০২:৪৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫

মলয় সাহার মৃত্যু

  • মণীশ রায়
  • ০৮:০০:৪৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১০ অগাস্ট ২০২৫
  • 237

আজ ভোররাতে মলয় সাহা মারা গেলেন!

রোজ সকাল দশটার ভেতর গায়ে জবজবে সর্ষের তেল মেখে পাড়ার পুকুরে এপার-ওপার তোলপাড় করে সাঁতরে স্নান করা যাঁর নিত্য অভ্যেস, ষাট বছর বয়সেও যাঁর কোন রোগ-ব্যাধি বলতে নেই, যাঁকে সচরাচর কোন রিক্সা-ভ্যানে উঠতে দেখেনি এ শহরের কেউ, সারাক্ষণ হেঁটে চলার অভ্যেস যাঁর মজ্জাগত, সেই তিনি বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ বাতাসে মিশে গেলেন। ভাবা যায়?

স্ত্রী সরলা পাশেই ছিলেন। আর্থরাইটিসের কামড়ে রাতে ভালো ঘুম হয় না। এপাশ-ওপাশ করেন শুধু। মাথার ভেতর কিলবিল করে রাজ্যের বিক্ষিপ্ত অবাস্তব সব চিন্তা-ভাবনা।

পরপর তিন-তিনটি কন্যা অবিবাহিত থাকা সত্ত্বেও একটা ছেলের মুখ দেখার জন্য এখনও মন কাঁদে সরলার। কিছুতেই বয়সের বাস্তবতার কথা মনে থাকে না।

বরং অসহায় আফসোস আর অনুতাপে বর্ষার ভরা গাঙের মতো মনটা কানায় কানায় ভরে যায় এবং এক-একটি লম্বা সজল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এসব বিনিদ্র ফাঁকা একাকী সময় কাটে তাঁর! সহসা সরলার মনে হল, ঘুমের ভেতর ওর স্বামী মলয় যেন গোঙাচ্ছেন। ইদানীং প্রায়ই এরকম হয়। ঘুমের ভেতর কঁকিয়ে ওঠেন যখন-তখন।

হাত দিয়ে ধাক্কা লাগিয়ে সেই দুঃস্বপ্নের জাল ছিঁড়তে হয় তাঁর। সেভাবেই প্রথমে চেষ্টা করলেন সরলা। কিন্তু মলয়ের শরীরে হাত দিতেই তিনি চমকে উঠলেন। ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়াতেই ঘামে শরীর জবজবে; যেন কেউ এক বালতি জল ঢেলে দিয়েছে শরীরের উপর। মুখ দিয়ে একটানা গোঁ-গোঁ শব্দ বেরোচ্ছে আর ডান হাতটা নিজের অগোচরে গলা চেপে ধরতে চাইছে। সরলার কয়েক সেকেণ্ডের বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতে দুটো হেঁচকি উঠল মলয়ের। তারপর সব চুপচাপ। জঙ্গলের সুনসান নীরবতার মতো এক ভৌতিক নিস্পন্দ নিশি-আবহ! সরলা চমকে ওঠেন এক অজানা ভয়ে। পাগলিনীর মতো কখনও নাকের নিচে আঙুল দিয়ে নিশ্বাস পরখ করেন, কখনও স্বামীর মাথা ধরে ঝাঁকাতে শুরু করেন। কিছুতেই কোন সাড়া মিলছে না মলয়ের। সহসা গায়ের জোরে চিৎকার করে ওঠেন তিনি, ‘ওগো তুমি কই গেলা গো?

কতা কও না কেরে? কতা কও?’ পাশের ঘরে একটাই বড় সাইজের খাট। কঙ্কাবতি, অবন্তিকা আর লীলাবতী শোয় সেই খাটে। সরকারি ছুটি থাকায় তিন বোন কদিন ধরে একসঙ্গে রয়েছে। হাসি-তামাশা আর রঙ্গে ঘর ভরপুর। রাত দেড়টা-দুটো পর্যন্ত জেগে থেকে মোবাইল চালায় তিন বোন মিলে। তারপর নিজেদের অজান্তে একসময় ঘুমে ঢলে পড়ে।

ঘুম ভাঙে দুপুর হলে। বিন্দাস সময় কাটছে ওদের। হঠাৎ মায়ের চিৎকার শুনে ওরা তিনজনই তড়িঘড়ি করে ছুটে আসে বড় ঘরে। লাইট জ্বালিয়ে সন্দেহভরা চোখে মশারির ভেতর কাত হয়ে শুয়ে থাকা বাবার দিকে তাকায়। মেডিক্যালে পড়া বড় মেয়ে কঙ্কাবতী সবার আগে নাড়ি ধরে প্রাণের ইশারা বোঝার চেষ্টা করে। চোখে-মুখে ফুটে ওঠে বিস্ময় আর হতাশা। তারপর মায়ের মতই আর্তনাদ করে ওঠে,’ মা, বাবা আর নাই।’ ছোট্ট মফস্বল শহর এই মন্মথপুর। দেখতে দেখতে পুরো শহর জুড়ে ছড়িয়ে গেল, মলয় মাস্টার আর নেই, তিনি মারা গেছেন। এককালে স্থানীয় কালীবাড়ির প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। রামকৃষ্ণ আশ্রমের ছিলেন সেক্রেটারি।

শিক্ষক হিসাবেও তিনি ছিলেন সফল। দু-দুবার সরকারী পুরস্কার মিলেছে তাঁর ভাগ্যে। সেই হিসাবে এলাকার সবচেয়ে নন্দিত শিক্ষক হলেন স্থানীয় বেসরকারি মডেল স্কুলের মলয় সাহা। ছাত্ররা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পাঠ মাথায় না ঢুকলে তিনি ছাত্রদের অহেতুক ক্লাসে অপমান করতেন না। বরং বাসায় ডেকে নিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে তাদের গড়ে তুলতে চাইতেন। গরীব ছাত্রদের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ দরদ। কখনও উপযাজক হয়ে বৃত্তির ব্যবস্থা করা কিংবা কখনও নিজের টাকায় বই-খাতা কিনে দিয়ে ওদের সাহায্য করা ছিল তাঁর নিত্যদিনের গল্প। কিন্তু নিজের জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে কখনোই ট্যুইশনি-নির্ভর মাস্টারমশাই সাজেননি। এজন্য কোন আফসোস নেই তাঁর মনে।

বরং অনির্বচনীয় এক আনন্দে বুঁদ হয়ে থাকতেন সারাক্ষণ। হাসিখুশি সুদর্শন সদানন্দ এক মানুষ। তাঁরই নাম মলয় সাহা। এ বিষয়ে গড়পরতা অন্য শিক্ষকদের হিংসা মাখানো গোপন মন্তব্য হল এইডা হইলো মলয়বাবুর গোঁ। ভাবসাবও কইতে পারেন। বাপ-দাদায় কাড়ি কাড়ি সম্পদ রাইখ্যা গেছে তো। তাই এগুলান কইরা নাম কামাইতে পারে। হইতো আমরার মতন নুন আনতে পান্তা ফুরাইন্যা গরিব শিক্ষক, তয় মজা বুঝতো। এইসব ভগিচগি কবেই গুহ্যদ্বার দিয়া পেটে ঢুইক্যা পড়তো, বুঝলা?

