শৈশব ও পারিবারিক পটভূমি
শেখ মোহাম্মদ সুলতান, যিনি পরবর্তীতে এস এম সুলতান নামে পরিচিতি পান, জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলের মজুমদারপাড়ায়। তাঁর পিতা মেছের আলী মিঞা ছিলেন স্থানীয়ভাবে পরিচিত একজন রাজমিস্ত্রি এবং মা আমেনা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। আর্থিকভাবে পরিবার মধ্যবিত্তের নিচের সারিতে থাকলেও তারা গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিল। শৈশবে কাগজ-কলমের অভাবে তিনি গাছের পাতা, মাটির দেয়াল কিংবা খড়ের উপর আঁকাআঁকি করতেন। নড়াইলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য—ধানক্ষেত, নদীর ঢেউ, খালের জল, গরুর গাড়ি, কৃষকের হালচাষ—তাঁর মনে শিল্পের বীজ বপন করেছিল।
শিল্পশিক্ষার শুরু ও কলকাতা অধ্যায়
১৯৪১ সালে এক বন্ধুর সহায়তায় সুলতান কলকাতায় গিয়ে ভর্তি হন গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে। তিনি ছিলেন অপ্রচলিত প্রতিভাবান; শিক্ষকরা বিস্মিত হলেও তিনি পাঠ্যক্রমের বাইরে নিজের অভিজ্ঞতা ও কল্পনার উপর নির্ভর করে কাজ করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অস্থির সময়ে কলকাতার শিল্পমহলে ধীরে ধীরে পরিচিতি পান। অভিজাত মহলে মেলামেশা, প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ ও প্রগতিশীল শিল্পীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় তাঁর শিল্পদৃষ্টি প্রসারিত হয়। কৃষক-শ্রমিকের দৃঢ় দেহী চিত্রায়ণ এবং রঙের অনন্য ব্যবহারে তিনি নিজের স্বতন্ত্র স্টাইল গড়ে তোলেন।

যুদ্ধোত্তর সময়ে আন্তর্জাতিক সফর ও খ্যাতি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি কাশ্মীর, পাকিস্তান, তারপর ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণ করেন। কাশ্মীরে থাকাকালীন পাহাড়ি দৃশ্য আঁকলেও তাঁর ক্যানভাসে মূল বিষয় ছিল বাংলার কৃষিজীবন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে তাঁর চিত্র প্রদর্শিত হয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা কুড়ায়। বিদেশে থেকেও তিনি বাংলার কৃষক, নৌকা, নদী ও ধানক্ষেত আঁকতে ভোলেননি।
শিল্পধারা ও চিত্রভাষা
সুলতানের শিল্পের শক্তি ছিল বলিষ্ঠ কৃষক ও শ্রমিকের চিত্রায়ণ। তাঁর ছবির কৃষকরা মাইকেলএঞ্জেলোর ভাস্কর্যের মতো শক্তিশালী, যেন তারা শুধু শ্রম নয়, পুরো এক সভ্যতার মহিমা বহন করছে। তিনি কৃষককে অর্থনৈতিক জীবনের অংশ হিসেবে নয়, বরং বাংলার সংস্কৃতি ও অস্তিত্বের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে—“হুলিয়ার দিন”, “গ্রামীণ জীবন”, “কৃষকের শক্তি”, “গরুর গাড়ি”, “ধান কাটার দৃশ্য”। নদী, নৌকা, ক্ষেতের ধান, গৃহপালিত পশু ও অক্লান্ত শ্রম তাঁর ছবিতে বারবার ফুটে উঠেছে।

নড়াইলে প্রত্যাবর্তন ও “শিশু স্বর্গ” প্রতিষ্ঠা
দীর্ঘ বিদেশ ভ্রমণ শেষে তিনি নড়াইলে ফিরে আসেন এবং প্রতিষ্ঠা করেন “শিশু স্বর্গ”—এক মুক্তধারার শিক্ষাকেন্দ্র। এখানে শিশুরা প্রকৃতির মাঝে শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ও খেলাধুলার মাধ্যমে শিখত। তিনি শিশুদের কল্পনা, সৃজনশীলতা ও স্বাধীন চিন্তাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
১৯৮২ সালে একুশে পদক, ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার এবং বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদের বিশেষ সম্মাননা লাভ করেন। তাঁর কাজ নিয়ে দেশ-বিদেশে বহু গবেষণা ও প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে।

শেষ জীবন ও মৃত্যু
শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও ১৯৯০-এর দশকে তিনি আঁকাআঁকি চালিয়ে যান। নীরব, নিরহংকার এবং গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই শিল্পী ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোরে মৃত্যুবরণ করেন। নড়াইলের মজুমদারপাড়ায় তাঁর সমাধি।
উত্তরাধিকার ও প্রভাব
এস এম সুলতান শুধু চিত্রকর নন, বাংলার কৃষকজীবনের এক মহাকাব্যিক কণ্ঠস্বর। তাঁর বলিষ্ঠ কৃষক-শ্রমিকরা বাংলার মাটি, সংস্কৃতি ও সংগ্রামের প্রতীক। নড়াইলে গড়ে উঠেছে “সুলতান কমপ্লেক্স” ও স্মৃতি জাদুঘর, যা নতুন প্রজন্মকে তাঁর শিল্প ও জীবনচেতনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। আজও তাঁর চিত্রকর্ম শিল্পের পাশাপাশি ইতিহাস ও জাতীয় চেতনার প্রতীক হয়ে অনুপ্রেরণা জোগায়।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















