০৭:৫৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

শিক্ষার্থীদের শ্লোগানে অশালীন স্ল্যাং: শিক্ষার অভাব নাকি পারিবারিক পরিবেশের প্রভাব?

সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ছাত্রছাত্রী মিছিলে বা প্রতিবাদে অশালীন স্ল্যাং শব্দকে শ্লোগান হিসেবে ব্যবহার করছে। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে—এটি কি মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা, নাকি পারিবারিক পরিবেশের প্রভাব? নাকি উভয় ক্ষেত্রের সমন্বিত ফল? সমাজবিজ্ঞানী ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রবণতা কেবল ভাষাগত সমস্যা নয়, বরং এটি শিক্ষাগত ঘাটতি, পারিবারিক শৃঙ্খলার অভাব ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের এক জটিল প্রতিফলন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের  একজন অধ্যাপক বলেন, “যখন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাত্রছাত্রীদের ভদ্র ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার পরিবেশ দিতে ব্যর্থ হয়, তখন তাদের ভাষা ব্যবহারে ও আচরণে নেতিবাচকতা দেখা দেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু পাঠ্যপুস্তক জ্ঞান নয়—নৈতিক শিক্ষা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও ভাষা-আচরণের মানসিকতা গড়ে তুলতেও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।”

তার মতে, অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকর্মীরা এই ধরনের স্ল্যাং ব্যবহারের বিষয়ে উদাসীন, যা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

পারিবারিক প্রভাব

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. সেলিনা পারভীন বলেন, “শিশুর ভাষা শেখা শুরু হয় পরিবার থেকে। যদি বাবা-মা বা অভিভাবকরা ঘরে অশালীন শব্দ ব্যবহার করেন, বা সন্তানকে সঠিক ভাষা ব্যবহারে উৎসাহিত না করেন, তবে সেই প্রভাব বাইরে গিয়ে বেড়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে নিম্নআয়ের পরিবারে, যেখানে বাবা-মা সারাদিন কাজ করেন, সন্তানের ভাষা শেখার প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে।”

তবে তিনি স্পষ্ট করেন, নিম্নআয়ের পরিবার মানেই খারাপ ভাষা শেখা নয়—বরং যেসব পরিবারে শিশুদের পর্যাপ্ত সময় ও সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়, সেখানে এই সমস্যা অনেক কম।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট

সামাজিক গবেষকরা মনে করেন, গণমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া ও স্থানীয় সংস্কৃতির প্রভাবও সমানভাবে দায়ী। বিশেষ করে শহরের বস্তি বা নিম্নআয়ের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়, যেখানে গালিগালাজ বা স্ল্যাং দৈনন্দিন ভাষার অংশ, সেখানকার শিশু ও কিশোররা দ্রুত এই ভাষা শিখে ফেলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের ভাষায়, “এটি ‘লোকাল কালচারাল নরমালাইজেশন’—যেখানে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে একটি অভ্যাস এতটাই স্বাভাবিক হয়ে যায় যে, নতুন প্রজন্ম তা কোনো দ্বিধা ছাড়াই ব্যবহার করে।”

 

মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

ড. সেলিনা পারভীন বলেন, “স্ল্যাং বা অশালীন শ্লোগান ব্যবহার অনেক সময় একটি ‘গ্রুপ আইডেন্টিটি’ বা দলের সঙ্গে একাত্মতার প্রকাশ। বিশেষ করে বিক্ষোভ বা মিছিলে, যেখানে আবেগ ও উত্তেজনা বেশি, সেখানে যুবকরা এমন ভাষা ব্যবহার করে যা তাদের সহপাঠীদের কাছে সাহসী বা মজার মনে হতে পারে। কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদে ভাষাগত অবক্ষয় ও সামাজিক সহনশীলতার হ্রাস ঘটায়।”

সমাধানের পথ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাষা ও নৈতিক শিক্ষা জোরদার করা।
পরিবারের মধ্যে শিশুদের ভাষা ব্যবহারে সচেতনতা ও নজরদারি বাড়ানো।
মিডিয়ায় অশালীন ভাষা ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ ও বিকল্প ইতিবাচক ভাষার প্রচার।
স্থানীয় কমিউনিটি পর্যায়ে সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলা-ভিত্তিক কার্যক্রমের মাধ্যমে ভাষা ও আচরণ

সামাজিক সংস্কৃতির উন্নয়ন

শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্ল্যাংকে শ্লোগান হিসেবে ব্যবহার কেবল নিম্নআয়ের বা বস্তির পরিবেশ থেকে আসা শিশুদের সমস্যা নয়—এটি সমাজের সব শ্রেণিতেই প্রবেশ করেছে। পারিবারিক শৃঙ্খলা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলতা ও সামাজিক সংস্কৃতির উন্নয়ন ছাড়া এই প্রবণতা কমানো সম্ভব নয়।

জনপ্রিয় সংবাদ

শিক্ষার্থীদের শ্লোগানে অশালীন স্ল্যাং: শিক্ষার অভাব নাকি পারিবারিক পরিবেশের প্রভাব?