করুক, আমরা দেহি, কত নবঢং করতে পারে। দেহি।’ বলে নিরূপায় পরাজিতের মতো নিজেদের ভেতর গভীর এক দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখতেন অন্য শিক্ষকেরা।

এ নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত রয়েছে ছোট এই শহরে। সত্যি বলতে কি, মলয় মাস্টার সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে গল্পটি এসেই পড়ে। না এসে পারে না। কেননা, গল্পটি বলা ছাড়া মলয় মাস্টারের চরিত্রটি এযুগে কিছুতেই বিশ্বস্ততার সাথে বোঝানো যাবে না সাধারণ পাঠককে।

বিরাশি সনে একবার এসডিও ফরহাদ সাহেব তাঁর দুই কন্যার পাঠদানের জন্য মলয় মাস্টারকে নিয়োগ দিতে চাইলেন। উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এবং নানারকম ফুল-ফলের গাছের ছায়ায় আবৃত এসডিও সাহেবের বিশালাকৃতির রহস্যময় বাংলোয় গিয়ে পড়ানোর প্রস্তাব। কিন্তু মলয়বাবু রাজি হলেন না। তিনি এসডিও সাহেবের সঙ্গে অফিসে দেখা করে বলে এলেন, ‘স্যার, আমি ট্যুইশনি করি না।

যদি একান্তই আবশ্যক মনে করেন তবে আপনার দুটি কন্যাকে আমার বাড়ি পাঠিয়ে দিন। আমি যথাসাধ্য ওদের নিজের কন্যাজ্ঞানে পাঠদান করতে চেষ্টা করব। এর বিনিময়ে আমাকে কোন পারিতোষিক সাধবেন না। তাহলে শিক্ষক হিসাবে আমি অপমানিত বোধ করবো, স্যার।’

উত্তর শুনে পোড় খাওয়া এসডিও সাহেব অবাক চোখে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। শিক্ষিত পড়াশুনো জানা মানুষ তিনি, বইর ভাষায় বলা কথাগুলো হজম করতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে তাঁর।

যেসময়ে সর্বগ্রাসী উচ্চাশা টুটি চেপে ধরছে সবার, যখন মুখোশের আড়ালে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের অট্টহাসি হাসছেন শ্রদ্ধেয়রা, সেখানে ক্ষুদ্র এক মফস্বল শহরের অকিঞ্চিৎকর মানুষেরা এখনও উনবিংশ শতকের বস্তাপচা এসব আদর্শবাদকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে সসম্মানে? ভবিষ্যতের গভীর অন্ধকারে গাড়িচাপায় বেমক্কা প্রাণটা যাবে না তো?

পরক্ষণে মনে হল, এসব ভান নয়তো? প্রশ্নভরা কৌতূহল নীরবে থেকে গেল এসডিও সাহেবের মনের ভেতর। বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন, জ্বি। তাই হবে স্যার। তবু আপনিই পড়ান। এখানে আসার পর আপনার অনেক সুনাম শুনেছি।’ বলে ফের একবার বিস্মিত চোখে মলয় মাস্টারকে পরখ করে নিলেন। তারপর এসডিও সাহেব যতদিন এ মহকুমা শহরে ছিলেন ততদিন তাঁর আদরের দুই কন্যা রুম্পা-টুম্পা মলয় সাহার বাড়ি বয়ে পড়তে আসত।

সরলার হাতের পিঠা-পায়েসে ওরা আপ্যায়িত হত। পেয়ারা গাছের পেয়ারা, আমগাছের আম দিতেন ওদের গাড়িতে তুলে। এভাবেই একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল দুই অসম পরিবারের ভেতর। লক্ষ্মী, সরস্বতী আর দুর্গপুজোর সময় যত ব্যস্তই থাকুন না কেন, এসডিও সাহেব তাঁর পুরো পরিবার নিয়ে একবার ঘুরে যেতেন ওদের বাড়ি। লুচি, মিষ্টি আর বাঁধাকপির তরকারি ছিল ওদের প্রিয় খাবার। সরলা পরম মমতায় পরিবেশন করতেন সব। একইভাবে রমজানের ঈদে ওদের দাওয়াত থাকত এসডিও সাহেবের বাংলোয়। গাড়ি এসে নিয়ে যেত পরিবারের সবাইকে। এসডিও সাহেবের স্ত্রী রোখসানা ম্যাডাম নিজ হাতে পরিবেশন করে খাওয়াতেন ওদের।

শ্বেতপাথরের ডাইনিং-টেবিলে বসে চিনা মাটির বাসন-কোশনে চামচ দিয়ে খাওয়ার অভিজ্ঞতা সেই প্রথম। সরলাদের বাড়িতে তখনও কাঁসরের থালা-বাটি আর পিড়িতে বসে হাত দিয়ে খাওয়ার চল। ওদের পাতে যখন পোলাও-মাংস-কোপ্তা-জর্দা-সেমাই বেড়ে দিতেন অপরূপ সুন্দরী এই মহিলা তখন সরলা অপলক চোখে তাকিয়ে থাকতেন মহিলার দিকে। কোন তুলনা খুঁজে পেতেন না নিরহঙ্কার সুন্দরী এই মহিলার। গাড়ি করে বাড়ি ফেরার পর এই ঘোর সহজে আর কাটতে চাইত না সরলার। ঘুরেফিরে একই কথা পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয় পরিজনের কাছে বলে আনন্দে ভাসতে চাইতেন। ‘একটা ফুলের গাছ দেখলাম গো, এমন ফুল জীবনেও দেহি নাই।

মা গো মা।’ কিংবা ‘শ্বেতপাথরের টেবিলে দিছে খাওন। চিনামাডির বাসন, কাডা চামুইচ ইতা দিয়া নি আমরা খাইতে পারি কও? পরে লজ্জাশরমের মাতা খাইয়া হাত দিয়াই সাইরা লাইছি। কিছু মনে করলে করুক গা।’ এভাবে সপ্তাহভর অনর্গল এসব গল্প চলত সরলার মুখে। গালে হাত দেয়া মহিলারা অবাক বিস্ময়ে সেসব কথা নীরবে শুনে গেলেও ভেতরে ভেতরে ঈর্ষার সুড়সুড়ি থেকে থোড়াই রেহাই পেতেন। এভাবেই চলছিল। হঠাৎ একদিন মলয় সাহাকে স্কুল থেকে এসডিও সাহেবের অফিসে ডেকে নিয়ে তিনি সরাসরি বলে ফেলেন ‘আপনার মূল্যবান সময় নেবার জন্য দুঃখিত স্যার। আপনি তো জানেন রুম্পা-টুম্পার মেট্রিক পরীক্ষা কদিন বাদে।

ওরা তো আপনারই ছাত্রী। আপনি যেখানে ইনভিজিলেটর সেখানেই ওদের সীট পড়েছে। যদি আপনি ওদের সাহায্য করেন তবে আপনার গাধা ছাত্রী দুটো উতরে যেতে পারে ভালভাবে। আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব সেজন্য।’ বিনয়ের সঙ্গে নকল সাপ্লাইয়ের কথা জানিয়ে দিলেন তিনি। মলয় সাহার চোখের সামনে কাচ দেয়া বিশাল এক টেবিল। এসডিও সাহেবের বসার চেয়ারটিও রাজকীয়। বিশাল কক্ষে তাঁকে রাজার মতোই দেখাচ্ছে। তাকালেই কুর্নিশ জানানোর ইচ্ছে জাগে। কিন্তু ওর বেলায় সেরকম কিছু হল না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে নরোম গলায় উত্তর দিলেন, ‘আমি একটু ভেবে জানাই স্যার?’ ‘অবশ্যই।’ বলে চা-সিঙাড়া খাইয়ে মলয় সাহাকে নিজের আসন ছেড়ে উঠে দরজা অবধি এগিয়ে দিলেন তিনি। যাওয়ার সময় ফিসফিস করে বললেন, ‘স্যার এটা কারো সঙ্গে শেয়ার করবেন না প্লিজ।

এটি একজন পিতার আর্তি হিসাবেই নেবেন।’ ‘ঠিকাছে স্যার।’ মলয় ফিরে এলেন বাড়ি। দুদিন সময় নিয়ে ভাবলেন কিছু একটা। সরলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এসডিওর অফিস থেকে ফিইরা অমন গান্দামুখ কইরা রইছো কেরে? কিছু অইছে? খারাপ কিছু?’ ‘কি অইবো আবার?’ কানে ভাসে বিনয়ে মুড়ানো এসডিও সাহেবের কঠিন নির্দেশের কথা। পুরো ব্যাপারটাই যে তাঁর পরিকল্পনা, তাতে কোন সন্দেহ নেই মলয়ের। মহকুমা শহরের হর্তা-কর্তা তিনি। তাঁর এক ইশারায় অনেককিছু ঘটে যেতে পারে এ শহরে। কন্যাদের বেলায় তিনি হয়তো সেই ক্ষমতাই খাটাতে চেয়েছেন।

সরলা ফের তাড়া দেন, ‘কি অইল তোমার? উত্তর দিলা না যে?’

