০৭:৫২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

নোয়াখালীতে জলাবদ্ধতা: কৃষি, ব্যবসা ও মানুষের জীবনযাত্রায় স্থায়ী হুমকি

নোয়াখালীতে জলাবদ্ধতার চিরচেনা দুর্ভোগ

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী একদিকে প্রকৃতির দান, অন্যদিকে দুর্ভোগের ভার বহন করছে। বর্ষা এলেই জেলার নোয়াখালী সদর, বেগমগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ, সুবর্ণচর ও সেনবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা এখন নিয়মিত দৃশ্য। এ বছরও অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ও অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে বহু রাস্তা, বাজার, কৃষিজমি ও ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে গেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, আগে জলাবদ্ধতা মূলত প্রবল বর্ষণ বা নদীর ভাঙনের সময় দেখা দিত, কিন্তু এখন সামান্য বৃষ্টিতেই পানি জমে কয়েকদিন স্থায়ী হয়। এতে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ছে এবং কৃষি ও ব্যবসায় গুরুতর প্রভাব ফেলছে।

জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ

নোয়াখালীর জলাবদ্ধতার পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে—

দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থা: শহর ও গ্রামে অধিকাংশ ড্রেন অপরিকল্পিত ও ভরাট হয়ে গেছে। বহু বছর ধরে ড্রেন পরিস্কার করা হয়নি, ফলে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে থাকে।

নদ-নালা ও খালের ভরাট: কৃষিজমি ও বাসাবাড়ি তৈরির জন্য বছরের পর বছর ধরে খাল-নালা ভরাট করা হয়েছে। এতে প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে।

সামান্য বৃষ্টিতেই নোয়াখালীতে জলাবদ্ধতা, স্থায়ী সমাধান চান স্থানীয়রা

জোয়ারের প্রভাব: উপকূলীয় হওয়ায় জোয়ারের সময় নদীর পানি উল্টো দিকে উঠে এসে বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে জলাবদ্ধতা বাড়ায়।

জলবায়ু পরিবর্তন: বর্ষায় স্বল্প সময়ে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে, যা বিদ্যমান নিষ্কাশন ব্যবস্থায় সামলানো যাচ্ছে না।

ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা

নোয়াখালী সদরের রুহুল আমিন বলেন,
“চারদিন ধরে বাড়ির আঙিনায় হাঁটু সমান পানি। রান্না-বান্না, খাওয়া, বাইরে যাওয়া—সবই কষ্টকর হয়ে গেছে। বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারছে না।”

বেগমগঞ্জের ব্যবসায়ী সেলিম উদ্দিন জানান,
“বাজারে যাওয়ার রাস্তা ডুবে আছে, দোকানে পানি ঢুকে মাল নষ্ট হয়েছে। ক্ষতির বোঝা আমাদের কাঁধেই পড়ছে।”

কোম্পানীগঞ্জের কৃষক দেলোয়ার হোসেন বলেন,
“ধানের চারা রোপণ করেছি, কিন্তু জমিতে পানি জমে পচে যাচ্ছে। কৃষি অফিসে জানিয়েও কোনো সমাধান পাইনি।”

নোয়াখালীতে বৃষ্টিতে শহরে জলাবদ্ধতা, মাঠে বোরো ধানের ক্ষতি

কৃষি খাতে প্রভাব

নোয়াখালীর অর্থনীতির বড় অংশ কৃষিভিত্তিক। ধান, সবজি, পাট ও মাছচাষ এখানে প্রচলিত। জলাবদ্ধতায়—

  • • ধান ও সবজির জমি পানিতে ডুবে ফসল নষ্ট হয়।
  • • মাছের ঘের ভেসে গিয়ে চাষির বড় ক্ষতি হয়।
  • • দীর্ঘদিন পানি জমে থাকায় মাটির উর্বরতা কমে যায়।
  • • নতুন মৌসুমের চাষ বিলম্বিত হয়ে উৎপাদন হ্রাস পায়।

ব্যবসা ও জনজীবনের ক্ষতি

জলাবদ্ধতায় নোয়াখালীর বাজার ও পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পণ্য আনা-নেওয়ার পথ ডুবে গিয়ে—

  • • ব্যবসায়ীরা সময়মতো মাল আনতে বা পাঠাতে পারেন না।
  • • ক্রেতা কমে গিয়ে বিক্রি হ্রাস পায়।
  • • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিতি কমে যায়,কর্মজীবীরা দেরিতে অফিসে পৌঁছান।

রেকর্ড বৃষ্টিতে নোয়াখালী শহরে জলাবদ্ধতা, জনদুর্ভোগ চরমে

সমাধানের প্রস্তাব

বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘমেয়াদি ও পরিকল্পিত উদ্যোগই পারে জলাবদ্ধতার সমাধান দিতে—

ড্রেনেজ ব্যবস্থা সংস্কার ও আধুনিকায়ন।

প্রাকৃতিক খাল-নালা পুনঃখনন ও সংরক্ষণ।

জোয়ার-ভাটা নিয়ন্ত্রণে স্লুইস গেট নির্মাণ।

বর্ষার আগে নিয়মিত ড্রেন ও নিষ্কাশন পথ পরিষ্কার।

প্রশাসন ও স্থানীয় জনগণের যৌথ উদ্যোগ।

নোয়াখালীর জলাবদ্ধতা এখন আর মৌসুমি দুর্ভোগ নয়, বরং স্থায়ী সমস্যা। কৃষি, ব্যবসা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য—সবক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যতদিন টেকসই সমাধান বাস্তবায়ন না হবে, ততদিন প্রতি বর্ষায় এখানকার মানুষকে একই ভোগান্তি পোহাতে হবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

