রংপুরের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক বিভিন্ন অনলাইন গ্রুপে খবরটি আসে ২৫ জুলাই রাত ৮টার দিকে। এসব গ্রুপের তথ্যে বলা হয়, রংপুরের গঙ্গাচড়ার আলদাদপুরে এক কিশোর মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে বিকৃত ছবি ও পোস্ট দিয়েছে। ঘটনাটি স্পর্শকাতর হওয়ায় পরদিন সকালে যাওয়ার পরিকল্পনা করি।
কিন্তু পরদিন থানাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করেও কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। দুপুর ২টার দিকে ঘটনার তথ্য জানতে গঙ্গাচড়া থানায় গেলে কর্তব্যরত ডিউটি অফিসার জানালেন, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে গেছেন। তৎক্ষণাৎ মোটরসাইকেলে আলদাদপুরের দিকে রওনা দিই।
গঙ্গাচড়া থেকে আলদাদপুরের দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে আলদাদপুর নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে পৌঁছাই। আলদাদপুর নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আলদাদপুর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে ২২টি পরিবারের বসবাস; তাঁরা সনাতন সম্প্রদায়ের। বিদ্যালয়ের সামনের কোনায় পুলিশের ২৫-৩০ জন সদস্যকে দেখা গেল। ওসি আল এমরান সামনে ওয়্যারলেসে কথা বলছিলেন।
প্রায় ৩০০ গজ পশ্চিমে আলদাদপুর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন দুটি বাড়িতে কিছু উৎশৃঙ্খল যুবক বসতঘরের টিনের বেড়া ভাঙচুর করছিল। পৌনে ৪টার দিকে খবর এল সেনাবাহিনী আসছে। তখন ওই যুবকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০-৫০ জন, যারা পুলিশের সামনে দিয়েই চলে যায়।
৪টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি জিপ আসার পর সদস্যরা ওই বাড়িগুলোতে যান। তাঁদের সঙ্গে পুলিশ ও সাংবাদিকেরাও ছিলেন। বাইরে থেকে দু’তিনটি বাড়ি দেখা গেলেও ভেতরে গিয়ে বোঝা গেল, অন্তত ১৪-১৫টি ঘরে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর ভাষ্য, তাঁরা মিছিলের স্লোগান শুনে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। মিছিল এসেছিল তিন দিক থেকে। পুলিশ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও এক কনস্টেবল ছোড়া ইটের টুকরায় আহত হন। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে পুলিশ বিদ্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়।

হামলার উৎস ও বিস্তার
আলদাদপুর গ্রামটি নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের সীমানা লাগোয়া। আলদাদপুর গ্রাম থেকে ৩০০-৪০০ মিটার দক্ষিণে খিলালগঞ্জ বাজার এবং সেখান থেকে আধা কিলোমিটার পশ্চিমে সিঙ্গেরগাড়ি বাংলাবাজার। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ঘটনার রাতে ওই কিশোরকে আটক করে গঙ্গাচড়া থানায় নেওয়া হলে সিঙ্গেরগাড়ি বাংলাবাজার থেকে মিছিল নিয়ে আলদাদপুরে যাওয়া হয়।
প্রথম মিছিলটি শান্তিপূর্ণ হলেও রাত ১০টার দিকে দ্বিতীয় মিছিল নিয়ে এসে ওই কিশোরের দাদুর বাড়িতে হামলা চালানো হয়। ২৭ জুলাই সকাল ১০টা থেকে মাগুরা ইউনিয়নের সিঙ্গেরগাড়ি বাংলাবাজার, পাড়ের হাট, হাজির হাট, মাগুরা বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে মাইকিং করে ঘোষণা দেওয়া হয়— বাদ জোহর সিঙ্গেরগাড়ি বাংলাবাজারে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি হবে। স্থানীয় মসজিদের মাইক থেকেও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের যোগ দিতে আহ্বান জানানো হয়।
মিছিলের আকার ও অংশগ্রহণকারীরা
নীলফামারী উপজেলার কিশোরগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান জানান, বেলা দু’টার দিকে সিঙ্গেরগাড়ি বাংলাবাজার থেকে একটি মিছিল ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে পাড়ের হাটের দিকে যায়। তখন মিছিলে ৩০০-৪০০ লোক ছিল। কিন্তু ফেরার সময় সংখ্যাটি বেড়ে ৫-৬ হাজারে পৌঁছে যায়।
মাগুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান মিঠু বলেন, ‘আমি দেখেছি, গাড়িতে দুজন ছিলেন— একজন ড্রাইভার ও একজন এসআই। আমি তাঁদের সঙ্গে থাকার অনুরোধ করি। কিন্তু মাইকিং করে বড় কর্মসূচি দেওয়ায় পুলিশের আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল।’