‘অত বকবক কইরো না। রান্না কর গিয়া।’

সহসা ধমক দিয়ে সরলাকে সরিয়ে দিতে চাইলেন চোখের সামনে থেকে। ‘কইলেও রাজুম, না কইলেও রাক্কুম। কপালডাই রাব্ন্দন আর পুলামাইয়ার মনযুগানের।’

গজগজ করতে করতে বড়ঘর থেকে বের হয়ে উঠোনের একপাশে পাতিটিনের তৈরি রান্নাঘরে ঢুকে পড়েন নিরূপায় সরলা। মাটির চুলায় লাকড়িতে আগুন ধরিয়ে চোঙ দিয়ে ফুঁ দিতে থাকেন একনাগাড়ে। চোখ লাল করমচা হয়ে ওঠে ধোঁয়ায়। তবু রাঁধতে হবে। না রেঁধে উপায় কি?

মলয় সাহা কিছুক্ষণ শুয়েছিলেন মাথার নিচে হাত দিয়ে। সহসা কী মনে করে শরীরে পাজামার উপর ফতোয়া চড়িয়ে পৌঁছে গেলেন স্কুলে। হেসমাস্টারের রুমে গিয়ে তাঁকে সরাসরি মলয় সাহা বলে ওঠেন, ‘স্যার, আমার শরীরটা ভালা নাই। এইবার ইনভিজিলেটারশিপ থেকে আমায় মুক্তি দিতে হবে।’ সঙ্গে সঙ্গে হায়-হায় করে ওঠেন হেডমাস্টার। মলয় সাহার পরীক্ষায় ইনভিজিলেটর হিসাবে দায়িত্ব পালনের প্রস্তাবটি এসডিও সাহেবের নির্দেশে স্কুল-কমিটিতে সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন পায়।

এ অবস্থায় সিদ্ধান্ত কিভাবে নড়চড় হবে? তাতে তো হেডমাস্টারের চাকরিটাই থাকবে না। ‘এটা হবে না মলয়বাবু। এসডিও সাহেবের সিদ্ধান্ত এটি। আমি কিভাবে এর ব্যত্যয় ঘটাই বলুন? আপনি তো এসডিও সাহেবের প্রিয় শিক্ষক। আপনিই না হয় উনাকে বলে দিন।’ ‘অসুস্থ হলে কি করবো বলুন স্যার? আপনি আমার বদলে ঠাকুর দাস স্যারকে দায়িত্বটা দিয়ে দিন। আমি একটা এ্যাপ্লিকেশন দিয়ে দিচ্ছি।’ অনমনীয় গলায় বলে ওঠেন তিনি। হেডমাস্টার সাহেব অনেক্ষণ কী যেন চিন্তা করলেন। মুখে বললেন, ‘দেখি কী করতে পারি। একটা এপ্লিক্যাশন দিয়ে দিন।’ চেহারায় চিন্তার ভাঁজ। এঘটনার পর এসডিও সাহেবের সঙ্গে মলয় মাস্টারের সম্পর্ক শীতল হতে শুরু করে। হেডমাস্টার তো ওকে বলেই বসলেন একদিন,’ এত গৌ ভাল না, মলয়বাবু। একটুখানি ফ্লেক্সিবল হলে কার কি যায় আসে তাতে বলুন?’

একথার কোন উত্তর না দিয়ে মলয়বাবু বেরিয়ে যান তাঁর কক্ষ থেকে। হেডমাস্টার সাহেব অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন মলয় সাহার দিকে। ভাবেন, চাইলেই এ লোকটা ট্যুইশনি করে কাড়ি-কাড়ি টাকা কামাতে পারেন; তা না করে বাপদাদার জমি বেচে খান। তবু ট্যুইশনি করতে রাজি নন। তাতে নাকি শিক্ষকের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়। আশ্চর্য! এর নামই কি আদর্শ। মানসিক এক আনন্দ ছাড়া আর কি দেয় এটি?

প্রশ্নটি মনের ভেতর পুষে রাখেন তিনি। বাড়ির ভেতর সরলার কৌতূহল আর থামে না। সুযোগ পেলেই বলে ওঠেন, রুম্পা-টুম্পা দি আর আয়ে না। কারণ ডা কিতা গো। কিছু নিয়া কি বাজছে তোমার লগে?’

‘জানি না।’ বলে সেখান থেকে সরে যান মলয় সাহা। এড়িয়ে চলেন স্ত্রীকে। মাঝে মাঝে নিজের ভেতর একরকমের শঙ্কাবোধ কাজ করে। শেষমেষ ওকে অপমান করে বসবে না তো এসডিও সাহেব? মডেল স্কুল থেকে চাকরিচ্যুতিকে ওর ভয় নেই। যত ভয় অপমানের। ছয়পুরুষের এ শহরে এত সম্মান ও সম্ভ্রমের সঙ্গে জীবন যাপনের পর যদি কোন প্রভাবশালী ক্ষমতাধর মানুষ সেসব কেড়ে নিতে চায়?

ভাবতেই কুঁকড়ে যান তিনি। কেমন অসহায় আর নিঃসঙ্গ লাগে নিজেকে। কিন্তু তাঁর এই সংগোপন আশঙ্কা মোটেই বাস্তবে রূপ পায়নি। এসডিও সাহেব মাস তিনেকের ভেতর বদলি হয়ে যান। যাওয়ার আগে লিখিতভাবে ওদের মডেল স্কুলের কমিটিকে লিখে দিয়ে যান, মলয় সাহা একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান শিক্ষকের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁর মতো নির্ভীক ও সদাচারী শিক্ষক প্রতিটি স্কুলে থাকলে এদেশের চেহারা পাল্টে যেতো। এ প্রজন্মের নিকট এঁদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করুন।’

লিখেছেন বটে। কিন্তু বিদায়বেলায় তিনি দেখা করার কোনপ্রকার আগ্রহ প্রকাশ করেননি ওর সঙ্গে। একি লজ্জা নাকি অন্যকিছু তা মলয় মাস্টার জানেন না। তবে রুম্পা-টুম্পা থার্ড-ডিভিশনে এসএসসি পাস করায় মনটা ওর বড় টনটন করে ওঠে ওদের জন্য। শিক্ষক হিসাবে তাহলে তিনি কি ব্যর্থ? তবু সেই সম্মাননাপত্রটি সযত্নে বাঁধানো হল এবং মলয় সাহার শোয়ার ঘরের দেয়ালে বড় যত্নের সঙ্গে টানানো হল সেটি। যেন ঘুমানোর আগে কিংবা পরে কথাকয়টি প্রতিদিন ওর চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে বালিশে মাথা দিয়ে তিনি পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকতেন পুরনো হওয়া লালচে এই মানপত্রটির দিকে। অক্ষরগুলো ওকে উৎসাহ জোগাত।

বিড়বিড় করেন আপনমনে ওদের সঙ্গে কথা বলতেন তিনি। একরাশ ফাগুন হাওয়ার মত মনটা গর্ব ও প্রশান্তিতে ভরে যেত। সেই মলয় মাস্টার সব শূন্য করে দিয়ে অকালে সুতোর ওপারে চলে গেলেন। এমন সদা চঞ্চল কর্মঠ হাসি-খুশি মানুষটির দেহকাণ্ডটি নিরব-নিথর হয়ে সরলার চোখের সামনে পড়ে রয়েছে এখন। পুব আকাশে আলো ফুটতে না ফুটতেই সরলা কেন যেন ভেবে নিয়েছিলেন, মানুষটির মৃত্যুর খবর পেয়ে কাতারে কাতারে প্রিয় ছাত্র-জনতা জড়ো হবে তাঁকে শেষবারের মতো একবারটি দেখতে।

কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে দেখা গেল, সরলার চোখের সামনে জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর দুচারজন চেনা মুখ ছাড়া আর কেউ নেই। খুব রাগ হল ওর। এত ছাত্র তাঁর, কোথায় তারা?