নোয়াখালীতে জলাবদ্ধতা: কৃষি, ব্যবসা ও মানুষের জীবনযাত্রায় স্থায়ী হুমকি

০৩:১৯:৩৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১১ অগাস্ট ২০২৫

নোয়াখালীতে জলাবদ্ধতার চিরচেনা দুর্ভোগ

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী একদিকে প্রকৃতির দান, অন্যদিকে দুর্ভোগের ভার বহন করছে। বর্ষা এলেই জেলার নোয়াখালী সদর, বেগমগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ, সুবর্ণচর ও সেনবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা এখন নিয়মিত দৃশ্য। এ বছরও অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ও অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে বহু রাস্তা, বাজার, কৃষিজমি ও ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে গেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, আগে জলাবদ্ধতা মূলত প্রবল বর্ষণ বা নদীর ভাঙনের সময় দেখা দিত, কিন্তু এখন সামান্য বৃষ্টিতেই পানি জমে কয়েকদিন স্থায়ী হয়। এতে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ছে এবং কৃষি ও ব্যবসায় গুরুতর প্রভাব ফেলছে।

জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ

নোয়াখালীর জলাবদ্ধতার পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে—

দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থা: শহর ও গ্রামে অধিকাংশ ড্রেন অপরিকল্পিত ও ভরাট হয়ে গেছে। বহু বছর ধরে ড্রেন পরিস্কার করা হয়নি, ফলে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে থাকে।

নদ-নালা ও খালের ভরাট: কৃষিজমি ও বাসাবাড়ি তৈরির জন্য বছরের পর বছর ধরে খাল-নালা ভরাট করা হয়েছে। এতে প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে।

সামান্য বৃষ্টিতেই নোয়াখালীতে জলাবদ্ধতা, স্থায়ী সমাধান চান স্থানীয়রা

জোয়ারের প্রভাব: উপকূলীয় হওয়ায় জোয়ারের সময় নদীর পানি উল্টো দিকে উঠে এসে বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে জলাবদ্ধতা বাড়ায়।

জলবায়ু পরিবর্তন: বর্ষায় স্বল্প সময়ে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে, যা বিদ্যমান নিষ্কাশন ব্যবস্থায় সামলানো যাচ্ছে না।

ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা

নোয়াখালী সদরের রুহুল আমিন বলেন,
“চারদিন ধরে বাড়ির আঙিনায় হাঁটু সমান পানি। রান্না-বান্না, খাওয়া, বাইরে যাওয়া—সবই কষ্টকর হয়ে গেছে। বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারছে না।”

বেগমগঞ্জের ব্যবসায়ী সেলিম উদ্দিন জানান,
“বাজারে যাওয়ার রাস্তা ডুবে আছে, দোকানে পানি ঢুকে মাল নষ্ট হয়েছে। ক্ষতির বোঝা আমাদের কাঁধেই পড়ছে।”

কোম্পানীগঞ্জের কৃষক দেলোয়ার হোসেন বলেন,
“ধানের চারা রোপণ করেছি, কিন্তু জমিতে পানি জমে পচে যাচ্ছে। কৃষি অফিসে জানিয়েও কোনো সমাধান পাইনি।”

নোয়াখালীতে বৃষ্টিতে শহরে জলাবদ্ধতা, মাঠে বোরো ধানের ক্ষতি

কৃষি খাতে প্রভাব

নোয়াখালীর অর্থনীতির বড় অংশ কৃষিভিত্তিক। ধান, সবজি, পাট ও মাছচাষ এখানে প্রচলিত। জলাবদ্ধতায়—

  • • ধান ও সবজির জমি পানিতে ডুবে ফসল নষ্ট হয়।
  • • মাছের ঘের ভেসে গিয়ে চাষির বড় ক্ষতি হয়।
  • • দীর্ঘদিন পানি জমে থাকায় মাটির উর্বরতা কমে যায়।
  • • নতুন মৌসুমের চাষ বিলম্বিত হয়ে উৎপাদন হ্রাস পায়।

ব্যবসা ও জনজীবনের ক্ষতি

জলাবদ্ধতায় নোয়াখালীর বাজার ও পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পণ্য আনা-নেওয়ার পথ ডুবে গিয়ে—

  • • ব্যবসায়ীরা সময়মতো মাল আনতে বা পাঠাতে পারেন না।
  • • ক্রেতা কমে গিয়ে বিক্রি হ্রাস পায়।
  • • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিতি কমে যায়,কর্মজীবীরা দেরিতে অফিসে পৌঁছান।

রেকর্ড বৃষ্টিতে নোয়াখালী শহরে জলাবদ্ধতা, জনদুর্ভোগ চরমে

সমাধানের প্রস্তাব

বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘমেয়াদি ও পরিকল্পিত উদ্যোগই পারে জলাবদ্ধতার সমাধান দিতে—

ড্রেনেজ ব্যবস্থা সংস্কার ও আধুনিকায়ন।

প্রাকৃতিক খাল-নালা পুনঃখনন ও সংরক্ষণ।

জোয়ার-ভাটা নিয়ন্ত্রণে স্লুইস গেট নির্মাণ।

বর্ষার আগে নিয়মিত ড্রেন ও নিষ্কাশন পথ পরিষ্কার।

প্রশাসন ও স্থানীয় জনগণের যৌথ উদ্যোগ।

নোয়াখালীর জলাবদ্ধতা এখন আর মৌসুমি দুর্ভোগ নয়, বরং স্থায়ী সমস্যা। কৃষি, ব্যবসা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য—সবক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যতদিন টেকসই সমাধান বাস্তবায়ন না হবে, ততদিন প্রতি বর্ষায় এখানকার মানুষকে একই ভোগান্তি পোহাতে হবে।