরেছিলেন। পারিবারিক জীবনে স্বামী ও সন্তানদের প্রতি তাঁর নিবেদন আজও সমানভাবে প্রশংসিত।
বিজ্ঞাপন ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে উপস্থিতি
চলচ্চিত্রের পাশাপাশি মৌসুমী একাধিক টেলিভিশন বিজ্ঞাপনেও কাজ করেছেন। তিনি দেশের বাইরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন, যেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে তিনি সমান জনপ্রিয়।
সামাজিক কাজ ও বর্তমান অবস্থা
মৌসুমী “মৌসুমী ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন” প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা নারী ও শিশুদের কল্যাণে কাজ করে। ২০১৩ সালে তিনি ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হন। ২০০৯ সালের পর থেকে তিনি প্রধান চরিত্রে কম এবং সহায়ক বা অতিথি চরিত্রে বেশি অভিনয় করছেন। ব্যক্তিগত ও সামাজিক কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে নতুন সিনেমায় তাঁর উপস্থিতি কমে গেছে।
কর্মজীবনের সময়রেখা
১৯৯০ সালে বিউটি কনটেস্ট জয়ের মাধ্যমে শিল্পীজীবনের সূচনা, ১৯৯৩ সালে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’-এ চলচ্চিত্রে অভিষেক, ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষভাগ পর্যন্ত একাধিক ব্যবসাসফল ছবিতে অভিনয়, ২০০১ সালে ‘মেঘলা আকাশ’-এ জাতীয় পুরস্কার অর্জন, ২০০৩ সালে পরিচালনায় অভিষেক, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে জাতীয় পুরস্কারে ফের সম্মানিত হওয়া, এবং ২০১০-এর দশকের শেষভাগে এসে অভিনয়ে সীমিত উপস্থিতি—এভাবেই তাঁর যাত্রা বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে।
উল্লেখযোগ্য ছবির তালিকা
‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ (১৯৯৩), ‘অনন্তরে অনন্তরে’ (১৯৯৫), ‘দোলা’ (১৯৯৭), ‘স্নেহ’ (১৯৯৮), ‘বিশ্ব প্রেমিক’ (২০০০), ‘মেঘলা আকাশ’ (২০০১), ‘দেবদাস’ (২০১৩), ‘তারকাটা’ (২০১৪), ‘আমি নেতা হবো’ (২০১৮) এবং ‘সাহেব নামের গোলাম’ (২০১৯) তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবি। প্রতিটি ছবিতেই তিনি আলাদা চরিত্রে অভিনয় করে নিজের বহুমাত্রিক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন।
আজকের মৌসুমী
বর্তমানে মৌসুমী ঢাকায় বসবাস করছেন এবং সামাজিক কর্মকাণ্ড ও পারিবারিক জীবনে বেশি সময় দিচ্ছেন। চলচ্চিত্রে তাঁর উপস্থিতি এখন সীমিত হলেও, দর্শক ও শিল্পীদের কাছে তিনি এখনও এক অনুপ্রেরণার নাম।