পিঠাপিঠি বয়সের মেয়ে তিনটি মাকে প্রবোধ দিতে চেয়েও পারে না। নীরবে শুধু চোখের জল ফেলতে থাকে। বারবার মৃত্যুর আগে কদিন ধরে বাবার বিমর্ষ মুখখানা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। একসময় শ্মশানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিয়ে কূলব্রাহ্মণের সঙ্গে মেয়েদের বাকবিতণ্ডা শুরু হয়ে গেল। জ্যোষ্ঠ পুরুষ সন্তানের মুখাগ্নি করার বিধানকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চাইছে তিনবোন মিলে। শেষমেষ ঠিক হল, বড় কন্যা সিলেট মেডিক্যালের ইন্টার্নি করা কঙ্কাবতী মুখাগ্নি করবে বাবার।

বিষয়টা কিছু গুষ্টি-জ্ঞাতির পছন্দ না হওয়ায় মনের ভেতর নানারকম দোষারূপ নিয়ে চুপচাপ কেটে পড়েন। সরলা সবই বুঝতে পারেন। ওর একমাত্র ভরসা কেবল মেয়ে তিনটি। মেজকন্যা অবন্তিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ বর্ষের ছাত্রী। ভালো ফলাফল হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার পদে নিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সবার ছোট লীলাবতী এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে চেষ্টা করছে বাইরে চলে যাওয়ার। ট্যুইশন-ফির কথা উঠলেই মলয় সাহা উত্তর দিতেন, চিন্তা করিছ না মা।

শহরের অত বড় বাড়ি দিয়া কিতা করুম? অর্ধেকটা বেইচা দিলেই তোর কাম অয়ে যাবে। জমি-জেরাতও তো আছে কিছু। তুই এগিয়ে যা।’ সরলা এ নিয়ে কিছু বলতে গেলে মলয় সাহা উত্তর দিতেন, ‘ওরাই একদিন কথা কইবো।

জমি-সম্পত্তি কিছু নাগো কঙ্কার মা। মানুষই আসল কথা। আসল সম্পদ তো এরাই।’ বলে দেখিয়ে দিতেন মেয়েদের। মেয়েরা হাসত বাবার সঙ্গে। পুরনো কথা বারবার করে মনে পড়ছে সরলার। যত মনে পড়ছে তত বুকটা যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠছে। মাঝে মাঝে ওর বিলাপে চারপাশ গুমরে ওঠছে। বাড়ির গাছপালাগুলোও যেন স্তব্ধ হয়ে রয়েছে সেই শোকে।

খাওয়ার পর মলয় মাস্টার যে বিড়ালটিকে মাছের কাঁটাগুলো বিছিয়ে দিতেন সামনে, সেটি সরলার পাশে ল্যাজ গুটিয়ে বসে রয়েছে। মাঝে মাঝে সন্ন্যাসী ভাব ছেড়ে মলয় সাহার খাটিয়ার সামনে দিয়ে মিউ মিউ করে হেঁটে বেড়াচ্ছে। হয়তো ক্ষুধা লেগেছে, তাই। ওরা যখন গুটিকয় আত্মীয়-পরিজন সঙ্গে নিয়ে শবদেহসহ শশ্মশান ঘাটে পৌঁছালেন তখন সূর্য মাথার উপর।

বড় মেয়ে কঙ্কাবতীর দায়িত্ব বাবার মুখাগ্নি করার। একসময় দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। সেদিকে তাকিয়ে পরাজিতের যন্ত্রণাকাতর অশ্রু ঝরতে শুরু করে সরলার চোখ বেয়ে। মনে মনে ধিক্কার দিতে থাকেন এ পুঁতিগন্ধময় নষ্ট সমাজকে। সহসা তীব্র ঘৃণায় হাতে ধরা এসডিও সাহেবের সম্মাননাপত্রটি ছুঁড়ে ফেলে দিলেন আগুনের ভেতর। লেলিহান আগুনের শিখার ভেতর ফটফট শব্দ করে পুড়ছে স্বামীর হাড়-খুলি।

সেইসঙ্গে অতি নীরবে পুড়ে ছাই হচ্ছে মলয়ের প্রিয় শংসাপত্রটি আর মলয় মাস্টারের বুকের ভেতর জমে থাকা একরাশ দমবন্ধ অভিমান আর কষ্ট। ভাবতেই বারবার ডুকরে উঠছেন সরলা। বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠছে অসহ্য এক যন্ত্রণায়। ওদের পাশে সান্ত্বনা দেবারও কেউ নেই। সবাই মুখ লুকিয়েছে উটকো ঝামেলার ভয়ে।

যদি ক্ষমতাশালী ব্যক্তিটি মাইন্ড করেন, যদি অহেতুক কোন ঝঞ্ঝাটে জড়িয়ে পড়েন, সেই ভয়ে সবাই সিঁটিয়ে রয়েছেন গর্তের ভেতর। সবই বুঝতে পারছেন সরলা। চোখ বুজলেই ভাসে ভাইরাল হওয়া ভিডিও ক্লিপটি কান ধরে ওঠ-বস করা মলয় মাস্টারের অসহায় অপমানিত চেহারাখানা আর অন্তিম আর্তনাদ, বিশ্বাস কর কঙ্কার মা, ‘আমি নকল সাপ্লাই দিই নাই। আর কেউ না করুক, তুমি বিশ্বাস কইরো। আমি হার মানি নাই।’ বিকালে মলয়বিহীন শুন্য বাড়িতে ফেরার পর ওরা স্নান সেরে এলো চুলে বড় ঘরের মেঝেতে চুপচাপ বসে থাকে। সময় পাথর হয়ে ওদের কণ্ঠরোধ করে রাখে। নীরবতা ভাঙে বড় মেয়ে কঙ্কাবতী।

সে মায়ের কোলে মাথা রেখে বেদনার্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘মা, তুমি চিন্তা কইরো না। এই বাড়ি বিক্রি করে আমরা বিদেশে চলে যাবো। এখানে আর থাকতে ইচ্ছে করে না মা!’ সরলা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন মেয়ের দিকে। শেষ আশ্রয় হিসাবে অবন্তিকা আর লীলাবতীও আঁকড়ে ধরে ওদের মাকে। সহসা মেয়েদের সম্ভ্রম নিয়ে অজানা এক ভয়ে শিউরে ওঠে সরলার মন। পরক্ষণে কঠিন হয়ে ওঠে ওর চোয়াল। দুহাত দিয়ে গায়ের সমস্ত শক্তি জড়ো করে মেয়ে তিনটিকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠেন,’ না। আমরা এইখানেই থাকুম।

তোদের বাপ তো হার মানে নাই। তাইলে আমরা কেরে?’

অপরিচিত মায়ের মুখের দিকে অবাক বিস্ময়ে মেয়ে তিনটি তাকিয়ে থাকে।

আর কদিন পরই দূর্গা পুজো!