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা
স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, রোববার সকাল থেকেই কিশোরগঞ্জের মাগুরা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করে মানববন্ধন ও বিক্ষোভের আহ্বান জানানো হয়। দুপুর ১২টার দিকে স্থানীয় কয়েকটি মসজিদের মাইক থেকেও প্রচার চালানো হয়।
স্থানীয়দের মতে, সেদিনের মানববন্ধনে সিঙ্গেরগাড়ি নূরানী হাফিজিয়া কওমি মাদ্রাসার পরিচালক জয়নাল আবেদীন এবং তেলমনপাড়া নূরানী এতিমখানার পরিচালক শফিকুল ইসলাম ছিলেন। শফিকুল ইসলামের রাতের একটি ভিডিও বিবিসি বাংলা প্রকাশ করে, যেখানে তাঁকে উত্তেজিত দেখা যায়।
বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ওই দিন মিছিলে ৩-৪টি মাইক ছিল, যার মধ্যে একটি মাইক ছিল বাজারের ব্যবসায়ী সোহাগ আলীর। দুপুরে ২০০-৩০০ তরুণ তাঁর দোকানে মাইক নিতে এলে তিনি অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু পরে দোকান ভাঙচুর করা হয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় ব্যর্থতা
সিঙ্গেরগাড়ি বাংলাবাজারের ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন জানান, ইউপি চেয়ারম্যান আগত জনতার সঙ্গে কথা বলে শান্ত থাকার অনুরোধ করেন। কিন্তু একদল উশৃঙ্খল যুবক তাঁকে গালিগালাজ করে লাঠিসোটা নিয়ে আলদাদপুরের দিকে রওনা দেয়।
ইউপি চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আমি মোটরসাইকেল বাদ দিয়ে ইউপি সদস্য রুহুল আমিনকে নিয়ে ভ্যানে উঠি। পথে খিলালগঞ্জ বাজারের আগে সেতুর সামনে অটো দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছিল। আমরা কয়েকজন মিলে সেটি ঠেকানোর চেষ্টা করলেও কিছু তরুণ ব্যারিকেড ভেঙে চলে যায়।’

রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও পুলিশের ভূমিকা
স্থানীয়দের মতে, সেদিন সিঙ্গেরগাড়ি বাংলাবাজারে স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, স্থানীয় বিএনপি ও ছাত্রশিবিরের লোকজন ছিল। উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক একেএম তাজুল ইসলাম জানান, তিনি ছাত্রদলের লোকজনকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ, সকাল ১১টা থেকে মাইকিং করে হাজার হাজার লোক জড়ো হলেও পুলিশের ভূমিকা ছিল নিষ্ক্রিয়। অতিরিক্ত ফোর্স বা সেনাবাহিনী ডাকতে পারত। তবে কিশোরগঞ্জ থানার ওসি আশরাফুল ইসলাম দাবি করেন, ওই দিন ১০-১২ জন পুলিশ ঘটনাস্থলে ছিল এবং সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল।
হামলার দিন ঘটনাপ্রবাহ
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, হামলাকারীরা তিন দিক থেকে হিন্দুপল্লীতে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। গঙ্গাচড়া থানার ওসি আল এমরান জানান, খিলালগঞ্জ বাজার ও হিন্দুপল্লীর দুই স্থানে সকাল থেকে ২০-২৫ জন পুলিশ মোতায়েন ছিল। কিন্তু খিলালগঞ্জ বাজার থেকে দেড়-দুই হাজার উৎশৃঙ্খল তরুণ আলদাদপুরে ঢুকে পড়ে এবং এক কনস্টেবল আহত হন।
আলদাদপুর ইউপি সদস্য পরেশ চন্দ্র জানান, শনিবার রাতে সিঙ্গেরগাড়ি বাংলাবাজার থেকে প্রথমে একটি মিছিল আসে, পরে আরেকটি মিছিল এসে ওই কিশোরের স্বজনের বাড়ি ভাঙচুর করে। পরদিন আবার মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করা হয়।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















