ছয় দশকের বৈজ্ঞানিক বিতর্কের অবসান
চীনের গবেষকরা দাবি করেছেন, তারা পরীক্ষাগারে ‘উল্কাপিণ্ড হীরা’ বা ষড়ভুজ গঠনের হীরা সফলভাবে তৈরি করেছেন। এর মাধ্যমে প্রায় ৬০ বছরের বিতর্কের সমাপ্তি ঘটল এবং প্রতিরক্ষা ও ইলেকট্রনিক্স খাতে নতুন অগ্রগতির সম্ভাবনা উন্মুক্ত হলো।
প্রথমবার এই ধরনের হীরা ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় ৪৯ হাজার বছর আগে পতিত হওয়া ক্যানিয়ন ডায়াবলো উল্কাপিণ্ডে আবিষ্কৃত হয়। ধারণা করা হয়, তীব্র তাপ ও চাপের ফলে গ্রাফাইট থেকে এর সৃষ্টি হয়েছিল।
হীরার নতুন রূপ – ষড়ভুজ গঠন
সব হীরাই কার্বন পরমাণু দিয়ে তৈরি হলেও তাদের স্ফটিক গঠন সবসময় ঘনক্ষেত্রাকার হয় না। বহু বছর ধরে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা ষড়ভুজ বিন্যাসযুক্ত এই ভিন্ন রূপটি কৃত্রিমভাবে তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

গত ৩০ জুলাই আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সাময়িকী নেচার-এ প্রকাশিত প্রবন্ধে চীনা গবেষকরা জানিয়েছেন, তারা ১০০ মাইক্রোমিটার আকারের উচ্চ বিশুদ্ধতার ষড়ভুজ হীরার স্ফটিক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, যা এই গঠনের বৃহৎ আকারে অস্তিত্বের প্রমাণ দিল।
যৌথ গবেষণা ও বিশেষ পদ্ধতি
এই সাফল্য এসেছে ‘সেন্টার ফর হাই প্রেসার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অ্যাডভান্সড রিসার্চ’ এবং চীনা বিজ্ঞান একাডেমির শিয়ান ইনস্টিটিউট অব অপটিক্স অ্যান্ড প্রিসিশন মেকানিক্সের যৌথ প্রচেষ্টায়।
গবেষণার অন্যতম প্রধান লেখক প্রফেসর লুও দুয়ান জানান, আগে যেসব গবেষক এই ধরনের হীরা তৈরির দাবি করেছেন, সেগুলো ছিল ন্যানোস্কেলে—চীনা দলের তুলনায় হাজার গুণ ছোট—এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিশুদ্ধ ষড়ভুজ গঠন পাওয়া যায়নি।
তার মতে, তাদের উদ্ভাবন আন্তর্জাতিক পেটেন্ট সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে এবং শিল্পায়নের ভিত্তি স্থাপন করবে।

বৈশিষ্ট্য ও সম্ভাব্য প্রয়োগ
ষড়ভুজ গঠনের হীরা স্বাভাবিক হীরার মতোই যান্ত্রিক, তাপীয় ও অপটিক্যাল বৈশিষ্ট্য বহন করে, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে আরও উন্নত। এতে কঠোরতা ও তাপ পরিবাহিতা বেশি, যা উন্নত কাটিং টুল, সুপারহার্ড অ্যাব্রেসিভ, উচ্চক্ষমতার ইলেকট্রনিক যন্ত্র, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি এবং তাপ অপসারণ ডিভাইসে ব্যবহারের সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
গবেষণায় দেখা গেছে, এর কঠোরতা প্রিমিয়াম প্রাকৃতিক হীরার সমান (১১০ গিগাপাসকেল) এবং চাপ ও আঘাত সহনশীলতা আরও বেশি। তাপ পরিবাহিতা তামার তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি এবং ১,১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত স্থিতিশীলতা বজায় রাখে।
সাফল্যের পেছনের দুটি কারণ
প্রধান লেখক ইয়াং লিউশিয়াং জানান, এই সাফল্যের পেছনে দুটি প্রধান কারণ রয়েছে—
১. অতি বিশুদ্ধ ও অপদ্রব্যমুক্ত প্রাকৃতিক গ্রাফাইট সিঙ্গল ক্রিস্টাল কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার।
২. লাইভ মনিটরিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রাফাইট স্ফটিক ধীরে ধীরে সংকুচিত করা এবং রিয়েল-টাইম এক্স-রে ইমেজিংয়ের মাধ্যমে গঠন পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ। এতে ত্রুটি এড়িয়ে নিখুঁত ষড়ভুজ হীরা তৈরি সম্ভব হয়েছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
গবেষকরা এখন বড় আকারের ও আরও উন্নত মানের নমুনা তৈরির দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন। এজন্য সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া উন্নত করা এবং ন্যানোক্রিস্টাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো প্রযুক্তি কাজে লাগানো হবে।
সহ-গবেষক মাও হো-কুয়াং বলেন, এই আবিষ্কার অতিমাত্রায় শক্ত ও উন্নত ইলেকট্রনিক উপকরণ তৈরিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। তার মতে, “এটি কেবল শুরু। ষড়ভুজ হীরার অসাধারণ যান্ত্রিক, বৈদ্যুতিক, তাপীয় ও অপটিক্যাল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা ঘনক্ষেত্রাকার হীরার পরিপূরক হতে পারে।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