 

জনপ্রিয় সংবাদ

জেন জি এখন সুগন্ধি খুঁজছে

মলয় সাহার মৃত্যু

০৮:০০:৪৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১০ অগাস্ট ২০২৫

আজ ভোররাতে মলয় সাহা মারা গেলেন!

রোজ সকাল দশটার ভেতর গায়ে জবজবে সর্ষের তেল মেখে পাড়ার পুকুরে এপার-ওপার তোলপাড় করে সাঁতরে স্নান করা যাঁর নিত্য অভ্যেস, ষাট বছর বয়সেও যাঁর কোন রোগ-ব্যাধি বলতে নেই, যাঁকে সচরাচর কোন রিক্সা-ভ্যানে উঠতে দেখেনি এ শহরের কেউ, সারাক্ষণ হেঁটে চলার অভ্যেস যাঁর মজ্জাগত, সেই তিনি বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ বাতাসে মিশে গেলেন। ভাবা যায়?

স্ত্রী সরলা পাশেই ছিলেন। আর্থরাইটিসের কামড়ে রাতে ভালো ঘুম হয় না। এপাশ-ওপাশ করেন শুধু। মাথার ভেতর কিলবিল করে রাজ্যের বিক্ষিপ্ত অবাস্তব সব চিন্তা-ভাবনা।

পরপর তিন-তিনটি কন্যা অবিবাহিত থাকা সত্ত্বেও একটা ছেলের মুখ দেখার জন্য এখনও মন কাঁদে সরলার। কিছুতেই বয়সের বাস্তবতার কথা মনে থাকে না।

বরং অসহায় আফসোস আর অনুতাপে বর্ষার ভরা গাঙের মতো মনটা কানায় কানায় ভরে যায় এবং এক-একটি লম্বা সজল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এসব বিনিদ্র ফাঁকা একাকী সময় কাটে তাঁর! সহসা সরলার মনে হল, ঘুমের ভেতর ওর স্বামী মলয় যেন গোঙাচ্ছেন। ইদানীং প্রায়ই এরকম হয়। ঘুমের ভেতর কঁকিয়ে ওঠেন যখন-তখন।

হাত দিয়ে ধাক্কা লাগিয়ে সেই দুঃস্বপ্নের জাল ছিঁড়তে হয় তাঁর। সেভাবেই প্রথমে চেষ্টা করলেন সরলা। কিন্তু মলয়ের শরীরে হাত দিতেই তিনি চমকে উঠলেন। ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়াতেই ঘামে শরীর জবজবে; যেন কেউ এক বালতি জল ঢেলে দিয়েছে শরীরের উপর। মুখ দিয়ে একটানা গোঁ-গোঁ শব্দ বেরোচ্ছে আর ডান হাতটা নিজের অগোচরে গলা চেপে ধরতে চাইছে। সরলার কয়েক সেকেণ্ডের বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতে দুটো হেঁচকি উঠল মলয়ের। তারপর সব চুপচাপ। জঙ্গলের সুনসান নীরবতার মতো এক ভৌতিক নিস্পন্দ নিশি-আবহ! সরলা চমকে ওঠেন এক অজানা ভয়ে। পাগলিনীর মতো কখনও নাকের নিচে আঙুল দিয়ে নিশ্বাস পরখ করেন, কখনও স্বামীর মাথা ধরে ঝাঁকাতে শুরু করেন। কিছুতেই কোন সাড়া মিলছে না মলয়ের। সহসা গায়ের জোরে চিৎকার করে ওঠেন তিনি, ‘ওগো তুমি কই গেলা গো?

কতা কও না কেরে? কতা কও?’ পাশের ঘরে একটাই বড় সাইজের খাট। কঙ্কাবতি, অবন্তিকা আর লীলাবতী শোয় সেই খাটে। সরকারি ছুটি থাকায় তিন বোন কদিন ধরে একসঙ্গে রয়েছে। হাসি-তামাশা আর রঙ্গে ঘর ভরপুর। রাত দেড়টা-দুটো পর্যন্ত জেগে থেকে মোবাইল চালায় তিন বোন মিলে। তারপর নিজেদের অজান্তে একসময় ঘুমে ঢলে পড়ে।

ঘুম ভাঙে দুপুর হলে। বিন্দাস সময় কাটছে ওদের। হঠাৎ মায়ের চিৎকার শুনে ওরা তিনজনই তড়িঘড়ি করে ছুটে আসে বড় ঘরে। লাইট জ্বালিয়ে সন্দেহভরা চোখে মশারির ভেতর কাত হয়ে শুয়ে থাকা বাবার দিকে তাকায়। মেডিক্যালে পড়া বড় মেয়ে কঙ্কাবতী সবার আগে নাড়ি ধরে প্রাণের ইশারা বোঝার চেষ্টা করে। চোখে-মুখে ফুটে ওঠে বিস্ময় আর হতাশা। তারপর মায়ের মতই আর্তনাদ করে ওঠে,’ মা, বাবা আর নাই।’ ছোট্ট মফস্বল শহর এই মন্মথপুর। দেখতে দেখতে পুরো শহর জুড়ে ছড়িয়ে গেল, মলয় মাস্টার আর নেই, তিনি মারা গেছেন। এককালে স্থানীয় কালীবাড়ির প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। রামকৃষ্ণ আশ্রমের ছিলেন সেক্রেটারি।

শিক্ষক হিসাবেও তিনি ছিলেন সফল। দু-দুবার সরকারী পুরস্কার মিলেছে তাঁর ভাগ্যে। সেই হিসাবে এলাকার সবচেয়ে নন্দিত শিক্ষক হলেন স্থানীয় বেসরকারি মডেল স্কুলের মলয় সাহা। ছাত্ররা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পাঠ মাথায় না ঢুকলে তিনি ছাত্রদের অহেতুক ক্লাসে অপমান করতেন না। বরং বাসায় ডেকে নিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে তাদের গড়ে তুলতে চাইতেন। গরীব ছাত্রদের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ দরদ। কখনও উপযাজক হয়ে বৃত্তির ব্যবস্থা করা কিংবা কখনও নিজের টাকায় বই-খাতা কিনে দিয়ে ওদের সাহায্য করা ছিল তাঁর নিত্যদিনের গল্প। কিন্তু নিজের জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে কখনোই ট্যুইশনি-নির্ভর মাস্টারমশাই সাজেননি। এজন্য কোন আফসোস নেই তাঁর মনে।

বরং অনির্বচনীয় এক আনন্দে বুঁদ হয়ে থাকতেন সারাক্ষণ। হাসিখুশি সুদর্শন সদানন্দ এক মানুষ। তাঁরই নাম মলয় সাহা। এ বিষয়ে গড়পরতা অন্য শিক্ষকদের হিংসা মাখানো গোপন মন্তব্য হল এইডা হইলো মলয়বাবুর গোঁ। ভাবসাবও কইতে পারেন। বাপ-দাদায় কাড়ি কাড়ি সম্পদ রাইখ্যা গেছে তো। তাই এগুলান কইরা নাম কামাইতে পারে। হইতো আমরার মতন নুন আনতে পান্তা ফুরাইন্যা গরিব শিক্ষক, তয় মজা বুঝতো। এইসব ভগিচগি কবেই গুহ্যদ্বার দিয়া পেটে ঢুইক্যা পড়তো, বুঝলা?