০৫:০০:৪৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১০ অগাস্ট ২০২৫

সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ছাত্রছাত্রী মিছিলে বা প্রতিবাদে অশালীন স্ল্যাং শব্দকে শ্লোগান হিসেবে ব্যবহার করছে। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে—এটি কি মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা, নাকি পারিবারিক পরিবেশের প্রভাব? নাকি উভয় ক্ষেত্রের সমন্বিত ফল? সমাজবিজ্ঞানী ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রবণতা কেবল ভাষাগত সমস্যা নয়, বরং এটি শিক্ষাগত ঘাটতি, পারিবারিক শৃঙ্খলার অভাব ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের এক জটিল প্রতিফলন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের  একজন অধ্যাপক বলেন, “যখন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাত্রছাত্রীদের ভদ্র ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার পরিবেশ দিতে ব্যর্থ হয়, তখন তাদের ভাষা ব্যবহারে ও আচরণে নেতিবাচকতা দেখা দেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু পাঠ্যপুস্তক জ্ঞান নয়—নৈতিক শিক্ষা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও ভাষা-আচরণের মানসিকতা গড়ে তুলতেও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।”

তার মতে, অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকর্মীরা এই ধরনের স্ল্যাং ব্যবহারের বিষয়ে উদাসীন, যা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

পারিবারিক প্রভাব

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. সেলিনা পারভীন বলেন, “শিশুর ভাষা শেখা শুরু হয় পরিবার থেকে। যদি বাবা-মা বা অভিভাবকরা ঘরে অশালীন শব্দ ব্যবহার করেন, বা সন্তানকে সঠিক ভাষা ব্যবহারে উৎসাহিত না করেন, তবে সেই প্রভাব বাইরে গিয়ে বেড়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে নিম্নআয়ের পরিবারে, যেখানে বাবা-মা সারাদিন কাজ করেন, সন্তানের ভাষা শেখার প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে।”

তবে তিনি স্পষ্ট করেন, নিম্নআয়ের পরিবার মানেই খারাপ ভাষা শেখা নয়—বরং যেসব পরিবারে শিশুদের পর্যাপ্ত সময় ও সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়, সেখানে এই সমস্যা অনেক কম।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট

সামাজিক গবেষকরা মনে করেন, গণমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া ও স্থানীয় সংস্কৃতির প্রভাবও সমানভাবে দায়ী। বিশেষ করে শহরের বস্তি বা নিম্নআয়ের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়, যেখানে গালিগালাজ বা স্ল্যাং দৈনন্দিন ভাষার অংশ, সেখানকার শিশু ও কিশোররা দ্রুত এই ভাষা শিখে ফেলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের ভাষায়, “এটি ‘লোকাল কালচারাল নরমালাইজেশন’—যেখানে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে একটি অভ্যাস এতটাই স্বাভাবিক হয়ে যায় যে, নতুন প্রজন্ম তা কোনো দ্বিধা ছাড়াই ব্যবহার করে।”

 

মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

ড. সেলিনা পারভীন বলেন, “স্ল্যাং বা অশালীন শ্লোগান ব্যবহার অনেক সময় একটি ‘গ্রুপ আইডেন্টিটি’ বা দলের সঙ্গে একাত্মতার প্রকাশ। বিশেষ করে বিক্ষোভ বা মিছিলে, যেখানে আবেগ ও উত্তেজনা বেশি, সেখানে যুবকরা এমন ভাষা ব্যবহার করে যা তাদের সহপাঠীদের কাছে সাহসী বা মজার মনে হতে পারে। কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদে ভাষাগত অবক্ষয় ও সামাজিক সহনশীলতার হ্রাস ঘটায়।”

সমাধানের পথ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাষা ও নৈতিক শিক্ষা জোরদার করা।
পরিবারের মধ্যে শিশুদের ভাষা ব্যবহারে সচেতনতা ও নজরদারি বাড়ানো।
মিডিয়ায় অশালীন ভাষা ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ ও বিকল্প ইতিবাচক ভাষার প্রচার।
স্থানীয় কমিউনিটি পর্যায়ে সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলা-ভিত্তিক কার্যক্রমের মাধ্যমে ভাষা ও আচরণ

সামাজিক সংস্কৃতির উন্নয়ন

শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্ল্যাংকে শ্লোগান হিসেবে ব্যবহার কেবল নিম্নআয়ের বা বস্তির পরিবেশ থেকে আসা শিশুদের সমস্যা নয়—এটি সমাজের সব শ্রেণিতেই প্রবেশ করেছে। পারিবারিক শৃঙ্খলা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলতা ও সামাজিক সংস্কৃতির উন্নয়ন ছাড়া এই প্রবণতা কমানো সম্ভব নয়।