করুক, আমরা দেহি, কত নবঢং করতে পারে। দেহি।’ বলে নিরূপায় পরাজিতের মতো নিজেদের ভেতর গভীর এক দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখতেন অন্য শিক্ষকেরা।

এ নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত রয়েছে ছোট এই শহরে। সত্যি বলতে কি, মলয় মাস্টার সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে গল্পটি এসেই পড়ে। না এসে পারে না। কেননা, গল্পটি বলা ছাড়া মলয় মাস্টারের চরিত্রটি এযুগে কিছুতেই বিশ্বস্ততার সাথে বোঝানো যাবে না সাধারণ পাঠককে।

বিরাশি সনে একবার এসডিও ফরহাদ সাহেব তাঁর দুই কন্যার পাঠদানের জন্য মলয় মাস্টারকে নিয়োগ দিতে চাইলেন। উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এবং নানারকম ফুল-ফলের গাছের ছায়ায় আবৃত এসডিও সাহেবের বিশালাকৃতির রহস্যময় বাংলোয় গিয়ে পড়ানোর প্রস্তাব। কিন্তু মলয়বাবু রাজি হলেন না। তিনি এসডিও সাহেবের সঙ্গে অফিসে দেখা করে বলে এলেন, ‘স্যার, আমি ট্যুইশনি করি না।

যদি একান্তই আবশ্যক মনে করেন তবে আপনার দুটি কন্যাকে আমার বাড়ি পাঠিয়ে দিন। আমি যথাসাধ্য ওদের নিজের কন্যাজ্ঞানে পাঠদান করতে চেষ্টা করব। এর বিনিময়ে আমাকে কোন পারিতোষিক সাধবেন না। তাহলে শিক্ষক হিসাবে আমি অপমানিত বোধ করবো, স্যার।’

উত্তর শুনে পোড় খাওয়া এসডিও সাহেব অবাক চোখে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। শিক্ষিত পড়াশুনো জানা মানুষ তিনি, বইর ভাষায় বলা কথাগুলো হজম করতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে তাঁর।

যেসময়ে সর্বগ্রাসী উচ্চাশা টুটি চেপে ধরছে সবার, যখন মুখোশের আড়ালে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের অট্টহাসি হাসছেন শ্রদ্ধেয়রা, সেখানে ক্ষুদ্র এক মফস্বল শহরের অকিঞ্চিৎকর মানুষেরা এখনও উনবিংশ শতকের বস্তাপচা এসব আদর্শবাদকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে সসম্মানে? ভবিষ্যতের গভীর অন্ধকারে গাড়িচাপায় বেমক্কা প্রাণটা যাবে না তো?

পরক্ষণে মনে হল, এসব ভান নয়তো? প্রশ্নভরা কৌতূহল নীরবে থেকে গেল এসডিও সাহেবের মনের ভেতর। বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন, জ্বি। তাই হবে স্যার। তবু আপনিই পড়ান। এখানে আসার পর আপনার অনেক সুনাম শুনেছি।’ বলে ফের একবার বিস্মিত চোখে মলয় মাস্টারকে পরখ করে নিলেন। তারপর এসডিও সাহেব যতদিন এ মহকুমা শহরে ছিলেন ততদিন তাঁর আদরের দুই কন্যা রুম্পা-টুম্পা মলয় সাহার বাড়ি বয়ে পড়তে আসত।

সরলার হাতের পিঠা-পায়েসে ওরা আপ্যায়িত হত। পেয়ারা গাছের পেয়ারা, আমগাছের আম দিতেন ওদের গাড়িতে তুলে। এভাবেই একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল দুই অসম পরিবারের ভেতর। লক্ষ্মী, সরস্বতী আর দুর্গপুজোর সময় যত ব্যস্তই থাকুন না কেন, এসডিও সাহেব তাঁর পুরো পরিবার নিয়ে একবার ঘুরে যেতেন ওদের বাড়ি। লুচি, মিষ্টি আর বাঁধাকপির তরকারি ছিল ওদের প্রিয় খাবার। সরলা পরম মমতায় পরিবেশন করতেন সব। একইভাবে রমজানের ঈদে ওদের দাওয়াত থাকত এসডিও সাহেবের বাংলোয়। গাড়ি এসে নিয়ে যেত পরিবারের সবাইকে। এসডিও সাহেবের স্ত্রী রোখসানা ম্যাডাম নিজ হাতে পরিবেশন করে খাওয়াতেন ওদের।

শ্বেতপাথরের ডাইনিং-টেবিলে বসে চিনা মাটির বাসন-কোশনে চামচ দিয়ে খাওয়ার অভিজ্ঞতা সেই প্রথম। সরলাদের বাড়িতে তখনও কাঁসরের থালা-বাটি আর পিড়িতে বসে হাত দিয়ে খাওয়ার চল। ওদের পাতে যখন পোলাও-মাংস-কোপ্তা-জর্দা-সেমাই বেড়ে দিতেন অপরূপ সুন্দরী এই মহিলা তখন সরলা অপলক চোখে তাকিয়ে থাকতেন মহিলার দিকে। কোন তুলনা খুঁজে পেতেন না নিরহঙ্কার সুন্দরী এই মহিলার। গাড়ি করে বাড়ি ফেরার পর এই ঘোর সহজে আর কাটতে চাইত না সরলার। ঘুরেফিরে একই কথা পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয় পরিজনের কাছে বলে আনন্দে ভাসতে চাইতেন। ‘একটা ফুলের গাছ দেখলাম গো, এমন ফুল জীবনেও দেহি নাই।

মা গো মা।’ কিংবা ‘শ্বেতপাথরের টেবিলে দিছে খাওন। চিনামাডির বাসন, কাডা চামুইচ ইতা দিয়া নি আমরা খাইতে পারি কও? পরে লজ্জাশরমের মাতা খাইয়া হাত দিয়াই সাইরা লাইছি। কিছু মনে করলে করুক গা।’ এভাবে সপ্তাহভর অনর্গল এসব গল্প চলত সরলার মুখে। গালে হাত দেয়া মহিলারা অবাক বিস্ময়ে সেসব কথা নীরবে শুনে গেলেও ভেতরে ভেতরে ঈর্ষার সুড়সুড়ি থেকে থোড়াই রেহাই পেতেন। এভাবেই চলছিল। হঠাৎ একদিন মলয় সাহাকে স্কুল থেকে এসডিও সাহেবের অফিসে ডেকে নিয়ে তিনি সরাসরি বলে ফেলেন ‘আপনার মূল্যবান সময় নেবার জন্য দুঃখিত স্যার। আপনি তো জানেন রুম্পা-টুম্পার মেট্রিক পরীক্ষা কদিন বাদে।

ওরা তো আপনারই ছাত্রী। আপনি যেখানে ইনভিজিলেটর সেখানেই ওদের সীট পড়েছে। যদি আপনি ওদের সাহায্য করেন তবে আপনার গাধা ছাত্রী দুটো উতরে যেতে পারে ভালভাবে। আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব সেজন্য।’ বিনয়ের সঙ্গে নকল সাপ্লাইয়ের কথা জানিয়ে দিলেন তিনি। মলয় সাহার চোখের সামনে কাচ দেয়া বিশাল এক টেবিল। এসডিও সাহেবের বসার চেয়ারটিও রাজকীয়। বিশাল কক্ষে তাঁকে রাজার মতোই দেখাচ্ছে। তাকালেই কুর্নিশ জানানোর ইচ্ছে জাগে। কিন্তু ওর বেলায় সেরকম কিছু হল না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে নরোম গলায় উত্তর দিলেন, ‘আমি একটু ভেবে জানাই স্যার?’ ‘অবশ্যই।’ বলে চা-সিঙাড়া খাইয়ে মলয় সাহাকে নিজের আসন ছেড়ে উঠে দরজা অবধি এগিয়ে দিলেন তিনি। যাওয়ার সময় ফিসফিস করে বললেন, ‘স্যার এটা কারো সঙ্গে শেয়ার করবেন না প্লিজ।

এটি একজন পিতার আর্তি হিসাবেই নেবেন।’ ‘ঠিকাছে স্যার।’ মলয় ফিরে এলেন বাড়ি। দুদিন সময় নিয়ে ভাবলেন কিছু একটা। সরলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এসডিওর অফিস থেকে ফিইরা অমন গান্দামুখ কইরা রইছো কেরে? কিছু অইছে? খারাপ কিছু?’ ‘কি অইবো আবার?’ কানে ভাসে বিনয়ে মুড়ানো এসডিও সাহেবের কঠিন নির্দেশের কথা। পুরো ব্যাপারটাই যে তাঁর পরিকল্পনা, তাতে কোন সন্দেহ নেই মলয়ের। মহকুমা শহরের হর্তা-কর্তা তিনি। তাঁর এক ইশারায় অনেককিছু ঘটে যেতে পারে এ শহরে। কন্যাদের বেলায় তিনি হয়তো সেই ক্ষমতাই খাটাতে চেয়েছেন।

সরলা ফের তাড়া দেন, ‘কি অইল তোমার? উত্তর দিলা না যে?’

‘অত বকবক কইরো না। রান্না কর গিয়া।’

সহসা ধমক দিয়ে সরলাকে সরিয়ে দিতে চাইলেন চোখের সামনে থেকে। ‘কইলেও রাজুম, না কইলেও রাক্কুম। কপালডাই রাব্ন্দন আর পুলামাইয়ার মনযুগানের।’

গজগজ করতে করতে বড়ঘর থেকে বের হয়ে উঠোনের একপাশে পাতিটিনের তৈরি রান্নাঘরে ঢুকে পড়েন নিরূপায় সরলা। মাটির চুলায় লাকড়িতে আগুন ধরিয়ে চোঙ দিয়ে ফুঁ দিতে থাকেন একনাগাড়ে। চোখ লাল করমচা হয়ে ওঠে ধোঁয়ায়। তবু রাঁধতে হবে। না রেঁধে উপায় কি?

মলয় সাহা কিছুক্ষণ শুয়েছিলেন মাথার নিচে হাত দিয়ে। সহসা কী মনে করে শরীরে পাজামার উপর ফতোয়া চড়িয়ে পৌঁছে গেলেন স্কুলে। হেসমাস্টারের রুমে গিয়ে তাঁকে সরাসরি মলয় সাহা বলে ওঠেন, ‘স্যার, আমার শরীরটা ভালা নাই। এইবার ইনভিজিলেটারশিপ থেকে আমায় মুক্তি দিতে হবে।’ সঙ্গে সঙ্গে হায়-হায় করে ওঠেন হেডমাস্টার। মলয় সাহার পরীক্ষায় ইনভিজিলেটর হিসাবে দায়িত্ব পালনের প্রস্তাবটি এসডিও সাহেবের নির্দেশে স্কুল-কমিটিতে সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন পায়।

এ অবস্থায় সিদ্ধান্ত কিভাবে নড়চড় হবে? তাতে তো হেডমাস্টারের চাকরিটাই থাকবে না। ‘এটা হবে না মলয়বাবু। এসডিও সাহেবের সিদ্ধান্ত এটি। আমি কিভাবে এর ব্যত্যয় ঘটাই বলুন? আপনি তো এসডিও সাহেবের প্রিয় শিক্ষক। আপনিই না হয় উনাকে বলে দিন।’ ‘অসুস্থ হলে কি করবো বলুন স্যার? আপনি আমার বদলে ঠাকুর দাস স্যারকে দায়িত্বটা দিয়ে দিন। আমি একটা এ্যাপ্লিকেশন দিয়ে দিচ্ছি।’ অনমনীয় গলায় বলে ওঠেন তিনি। হেডমাস্টার সাহেব অনেক্ষণ কী যেন চিন্তা করলেন। মুখে বললেন, ‘দেখি কী করতে পারি। একটা এপ্লিক্যাশন দিয়ে দিন।’ চেহারায় চিন্তার ভাঁজ। এঘটনার পর এসডিও সাহেবের সঙ্গে মলয় মাস্টারের সম্পর্ক শীতল হতে শুরু করে। হেডমাস্টার তো ওকে বলেই বসলেন একদিন,’ এত গৌ ভাল না, মলয়বাবু। একটুখানি ফ্লেক্সিবল হলে কার কি যায় আসে তাতে বলুন?’

একথার কোন উত্তর না দিয়ে মলয়বাবু বেরিয়ে যান তাঁর কক্ষ থেকে। হেডমাস্টার সাহেব অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন মলয় সাহার দিকে। ভাবেন, চাইলেই এ লোকটা ট্যুইশনি করে কাড়ি-কাড়ি টাকা কামাতে পারেন; তা না করে বাপদাদার জমি বেচে খান। তবু ট্যুইশনি করতে রাজি নন। তাতে নাকি শিক্ষকের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়। আশ্চর্য! এর নামই কি আদর্শ। মানসিক এক আনন্দ ছাড়া আর কি দেয় এটি?

প্রশ্নটি মনের ভেতর পুষে রাখেন তিনি। বাড়ির ভেতর সরলার কৌতূহল আর থামে না। সুযোগ পেলেই বলে ওঠেন, রুম্পা-টুম্পা দি আর আয়ে না। কারণ ডা কিতা গো। কিছু নিয়া কি বাজছে তোমার লগে?’

‘জানি না।’ বলে সেখান থেকে সরে যান মলয় সাহা। এড়িয়ে চলেন স্ত্রীকে। মাঝে মাঝে নিজের ভেতর একরকমের শঙ্কাবোধ কাজ করে। শেষমেষ ওকে অপমান করে বসবে না তো এসডিও সাহেব? মডেল স্কুল থেকে চাকরিচ্যুতিকে ওর ভয় নেই। যত ভয় অপমানের। ছয়পুরুষের এ শহরে এত সম্মান ও সম্ভ্রমের সঙ্গে জীবন যাপনের পর যদি কোন প্রভাবশালী ক্ষমতাধর মানুষ সেসব কেড়ে নিতে চায়?

ভাবতেই কুঁকড়ে যান তিনি। কেমন অসহায় আর নিঃসঙ্গ লাগে নিজেকে। কিন্তু তাঁর এই সংগোপন আশঙ্কা মোটেই বাস্তবে রূপ পায়নি। এসডিও সাহেব মাস তিনেকের ভেতর বদলি হয়ে যান। যাওয়ার আগে লিখিতভাবে ওদের মডেল স্কুলের কমিটিকে লিখে দিয়ে যান, মলয় সাহা একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান শিক্ষকের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁর মতো নির্ভীক ও সদাচারী শিক্ষক প্রতিটি স্কুলে থাকলে এদেশের চেহারা পাল্টে যেতো। এ প্রজন্মের নিকট এঁদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করুন।’

লিখেছেন বটে। কিন্তু বিদায়বেলায় তিনি দেখা করার কোনপ্রকার আগ্রহ প্রকাশ করেননি ওর সঙ্গে। একি লজ্জা নাকি অন্যকিছু তা মলয় মাস্টার জানেন না। তবে রুম্পা-টুম্পা থার্ড-ডিভিশনে এসএসসি পাস করায় মনটা ওর বড় টনটন করে ওঠে ওদের জন্য। শিক্ষক হিসাবে তাহলে তিনি কি ব্যর্থ? তবু সেই সম্মাননাপত্রটি সযত্নে বাঁধানো হল এবং মলয় সাহার শোয়ার ঘরের দেয়ালে বড় যত্নের সঙ্গে টানানো হল সেটি। যেন ঘুমানোর আগে কিংবা পরে কথাকয়টি প্রতিদিন ওর চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে বালিশে মাথা দিয়ে তিনি পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকতেন পুরনো হওয়া লালচে এই মানপত্রটির দিকে। অক্ষরগুলো ওকে উৎসাহ জোগাত।

বিড়বিড় করেন আপনমনে ওদের সঙ্গে কথা বলতেন তিনি। একরাশ ফাগুন হাওয়ার মত মনটা গর্ব ও প্রশান্তিতে ভরে যেত। সেই মলয় মাস্টার সব শূন্য করে দিয়ে অকালে সুতোর ওপারে চলে গেলেন। এমন সদা চঞ্চল কর্মঠ হাসি-খুশি মানুষটির দেহকাণ্ডটি নিরব-নিথর হয়ে সরলার চোখের সামনে পড়ে রয়েছে এখন। পুব আকাশে আলো ফুটতে না ফুটতেই সরলা কেন যেন ভেবে নিয়েছিলেন, মানুষটির মৃত্যুর খবর পেয়ে কাতারে কাতারে প্রিয় ছাত্র-জনতা জড়ো হবে তাঁকে শেষবারের মতো একবারটি দেখতে।

কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে দেখা গেল, সরলার চোখের সামনে জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর দুচারজন চেনা মুখ ছাড়া আর কেউ নেই। খুব রাগ হল ওর। এত ছাত্র তাঁর, কোথায় তারা?

পিঠাপিঠি বয়সের মেয়ে তিনটি মাকে প্রবোধ দিতে চেয়েও পারে না। নীরবে শুধু চোখের জল ফেলতে থাকে। বারবার মৃত্যুর আগে কদিন ধরে বাবার বিমর্ষ মুখখানা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। একসময় শ্মশানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিয়ে কূলব্রাহ্মণের সঙ্গে মেয়েদের বাকবিতণ্ডা শুরু হয়ে গেল। জ্যোষ্ঠ পুরুষ সন্তানের মুখাগ্নি করার বিধানকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চাইছে তিনবোন মিলে। শেষমেষ ঠিক হল, বড় কন্যা সিলেট মেডিক্যালের ইন্টার্নি করা কঙ্কাবতী মুখাগ্নি করবে বাবার।

বিষয়টা কিছু গুষ্টি-জ্ঞাতির পছন্দ না হওয়ায় মনের ভেতর নানারকম দোষারূপ নিয়ে চুপচাপ কেটে পড়েন। সরলা সবই বুঝতে পারেন। ওর একমাত্র ভরসা কেবল মেয়ে তিনটি। মেজকন্যা অবন্তিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ বর্ষের ছাত্রী। ভালো ফলাফল হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার পদে নিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সবার ছোট লীলাবতী এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে চেষ্টা করছে বাইরে চলে যাওয়ার। ট্যুইশন-ফির কথা উঠলেই মলয় সাহা উত্তর দিতেন, চিন্তা করিছ না মা।

শহরের অত বড় বাড়ি দিয়া কিতা করুম? অর্ধেকটা বেইচা দিলেই তোর কাম অয়ে যাবে। জমি-জেরাতও তো আছে কিছু। তুই এগিয়ে যা।’ সরলা এ নিয়ে কিছু বলতে গেলে মলয় সাহা উত্তর দিতেন, ‘ওরাই একদিন কথা কইবো।

জমি-সম্পত্তি কিছু নাগো কঙ্কার মা। মানুষই আসল কথা। আসল সম্পদ তো এরাই।’ বলে দেখিয়ে দিতেন মেয়েদের। মেয়েরা হাসত বাবার সঙ্গে। পুরনো কথা বারবার করে মনে পড়ছে সরলার। যত মনে পড়ছে তত বুকটা যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠছে। মাঝে মাঝে ওর বিলাপে চারপাশ গুমরে ওঠছে। বাড়ির গাছপালাগুলোও যেন স্তব্ধ হয়ে রয়েছে সেই শোকে।

খাওয়ার পর মলয় মাস্টার যে বিড়ালটিকে মাছের কাঁটাগুলো বিছিয়ে দিতেন সামনে, সেটি সরলার পাশে ল্যাজ গুটিয়ে বসে রয়েছে। মাঝে মাঝে সন্ন্যাসী ভাব ছেড়ে মলয় সাহার খাটিয়ার সামনে দিয়ে মিউ মিউ করে হেঁটে বেড়াচ্ছে। হয়তো ক্ষুধা লেগেছে, তাই। ওরা যখন গুটিকয় আত্মীয়-পরিজন সঙ্গে নিয়ে শবদেহসহ শশ্মশান ঘাটে পৌঁছালেন তখন সূর্য মাথার উপর।

বড় মেয়ে কঙ্কাবতীর দায়িত্ব বাবার মুখাগ্নি করার। একসময় দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। সেদিকে তাকিয়ে পরাজিতের যন্ত্রণাকাতর অশ্রু ঝরতে শুরু করে সরলার চোখ বেয়ে। মনে মনে ধিক্কার দিতে থাকেন এ পুঁতিগন্ধময় নষ্ট সমাজকে। সহসা তীব্র ঘৃণায় হাতে ধরা এসডিও সাহেবের সম্মাননাপত্রটি ছুঁড়ে ফেলে দিলেন আগুনের ভেতর। লেলিহান আগুনের শিখার ভেতর ফটফট শব্দ করে পুড়ছে স্বামীর হাড়-খুলি।

সেইসঙ্গে অতি নীরবে পুড়ে ছাই হচ্ছে মলয়ের প্রিয় শংসাপত্রটি আর মলয় মাস্টারের বুকের ভেতর জমে থাকা একরাশ দমবন্ধ অভিমান আর কষ্ট। ভাবতেই বারবার ডুকরে উঠছেন সরলা। বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠছে অসহ্য এক যন্ত্রণায়। ওদের পাশে সান্ত্বনা দেবারও কেউ নেই। সবাই মুখ লুকিয়েছে উটকো ঝামেলার ভয়ে।

যদি ক্ষমতাশালী ব্যক্তিটি মাইন্ড করেন, যদি অহেতুক কোন ঝঞ্ঝাটে জড়িয়ে পড়েন, সেই ভয়ে সবাই সিঁটিয়ে রয়েছেন গর্তের ভেতর। সবই বুঝতে পারছেন সরলা। চোখ বুজলেই ভাসে ভাইরাল হওয়া ভিডিও ক্লিপটি কান ধরে ওঠ-বস করা মলয় মাস্টারের অসহায় অপমানিত চেহারাখানা আর অন্তিম আর্তনাদ, বিশ্বাস কর কঙ্কার মা, ‘আমি নকল সাপ্লাই দিই নাই। আর কেউ না করুক, তুমি বিশ্বাস কইরো। আমি হার মানি নাই।’ বিকালে মলয়বিহীন শুন্য বাড়িতে ফেরার পর ওরা স্নান সেরে এলো চুলে বড় ঘরের মেঝেতে চুপচাপ বসে থাকে। সময় পাথর হয়ে ওদের কণ্ঠরোধ করে রাখে। নীরবতা ভাঙে বড় মেয়ে কঙ্কাবতী।

সে মায়ের কোলে মাথা রেখে বেদনার্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘মা, তুমি চিন্তা কইরো না। এই বাড়ি বিক্রি করে আমরা বিদেশে চলে যাবো। এখানে আর থাকতে ইচ্ছে করে না মা!’ সরলা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন মেয়ের দিকে। শেষ আশ্রয় হিসাবে অবন্তিকা আর লীলাবতীও আঁকড়ে ধরে ওদের মাকে। সহসা মেয়েদের সম্ভ্রম নিয়ে অজানা এক ভয়ে শিউরে ওঠে সরলার মন। পরক্ষণে কঠিন হয়ে ওঠে ওর চোয়াল। দুহাত দিয়ে গায়ের সমস্ত শক্তি জড়ো করে মেয়ে তিনটিকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠেন,’ না। আমরা এইখানেই থাকুম।

তোদের বাপ তো হার মানে নাই। তাইলে আমরা কেরে?’

অপরিচিত মায়ের মুখের দিকে অবাক বিস্ময়ে মেয়ে তিনটি তাকিয়ে থাকে।

আর কদিন পরই দূর্গা পুজো!